Restaurants

কুকিজ়ে মহুয়ার ছোঁয়া, কফিতে নলেন গুড়! বাংলার স্বাদে নবজাগরণ এনে নবকলেবরে ‘সিয়েনা’

নতুন সাজে নতুন ভাবে চালু হয়েছে হিন্দুস্তান পার্কের ‘সিয়েনা’। বাঙালিয়ানাকে খানিকটা আধুনিক মোড়কে তুলে ধরে এই তিনতলা আড্ডাখানা। আধুনিক পালিশে ঝকঝকে হয়েও কোথাও যেন বাংলার সোঁদা মাটিতে পা ডুবিয়ে থাকে এই ঠিকানা।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:৫৯
গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়ির মতো খড়খড়ি দেওয়া জানলা। তার পাশটিতে পাতা টেবিলে উপুড় করা দু’টি জলের ভাঁড়। বাঙালি বিয়েবাড়িতে কলাপাতার পাশে এমন ভাঁড়ে আগে জল খেতে দেওয়া হত অতিথিদের। এ জায়গাটি অবশ্য দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত এলাকার এক আধুনিক আড্ডাস্থল।

Advertisement

মাস চারেক বন্ধ ছিল ক্যাফে তথা বুটিক তথা রেস্তরাঁ— ‘সিয়েনা’। নতুন করে সাজার পালা চলছিল। তার পরে নব কলেবরে অতিথি আপ্যায়নের কাজে নেমেছে রেস্তরাঁটি।

‘সিয়েনা’র টেবিলে অতিথিদের জন্য রাখা মাটির ভাঁড়ে সুচারু সেরামিকের পরত। মেনু কার্ডের কাগজ পুরনো বইয়ের পাতার মতো লালচে। তাতে পেনসিল দিয়ে বাজারের ফর্দের মতো করে ইংরেজিতে লেখা আছে মেনু। ততোধিক বৈচিত্র সেই মেনুতেও।

কেমন মেনু? ধরুন ইটালির কোনও পদ। সেটি দিব্যি তার ঠাটবাট বজায় রেখেও বাঙালির অতি পরিচিত খাবারের সঙ্গে মিশে একখানা নতুন রূপ পেল। আবার জাপান, ফ্রান্স কিংবা ইরানের কোনও রেসিপি তৈরি হল বাংলার হাটবাজারে সহজেই পাওয়া সব উপকরণ দিয়ে। একসঙ্গে মিলে তাদের বন্ধুত্ব জমে গেল খাবারের প্লেটে। ‘সিয়েনা’র মেনুতে থাকা তেমনই এক খাবার গলাভাত আর শাক-রিসতোর!

বিদেশি খাবার তার ঠাটবাট বজায় রেখেও বাঙালির অতি পরিচিত খাবারের সঙ্গে মিশে একখানা নতুন রূপ পেল।

বিদেশি খাবার তার ঠাটবাট বজায় রেখেও বাঙালির অতি পরিচিত খাবারের সঙ্গে মিশে একখানা নতুন রূপ পেল। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

গোবিন্দভোগ চালের ফেনাভাতে ঘি–পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা দিয়ে মেখে আলসে দুপুরে আয়েশ করে খান অন্নপ্রেমী বঙ্গজরা। ‘সিয়েনা’র মেনুতে স্থান পেয়েছে সেই চিরাচরিত গলাভাতই। গলানো ছোট দানার কামিনী আতপ সেরামিকের থালায় পরিবেশন করা হয় আমেরিকার প্রিয় মুচমুচে মুরগি ভাজা দিয়ে। আবার ইটালির খাবার রিসোতো আসে বাংলার সজনে শাক সহযোগে। ইটালিতে রিসোতো বানানো হয় ছোট দানার আরবোরিয়ো চাল গলিয়ে। থকথকে ক্রিমের মতো ভাত মাখন, পেঁয়াজ, পার্মেজ়ান চিজ় সহযোগে খান ইটালীয়রা। সিয়েনার শাক রিসোতোয় পার্মেজ়ানের বিকল্প হয়ে পাতে থাকে বাংলার নিজস্ব ব্যান্ডেল চিজ়।

সিয়েনা স্রোতের উজানে না গিয়েও বাঙালিয়ানাকে একটু আধুনিক মোড়কে তুলে ধরে হিন্দুস্তান পার্কের তিনতলা আড্ডাখানায়।

সিয়েনা স্রোতের উজানে না গিয়েও বাঙালিয়ানাকে একটু আধুনিক মোড়কে তুলে ধরে হিন্দুস্তান পার্কের তিনতলা আড্ডাখানায়। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

