কেরিয়ারের প্রথম হিন্দি ছবির শুটিং করছেন যশ। কেমন সেই অভিজ্ঞতা? ছবি: সংগৃহীত।
চলতি বছরেই বলিউডে পা রাখতে চলেছেন যশ। তার জন্যে মাঝেমধ্যেই কলকাতার বাইরে পা রাখতে হচ্ছে তাঁকে। এ দিকে শহরে চলছে তাঁর নতুন বাংলা ছবির শুটিং। বেঙ্গালুরুতে হিন্দি ছবির আউটডোরে যাওয়ার আগে সময় দিলেন অভিনেতা। সম্প্রতি এক দুপুরে ‘শিকার’ ছবির শুটিং ফ্লোরে ভ্যানিটি ভ্যানে আনন্দবাজার অনলাইনের মুখোমুখি যশ। হাতের গ্লাসে তরমুজের রস থাকলেও তাঁর উত্তর কিন্তু পরিবেশ বেশ উত্তপ্ত করে তুলেছিল।
প্রশ্ন: এই বৃষ্টি, তো এই কাঠফাটা গরম। এই পরিস্থিতিতে শুটিং! কতটা উপভোগ করছেন?
যশ: (হেসে) ‘মোকা’ এল না বলে গরমটা আরও বেড়ে গিয়েছে। এই ছবির প্রথম দিনেই একটা ফাইট সিকোয়েন্স ছিল। ইনডোর শুট। সে দিন একটু চাপে পড়ে গিয়েছিলাম। তা ছাড়া কোনও সমস্যা নেই।
প্রশ্ন: এই ছবিতে আপনার সঙ্গে নুসরত রয়েছেন। এখন শুটিং ফ্লোরে আপনাদের রুটিনে কী কী পরিবর্তন এসেছে?
যশ: এখন তো আমরা একসঙ্গেই থাকি। কল টাইম আগে-পরে থাকলেও একসঙ্গেই সেটে চলে আসি। তাই যার আগে শুটিং শেষ হয়, অন্য জন অপেক্ষা করে। শুটিংয়ের ফাঁকে বাড়ির কোনও বিষয় নিয়েও আলোচনা চলে। পরিবর্তন বলতে এগুলোই।
প্রশ্ন: টলিউডের পর এ বার বলিউডে পা রাখতে চলেছেন। ‘ইয়ারিয়াঁ ২’ ছবির প্রস্তাব পাওয়ার পর মনের মধ্যে কী চলছিল?
যশ: সত্যি বলছি, প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। আমাকে ওঁরা মুম্বইয়ে একটা মিটিংয়ের জন্য ডেকেছিলেন। তখন মুম্বইয়ে নুসরতেরও একটা শুট ছিল। আমি যাওয়ার পর ভূষণ কুমারের (ছবির প্রযোজক) সঙ্গে কিছু ক্ষণ কথা হয়। সে দিনই জানতে পারলাম, আমি নির্বাচিত হয়েছি। আসলে ওঁরা আমার কাজ আগেই দেখেছিলেন। হয়তো মুখোমুখি এক বার দেখা করতে চাইছিলেন।
প্রশ্ন: এক সময় হিন্দি ছোট পর্দায় কেরিয়ার শুরু করেছিলেন। এ বার হিন্দি ছবিতে পা রাখতে চলেছেন। জীবনের একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল কি?
যশ: (একটু ভেবে) ঠিক তা নয়। অতিমারির পর ওটিটি আরও ছড়িয়ে পড়েছে। তার ফলে নির্মাতারা আঞ্চলিক ইন্ডাস্ট্রিতে কী কী কাজ হচ্ছে, তার খোঁজখবর রাখছেন। এক জন অভিনেতাও তো চাইবেন, তাঁর কাজটা যাতে সব থেকে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। তাই এটা আমার জার্নির একটা অংশ। আজকে দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রির সুপারস্টাররাও বলিউডে ছবি করছেন। আরও একটা জিনিস এখানে উল্লেখ করতে চাই।
প্রশ্ন: বলুন...
