‘প্রজাপতি’র মুক্তির আগে আনন্দবাজার অনলাইনে খোলামেলা আড্ডায় মমতা শঙ্কর। ফাইল চিত্র।
প্রশ্ন: ‘প্রজাপতি’র পরিচালক অভিজিৎ সেন তুলনামূলক ভাবে নতুন। তা হলে এই ছবি করতে রাজি হলেন কেন?
মমতা: নামকরা পরিচালক হলেই তাঁর ছবি করব, আর নতুন হলে করব না, এ ভাবে আমি কোনও দিন বিচার করিনি। কারণ, আমি বেশির ভাগ পরিচালকের সঙ্গে কাজই করেছি তাঁদের প্রথম ছবিতে। যেমন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রথম ছবি। বা অরিন্দম ভট্টাচার্যের প্রথম ছবি। গৌতমদারও (ঘোষ) প্রায় প্রথম ছবিই বলতে গেলে। এখন তো কত জনের প্রথম ছবিতে করছি। আরও এক জনের ছবিও করছি। অভিজিৎ শ্রীদাস বলে। চিত্রনাট্য যদি ভাল হয়, তা হলে আমি রাজি হই। আর একটা ব্যাপার হল, পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে যদি আমার মনে হয় যে, আমার ওয়েভলেংন্থ মিলছে, তাঁকে ভাল মানুষ বলে মনে হচ্ছে, একটা বুদ্ধির ছাপ আছে, তা হলেও আমি সেই ছবিতে কাজ করি।
প্রশ্ন: দেবের সঙ্গে এটা আপনার প্রথম কাজ। কেমন লাগল কাজ করে?
মমতা: দেবকে আমি অনেক দিন ধরে চিনি। কিন্তু এ বার কাজ করতে গিয়ে যে ভাবে ওর সঙ্গে আমার কথাবার্তার সুযোগ বেশি হল— ভীষণ ভাল। মনে হচ্ছিল, আমার দুই ছেলের উপর আমার যে রকম টান, ওর উপরও সে রকম টান। খুবই ভদ্র। মনেই হয়নি যে, ওর সঙ্গে আমি প্রথম কাজ করছি।
প্রশ্ন: অভিনেতা হিসেবে দেব কেমন?
মমতা: আমার সঙ্গে ওর যে দৃশ্যটা ছিল— একটাই বড় দৃশ্য— সেই দৃশ্যে তো খুবই ভাল করেছে। ওর ‘বুনোহাঁস’ আমার ভাল লেগেছিল। আর ‘জুলফিকর’ও। আসলে সবাই যে সব ছবিতেই ভাল করবে, এমনটা অনেক সময় হয় না। চিত্রনাট্য ভাল থাকে না। ভাল করার চেষ্টা করলেও ভাল করা হয়ে ওঠে না। তবে ‘প্রজাপতি’তেও ওকে খুব ভাল লাগবে।
প্রশ্ন: সবাই দেখবেন ‘প্রজাপতি’ মিঠুন চক্রবর্তী-দেবের ছবি। কিন্তু যাঁরা জানার, তাঁরা জানেন এই ছবি আসলে মিঠুন-মমতা শঙ্করের সেই মৃণাল সেনের ‘মৃগয়া’র ৪৬ বছর পর আবার একসঙ্গে বড় পর্দায় ফিরে আসার ছবি...।
মমতা: (খুব হেসে) আমি জানি না। না, না। এটা দেব আর মিঠুনেরই ছবি বলব। আসলে এটা কিছু লোকে বলছে কারণ আমরা এত বছর পর একসঙ্গে ফিরছি।
প্রশ্ন: ৪৬ বছর পর...
মমতা: না, ৪৭ বছর পর! কারণ আমরা (‘মৃগয়া’র) শুটিং করেছিলাম ১৯৭৫-এ। কিন্তু ৪৭ বছর পর যে কাজ করছি, সেটা এক বারও মনে হয়নি। মনে হচ্ছিল, এই তো সে দিন শুটিং করলাম! যেখান থেকে ছেড়েছিলাম, মনে হল সেখান থেকেই আবার আরম্ভ করলাম।
প্রশ্ন: কেন? কারণটা কী?