একই ভাবনায় খাঁটি ‘ব্রিটিশ’ রাম অ্যান্ড রেজ়িন কুকিজ়ের উপকরণও যায় বদলে। শীতকালে রামে জারিয়ে নেওয়া কিশমিশ দিয়ে তৈরি কেক-কুকিজ়ের গন্ধে প্রাণ জুড়োয় দেশ-বিদেশের নানা জনের। কিন্তু রাম তো বিদেশি পানীয়! ‘সিয়েনা’র ভাবনায় তার দেশজ বিকল্প হিসাবে উঠে আসে বাংলার গ্রামের পানীয় মহুয়া। তৈরি হয় মহুয়া-রেজ়িন কুকিজ়। কফির সঙ্গে ক্যারামেলের বন্ধুত্ব চেনা। সিয়েনায় কিন্তু ক্যারামেল কফি জুটবে না। চিনিতে জাল দিয়ে তৈরি আঠালো ক্যারামেলের বদলে খেজুর রসে জাল দেওয়া নলেন গুড় ব্যবহার হয়। পোড়ামাটির কাপে সেজেগুজে সামনে আসে নলেন গুড় কফি। চালতার টক বাংলার রান্নাঘরের অকথিত পদগুলির একটি। তার সঙ্গে বিদেশি ক্যাফেতে খাওয়া চিকেন ব্রথ বা সুরুয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। সিয়েনায় এলে কিন্তু দেখা যাবে দুই ভাবনা মিশে গিয়েছে। চালতা দিয়ে তৈরি হয়েছে সুরুয়া, তার সঙ্গে সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে সিদ্ধ মাছ, পেঁয়াজ, লেবু-লঙ্কা দিয়ে তৈরি আমেরিকার খাবার সেভিচে। মিলেমিশে হচ্ছে ‘বাজার সেভিচে উইথ চালতা ব্রথ’। নারকেল দিয়ে মোচার ঘণ্ট না রেঁধে নারকেল, লেবুপাতা আর তেঁতুলের চাটনি দিয়ে স্যালাড বানানো যায় কে জানত! এখানে তা-ও মেলে। অথবা ডিমের কুসুমের বদলে গলদা চিংড়ির ঘিলু দিয়ে যে ফ্রান্সের হল্যান্ডাইজ় সস বানানো যায় তা-ও কি জানা ছিল? ‘সিয়েনা’ জানাল। শুধু তা-ই নয়, কাবলি ছোলার বদলে যে বাঙালির প্রিয় ছোলার ডাল দিয়েও ভূমধ্যসাগরীয় হুমজ় রাঁধা যায়, তা-ও দেখাল। মোট কথা পদ যা-ই হোক, তার সব উপকরণই পেতে হবে বাংলার মা-ঠাকুরমার রান্নাঘরে কিংবা বাঙালির বাজারের থলে থেকে। সেই ভাবনা থেকেই চেনা স্বাদের নতুন রূপের প্রাপ্তি। বিশ্বের পদকে বাংলার পাতে ফেলে স্বাদের নবজন্ম ঘটানো। সিয়েনা সেই ভাবনাকে স্পষ্ট জানায়ও। তাই তাদের রেস্তরাঁর মেনুর মলাটে লেখা থাকে— ‘ডাইনিং রুমে বেঙ্গল টু টেবল’।

দুই বাংলার খাবারদাবার নিয়ে বাঙালি বরাবরই আবেগপ্রবণ। যে কারণে বাংলা জুড়ে বাঙালিয়ানা উদ্‌যাপন করা রেস্তরাঁগুলি বছরভর ফাঁকা থাকে না। আইবুড়োভাত থেকে শুরু করে ভাইফোঁটা, জামাইষষ্ঠী, পয়লা বোশেখের ভূরিভোজ— উপলক্ষ পেলেই উপচে পড়ে ভিড়। সিয়েনা সেই স্রোতের উজানে না গিয়েও বাঙালিয়ানাকে একটু আধুনিক মোড়কে তুলে ধরে হিন্দুস্তান পার্কের তিনতলা আড্ডাখানায়। ধরা দেয় ‘গ্লোবাল বাঙালি’ প্রতিনিধি হয়ে। যেখানে আধুনিক পালিশে ঝকঝকে হয়েও কোথাও যেন বাংলার সোঁদা মাটিতে পা ডুবিয়ে থাকে এই ঠিকানা।

 জোর করে বাঙালিত্ব আনার চেষ্টা নেই। তবে সিলিংয়ের আলোয় বাংলার টানাপাখার আদলের শেডের ব্যবহার আছে।

জোর করে বাঙালিত্ব আনার চেষ্টা নেই। তবে সিলিংয়ের আলোয় বাংলার টানাপাখার আদলের শেডের ব্যবহার আছে। —নিজস্ব চিত্র।