যশ: আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে সমস্যা থাকতেই পারে। কিন্তু আমরা যখন বাইরে গিয়ে কাজ করি, তখন আমরা বাংলা ইন্ডাস্ট্রির রিপ্রেজেন্টেটিভ। একটা ভুল পদক্ষেপ... আর ওঁরা আমার ইন্ডাস্ট্রিকে জাজ করতে শুরু করবেন। তাই শুধু সুযোগের পাশাপাশি এটা আমার কাছে একটা বড় দায়িত্বও বটে।
প্রশ্ন: ছবিতে দিব্যা খোসলা কুমার, মিজ়ান জাফরির মতো তারকারা রয়েছেন। মানুষ হিসেবে ওঁরা কেমন?
যশ: বাংলায় আমরা কাজ করি আবেগের বশবর্তী হয়ে। ওদের ইন্ডাস্ট্রিটা অনেক বড়, অনেক বেশি প্রতিযোগিতা। তাই ওঁরা অনেক বেশি পেশাদার। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি আয়তনে ছোট। এখানে কাজ করতে গিয়ে হয়তো টেকনিশিয়ানও রিপিট হয়। টলিউড যদি নদী হয়, তা হলে বলিউড অনেকটা সাগরের মতো।
প্রশ্ন: অনেক সময়েই বলা হয়, আঞ্চলিক ইন্ডাস্ট্রির তারকাদের বলিউডে নাকি সেই ভাবে পাত্তা দেওয়া হয় না। আপনার কী রকম অভিজ্ঞতা?
যশ: উল্টে আমি বলব, অনেকগুলো ইতিবাচক বিষয় শেখা যায়। বাংলায় বাজেট কম। দিনে হয়তো কখনও আমরা ৭-৮টা সিনও শুট করি। ওখানে দেখলাম, কোনও দিন হয়তো একটা মাত্র সিনের শুটিং হল। সেটাও শেষ না হলে আবার পরের দিন ওখান থেকেই শুরু হল। ফলে অনেকটা ধরে সময় নিয়ে কাজটা করা যায়। বাজেট বেশি বলে ওরা সেটা করতে পারে। বিপরীতে আমাদের টেকনিশিয়ানরা অত্যন্ত গুণী। না হলে কি দশ-বারো দিনে এখানে একটা ছবির শুটিং শেষ করা সম্ভব হত?
প্রশ্ন: এই দ্রুততার সঙ্গে একটা ছবির শুটিং শেষ করা কি বাংলা ছবির ক্ষেত্রে উপকারী?
যশ: আমার মনে হয় না খুব ভাল একটা দিকে আমরা এগোচ্ছি। কারণ ছোট থেকেই জেনেছি, সিনেমা মানেই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। তাই সেটা যত সময় নিয়ে তৈরি হবে, ততই ভাল হবে। সারা দিনে একটা সিনের সঙ্গে একাধিক সিনের তুলনা তো হতে পারে না।
প্রশ্ন: কিন্তু এই ভাবে তো অভিনেতার উপরেও একটা চাপ সৃষ্টি হয়। সেটা কী ভাবে সামলান?
যশ: সময়ের সঙ্গে যে কোনও পরিস্থিতিতে আমি মানিয়ে নিতে পারি। চাপের মধ্যেও তো বাংলা ছবি ভাল ব্যবসা করছে। জাতীয় স্তরে বাংলা ছবি নিয়ে কথা হচ্ছে। এর মাধ্যমে আমাদের কলাকুশলীর দক্ষতাই প্রমাণিত হয়। এত কম বাজেটে এত ভাল কাজ করছেন! বলিউডের একটা ছোট ছবির বাজেটেও এখানে ২০টা বাংলা ছবি তৈরি হতে পারে। এক বার শুধু ভাবুন, টলিগঞ্জের কাউকে বলিউডের বাজেট দিলে তিনি কতটা ভাল কাজ উপহার দিতে পারবেন।
প্রশ্ন: আপনার মতে টলিউডের কোথায় কোথায় উন্নতির প্রয়োজন?