মমতা: আসলে এমনিতে যোগাযোগটা ছিল আমাদের সব সময়ই। ওর বাড়ির সঙ্গে আমার খুবই যোগাযোগ ছিল। ওর বোনেদের সঙ্গে, মাসিমার (মিঠুনের মা) সঙ্গে নিয়মিত আমার কথা হয়। বোনেদের সঙ্গেই বেশি। মিঠুনের সঙ্গেও তাই। দেখা হলেই যেখানে শেষ বার কথা ছেড়েছিলাম সেখান থেকে শুরু হয়। ও আমাকে খুব খেপায়, মজা করে। আসলে একসঙ্গে ছবিটাই শুধু করিনি।
প্রশ্ন: ‘মৃগয়া’র সময় আপনাদের তো বিয়ের তারিখও ঠিক হয়ে গিয়েছিল...
মমতা: (হেসে, খানিক লজ্জা পেয়ে) সে হয়েছিল।
প্রশ্ন: তার পর?
মমতা: কী জানি, ওটা একটা অধ্যায় গিয়েছে জীবনে। সেটা হওয়াতে বোধ হয় আমি চন্দ্রোদয়কে আরও ভাল ভাবে চিনেছি, বুঝেছি। আরও বেশি ভালবাসতে পেরেছি। মানে, এটাই বোধ হয় ঈশ্বরের করা প্ল্যান। তাই এ দিকেও কোনও রকম তিক্ততা হয়নি। সেই অধ্যায়টা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বটা সুন্দর ভাবে রয়ে গিয়েছে। আমরা খুব ভাল বন্ধু। এখন মনে হয় এটা হওয়ার ছিল। এবং এইটাই হওয়ার ছিল।
প্রশ্ন: তখন চন্দ্রোদয়ের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হয়েছিল?
মমতা: (টেনে টেনে) হ্যাঁ-হ্যাঁ। সে অনেক গল্প। সেটা যদি কোনও দিন একটা বই লিখি সেখানে বলব।
প্রশ্ন: এখন বলুন...
মমতা: সেটা ঠিক হবে না। মোট কথা ওটা হওয়ার ছিল, ওটা হয়েছিল। চন্দ্রোদয়ের সঙ্গে ওরও খুব ভাল বন্ধুত্ব। ফোনে কথা হয়। এ বারও কথা হয়েছে। সব মিলিয়ে খুব সুন্দর খোলামেলা একটা সম্পর্ক সবার মধ্যে।
প্রশ্ন: আপনার কি কখনও আক্ষেপ হয়?
মমতা: ভাল হয়েছে বিয়ে না হয়ে। মিঠুন খুবই ভাল। কিন্তু আমার নাচ, আমার ছবি করা এগুলো বন্ধ হয়ে যেত। ও সেটা পছন্দ করত না। ওর হচ্ছে যে, তুই শিখছিস শেখ। কিন্তু বউ হলে বাড়িতে থাকবে। যোগিতার বেলায়ও যেটা হয়েছে। ওর জন্য যোগিতাই ঠিক ছিল। আমার জন্য চন্দ্রোদয় ঠিক।
প্রশ্ন: মৃণাল সেন কী বলেছিলেন আপনাদের এই প্রেম নিয়ে?
মমতা: মৃণালদা চন্দ্রোদয়কে খুব পছন্দ করতেন। মিঠুনকে তো করতেনই। আমি আর কিছু বলব না (হাসতে হাসতে)।
প্রশ্ন: মানে, আপনি বিশ্বাস করেন যেটা হওয়ার সেটাই হয়?
মমতা: সেটাই হয়। আর যেটা হয় সেটা ভালর জন্য হয়। এটা আমি একদম বিশ্বাস করি। আমরা তখন হয়তো বুঝতে পারি না। তখন মনে হয় পুরো পৃথিবীটা ধসে যাচ্ছে। কিন্তু পরে যখন সময় যায়, সব কিছু পাল্টাতে থাকে, তখন সব কিছু মুছে গিয়ে আলোকরেখা ফুটে ওঠে। তখন মনে হয়ে যে কত ভুল ভাবছিলাম। সুতরাং নিজেকে ছেড়ে দেওয়াটাই সব চেয়ে ভালো। কারণ প্ল্যানিং উপরে কেউ করছেন। ঈশ্বরের পায়ে নিজেকে ছেড়ে দিতে হবে।
প্রশ্ন: এই প্রজন্মে কার কার সঙ্গে কাজ করে ভাল লেগেছে?
মমতা: প্রত্যেক পরিচালকের সঙ্গেই আমার খুব ভাল অভিজ্ঞতা। একমাত্র যদি কোনও সংলাপ আমার পছন্দ না হয়, যদি বলতে সাবলীল বোধ না করি, তা হলে আমি পরিচালককে বলি সে কথা। যে আমি এ রকম ভাবে বলতে পারি? এটা আমি মানিক কাকার (সত্যজিৎ রায়) সঙ্গেও বলেছিলাম।
প্রশ্ন: তাই? কোন ছবিতে?