মাস চারেক বন্ধ থেকে নতুন করে আবার খুলেছে হিন্দুস্থান পার্কের আড্ডাখানাটি। মাঝের সময়টুকু তারা নিয়েছিল নিজেদের একটু নতুন করে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। সেই সাজগোজ সময়োপযোগী হলেও কোনও বাহুল্যের ধার ধারেনি। কোথাও ইট বেরিয়ে থাকা দেওয়াল। কোথাও পলেস্তারার। মেঝের টালিও পাথুরে ধূসর। ছিমছাম নকশাহীন পুরানো আদলের কাঠের চেয়ার, টেবল। তাতে সাজানো পোড়ামাটি আর সিরামিকের থালা-চামচ-গ্লাসেও বাহুল্য নেই। তবে স্মার্টনেস আছে। জোর করে বাঙালিত্ব আনার চেষ্টা নেই। সিলিংয়ের আলোয় বাংলার টানাপাখার আদলের শেডের ব্যবহার আছে। বুটিক বিপণিতে আছে টেরাকোটা এবং সেরামিকের পটারি, ডাইনিং সেট, কফি সেট। চটের ব্যাগ, সুতির শাড়ি, পশমের জামাকাপড়, ডোকরার গয়না।

‘সিয়েনা’য় যাঁরা নিয়মিত, তাঁদের অনেকেই ক্যাফের হট চকোলেটের অনুরাগী। বাঙালির হট চকোলেট প্রেম অনেকটাই ফেলুদার সূত্রে। ‘কেভেন্টার্স’-এর ছাদে বসে ফেলুদা-তোপসের হট চকোলেট খাওয়ার বিবরণের দৌলতে দার্জিলিঙে গেলেই বাঙালির ‘কেভেন্টার্স’ গমন এবং হট চকোলেট পান একটা রেওয়াজ। ‘সিয়েনা’র খোলা উঠোনে বসে সেই হট চকোলেট খেতে মন্দ লাগবে না। অর্ডার করলে ওয়েটার এসে মিষ্টি হেসে জানতে চাইবেন, হট চকোলেট কতটা ঘন খেতে পছন্দ করবেন আপনি। সেই বুঝে তৈরি হবে পানীয়। ‘সিয়েনা’ রঙের পেয়ালা পিরিচেই পরিবেশন করা হবে তাকে।

শান্তার কাজকে শহরের মানুষের ঘরের কাছে আনার সিদ্ধান্ত অবশ্য পরে নেন তাঁর কন্যা শিউলি ঘোষ।

শান্তার কাজকে শহরের মানুষের ঘরের কাছে আনার সিদ্ধান্ত অবশ্য পরে নেন তাঁর কন্যা শিউলি ঘোষ। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

‘সিয়েনা’ অর্থাৎ, লালচে খয়েরি মাটির রং। যেমনটা দেখা যায় বীরভূমে, যে ‘রাঙামাটি’র কথা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দক্ষিণ কলকাতার ক্যাফে-রেস্তরাঁর নামে তো বটেই, জন্মবৃত্তান্তেও সেই রাঙামাটির স্পর্শ রয়েছে। রাঙামাটির দেশে শান্তিনিকেতনে পটারি কর্মশালা চালাতেন পেশায় স্থপতি শান্তা ঘোষ। নিজস্ব ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা থাকা সত্ত্বেও শান্তার ঝোঁক ছিল শিল্পে। শান্তিনিকেতনের কর্মশালায় স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে কাজ করতেন। তাঁদের তৈরি শিল্পকর্ম বিক্রিও করতেন সেখান থেকেই। শান্তার কাজকে শহরের মানুষের ঘরের কাছে আনার সিদ্ধান্ত অবশ্য পরে নেন তাঁর কন্যা শিউলি ঘোষ। তাঁর উদ্যোগেই ‘সিয়েনা’র গোড়াপত্তন। প্রথমে শপিং মলে ঠিকানা হলেও ২০১৬ সালে তাঁরা চলে আসেন হিন্দুস্তান পার্কে তাঁদেরই পরিবারের একটি পুরনো বাড়িতে। বিপণির পাশাপাশি ক্যাফে খোলার সিদ্ধান্ত তখনই। প্রথমে রান্না পটিয়সী শান্তার নিজস্ব কিছু প্রণালী দিয়েই টুকটাক খাবার পরিবেশন করা হত। এখন অবশ্য সিয়েনার বৈচিত্রময় মেনুর নেপথ্যে রয়েছে পেশাদার রাঁধুনিদের দল। দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের একটি দলও। তাঁরাই ক্যাফের ভিড় বাঁচিয়ে যথা সময়ে টেবিল পর্যন্ত পৌঁছে দেবে অতিথিকে। মর্জি বুঝে বলে দেবে কোন খাবার বা কোন পানীয় খেতে ভাল লাগবে।

বাংলার মাটির কাছাকাছি, রকমারি জিনিসপত্রের সেই বিপণির লাল-নীল আভা পেরিয়ে যত ক্ষণে টেবিল পর্যন্ত পৌঁছবেন, তত ক্ষণে বেশ খানিকটা ‘সিয়েনা’-র ধাঁচে গড়া হয়েছে মন। মেনুতে বাংলা আর বিশ্বের মিশেল দেখে খাবার পছন্দ করতে অসুবিধাও কম হবে। কারণ, উপকরণগুলি চেনা হলেও পদ তো অচেনা। নতুন। শিল্পকর্মও বটে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই এগিয়ে আসেন ‘সিয়েনা পরিবারের’ কোনও এক সহায়ক!

Advertisement
আরও পড়ুন