যশ: বাণিজ্যিক ছবিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ সর্বভারতীয় স্তরে আজও যে ছবিগুলো ১ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করছে, সেগুলো কিন্তু সবই বাণিজ্যিক। বিনোদনের ক্ষেত্রে সব রকমের স্বাদই প্রয়োজন। সেখানে কোনও একটিকে বাদ দেওয়া ঠিক নয়। মফস্সলের মানুষ কিন্তু এখনও বাণিজ্যিক ছবিই দেখতে পছন্দ করেন। আজকে আমি বা ইন্ডাস্ট্রিতে আমার সতীর্থরা যেখানে রয়েছি, সেটাও বাণিজ্যিক ছবির দৌলতেই। শহরের দর্শকরা কিন্তু সিনেমা হলে গিয়ে সিটি বাজান না, বাজান গ্রামবাংলার দর্শক। ৩০ শতাংশ মানুষের কথা ভাবতে গিয়ে ৭০ শতাংশ মানুষকে ভুলে যাওয়াটা কি ঠিক?
প্রশ্ন: পাশাপাশি এটাও তো বলা হচ্ছে, বাংলা ইন্ডাস্ট্রি আকারে আয়তনে নাকি বাড়ছে না।
যশ: সেটাই তো স্বাভাবিক। কারণ প্রযোজক ছবিতে বিনিয়োগ করেই পরের দিন মুনাফা চাইলেই তো পাবেন না। তাঁকে বিনিয়োগ করে অপেক্ষা করতে হবে। ৫ বছর পর ইন্ডাস্ট্রিকে কী ভাবে দেখতে চাইছেন, সেই দূরদর্শিতা থাকতে হবে। কারণ ইন্ডাস্ট্রির ভাল হলে সবাই করে খেতে পারবে। একা আমার ভাল হবে, আর কাউকে জায়গা দেব না— এই করে বাংলা ইন্ডাস্ট্রি আরও পিছিয়ে যাবে!
প্রশ্ন: এখানে তো শুনি এখন সেটাই হচ্ছে।
যশ: হ্যাঁ। প্রযোজকদের খোলামনে কাজ করতে হবে। এমনকি আমার তো মনে হয়, এখানে এখন মাল্টিস্টারার ছবি তৈরি হওয়ার খুব দরকার। মুম্বইয়ের বড় তারকারা যদি একসঙ্গে কাজ করতে পারেন, তা হলে আমারও মনে হয় যে আমরা আমাদের ইগো ভুলে একসঙ্গে ছবি করতেই পারি।
প্রশ্ন: সম্প্রতি ‘চেঙ্গিজ়’-এর মাধ্যমে জিৎ বাংলা ছবিকে সর্বভারতীয় স্তরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন।
যশ: এখনও পর্যন্ত জিৎ’দাই নিজের ছবির ঘরানা বদলাননি। যে ঘরানার ছবিতে তিনি বিশ্বাসী, চিরকাল তার পাশে থেকেছেন। এটাই তো করা উচিত। আমিও ছোট থেকে বাণিজ্যিক ছবি দেখেই বড় হয়েছি এবং আমার এই ধরনের ছবিই পছন্দ। জিৎ’দা যেটা একা করলেন, সেটাই আমরা সবাই মিলে করলে নিশ্চয়ই আরও ভাল ফল পাব। ছবিমুক্তির সময় শুধু একটা টুইট করলাম, ‘‘অনেক অনেক শুভেচ্ছা’’— এটাকে আমি কোনও সাপোর্ট বলে মনে করি না!