মমতা: ‘গণশত্রু’তে। বলেছিলাম, ‘‘মানিক কাকা এটাকে কি এ রকম ভাবে বলতে পারি?’’ উনি বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, বলতে পারিস।’’ এটা করলে অভিনয়টা অনেক স্বাভাবিক হয়। এই ক্ষেত্রে আমার একমাত্র খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছিল বুদ্ধদেবদার (দাশগুপ্ত) সঙ্গে। ‘গৃহযুদ্ধ’ ছবিতে। ওঁর ইগোতে সমস্যা হচ্ছিল হয়তো। আমি ওঁকে বলেছিলাম যে, ‘‘আমাকে বলুন এই সংলাপটা আমি কেন বলছি। আমি ভিতর থেকে সায় পাচ্ছি না এটা বলার।’’ উনি বলছেন, ‘‘না, তুমি বল।’’ আমি বললাম, ‘‘নিশ্চয়ই বলব। কিন্তু আমায় তো বুঝতে হবে, আমি কেন বলব। যদি আমি এই সংলাপে বিশ্বাস না করতে পারি, তা হলে আমি ডেলিভার করব কী করে? আপনি আমাকে বুঝিয়ে দিন। শুধু বলতে বললে আমি পারব না।’’ অনেক ক্ষণ শুটিং থেমে ছিল। গৌতম ঘোষ আর আমার একটা দৃশ্য ছিল। তার পর গররাজি হয়ে উনি কিছু একটা বুঝিয়ে দিলেন। আমি দেখলাম সময় নষ্ট হচ্ছে। তাই ছেড়ে দিলাম।
প্রশ্ন: আপনি সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের সঙ্গে কাজ করেছেন। এই প্রজন্মের সঙ্গেও করছেন। মৌলিক ভাবে তফাতটা কোথায়?
মমতা: আসলে তখন আমরা এত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে শুটিং করতাম। সেই তুলনায় এখন আমরা ভীষণ আরামের মধ্যে শুটিং করি। আমাদের মেক আপ ঘর থেকে ভ্যানিটি ভ্যান। যে রকম ভাবে খাবার দেওয়া হয়, খুবই সড়গড় পুরো ব্যাপারটা। এখন তো ডাবিং-এর পুরো প্রক্রিয়াটাই বদলে গিয়েছে। তখন লুপে ডাব করতে হত। ভীষণ মুশকিলের মধ্যে করেছি। কিন্তু ভীষণ আনন্দ করে করেছি। কারণ পরিচালকদেরও দেখেছি, কী ভাবে পুরো ছবিটার সঙ্গে তাঁরা নিজেদের জড়িয়ে রেখেছেন। এখন এক এক জন পরিচালক বছরে তিনটে করে ছবি করছেন! কোথাও যেন সেই নিজেকে জড়িয়ে রাখার ব্যাপারটা নেই। ভীষণ কষ্ট হয়। যেমন ছবি কত দিন আগে হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তার ডাবিং এখনও হয়নি। যখন ডাবিং হবে, তখন ছবির সঙ্গে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। আবার সেই অনুভূতিগুলোকে আনতে হবে। তাই ভীষণ কষ্ট হয়। এখন আমি হয়তো শুটিং করছি, তার মধ্যে পরিচালক বললেন, ‘‘মমদি, এই শটটা ও নিয়ে নেবে। আমার বিকেলে মুম্বইয়ের ফ্লাইট। আমি আবার কাল সকালে চলে আসব।’’ এ দিকে বিকেলেই হয়তো একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য! আমার কাজ করা এ সবের থেকে এতটাই আলাদা। কিন্তু মানিয়ে নিতে নিতে চলছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও বদলাতে হবে।
প্রশ্ন: আপনাকে কি মনে হয় একই ধরনের চরিত্রে একটু বেশিই কাস্ট করা হয়েছে?
মমতা: আগে হয়েছিল। আর এতে আমার বাড়ির লোক সব থেকে বিরক্ত হত। এখন আমি অনেক অন্য ধরনের চরিত্র করছি। এত ভাল লাগছে। যেমন ‘অন্তর্লীন’-এ করলাম। আমি খলনায়িকা নই। কিন্তু কেউ ভাবতে পারবে না যে, আমি খুনটা করেছি। এই নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে। অরিন্দম ভট্টাচার্যের ‘শিবপুর’ বলে একটা ছবি করলাম। একটা ক্যামিয়ো চরিত্র, কিন্তু আমি এ রকম চরিত্র কোনও দিনও করিনি।