প্রশ্ন: কিন্তু আপনিও তো মাঝে অন্য ধারার ছবি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন।
যশ: আমি বাণিজ্যিক ছবি নিয়েই থাকতে চাই। অন্য ধারার ছবি করেছি। হয়তো পারিশ্রমিকের জন্য করেছি। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা আমার কাছেই খুবই বোরিং। আমার ভাল লাগেনি। আমি বাণিজ্যিক ছবি করতেই ভালবাসি। যার হাসার হাসতে পারে, আমার কিছু যায় আসে না!
প্রশ্ন: আপনার প্রথম বাংলা ছবি ‘গ্যাংস্টার’ পুজোয় মুক্তি পেয়েছিল। এই বছর পুজোয় আপনি আসছেন হিন্দি ছবি নিয়ে। পুজোর ছবির প্রতিযোগিতা কি অন্য রকম হতে চলেছে?
যশ: প্রথমত, ছবিমুক্তির সিদ্ধান্ত প্রযোজকের, আমার নয়। ওই সময় দুর্গাপুজো, নবরাত্রি— সব মিলিয়ে একটা উৎসবের পরিবেশ থাকে। তা ছাড়া বলিউডে কোনও ছবি মুক্তি পেলে ওরা সারা দেশের ব্যবসা নিয়ে চিন্তা করে। হিন্দি ছবির সঙ্গে পুজোর বাংলা ছবির প্রতিযোগিতা কেন হবে? আমার ছবিটা ‘মিউজ়িক্যাল’। ছবিটা সারা দেশে ভাল ব্যবসা করুক, সেটাই চাই।
প্রশ্ন: নুসরতও নাকি বলিউডে কাজের চেষ্টা করছেন?
যশ: নির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা করে আমরা এগোই না। দু’জনেই এখন কেরিয়ারের সেই পর্যায়ে নেই যে, লোকের কাছে গিয়ে কাজ চাইব! ভাল প্রস্তাব এলে নিশ্চয়ই ভেবে দেখব। কিন্তু নুসরতের এ রকম মনোভাব নেই যে, শুধুই টাকার জন্য কাজ করবে।
প্রশ্ন: এখন কি আপনি একটু বেছে বেছে ছবি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
যশ: (হেসে) কেউ বলছেন বেছে কাজ করছি! কেউ বলছেন আমার হাতে কাজ নেই! তা হলে আমি একটু ব্যাখ্যা দিই। আমি যখন একটা বড় প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে কাজ করতাম, তখন সেখানে কারও বছরে দুটো বা কেউ খুব ভাল কাজ করলে তার তিনটে ছবি মুক্তি পেত। শাহরুখ খান ৫ বছর পর ‘পাঠান’ নিয়ে এলেন। টালিগঞ্জে ৫ বছর বাড়ি বসে থাকলে বলা হবে, ওয়াশ আউট হয়ে গিয়েছে!
প্রশ্ন: ছবি নিয়ে আপনার স্ট্র্যাটেজিটা একটু জানতে চাই।
যশ: প্রতি দু’মাসে একটা ছবি মুক্তি পাওয়াটা কোনও নায়কের ক্ষেত্রেই আমার মনে হয় না ভাল লক্ষণ। আমি জানতে চাই, আজকে কোন ইন্ডাস্ট্রিতে কোন নায়কের বছরে ১০টা ছবি মুক্তি পায়? আর সেটাকে যদি বলা হয় কাজ পাওয়া, তা হলে আমি এই বেশ ভাল আছি। কারণ সিনেমায় অভিনয় করছি। একটু না হয় কম কাজ করি, কিন্তু একটু বেছে কাজ করব। কুড়িটা ছবি সাইন করে বাজার থেকে টাকা তুললাম। তার পর বছরে সেই দুটো ছবিই মুক্তি পেল। এর থেকে তো বছরে দুটো ছবি করেই আমি খুশি।