Rishav Basu

এখন বাংলা ছবি চলে প্রচারের জোরে, গুণমানের ভিত্তিতে নয়, মত ‘পর্দার শ্রীকান্তের’

চেহারা বদল থেকে শুরু করে ইচ্ছা বদল। নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে চলেছেন তরুণ অভিনেতা। প্রচারের আলোয় কম থাকলেও কেরিয়ারের গ্রাফ তরতরিয়ে উঠছে ঋষভ বসুর।

Advertisement
তিয়াস বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৩ ১০:১৪
Tollywood actor Rishav Basu speaks about his acting career

এমনিতে তিনি বিন্দাস, তবে জীবনের কোনও পর্যায়ে হয়তো ‘দেবদাস মাইনাস অ্যালকোহল’! গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

একাই থাকেন। রাঁধেন, আবার গানও গান। ফাঁকে ফাঁকে রহস্যভেদ। লন্ডনের চা সহযোগে দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে আড্ডা দিলেন ঋষভ বসু। গিটার বাজিয়ে গাইছিলেন ‘আমাকে নাও’। ‘শ্রীকান্ত’-র জীবনে এখন কী চলছে? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।

প্রশ্ন: হঠাৎ চেহারা বদলাচ্ছেন কেন বলুন তো? মাঝে তো ওজন বাড়িয়ে ভাল লাগছিল!

Advertisement

ঋষভ: অনেকেই বলছেন সেটা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছিল কাজের ক্ষেত্রে। পরিচালকরা সমানে বলে যাচ্ছিলেন, আমার চেহারা বাঙালিদের মতো নয়, সিনেমায় বাকিদের সঙ্গে বেখাপ্পা লাগে। তাই একটু কমের মধ্যে রাখার চেষ্টা করছি। খেলাধুলো বাড়িয়েছি খাওয়া কমিয়ে।

প্রশ্ন: ‘শ্রীকান্ত’ দিয়ে শুরু, তার পর ‘ভটভটি’, ‘মহাভারত মার্ডার্স’, ‘টুরু লভ’ পেরিয়ে এখন বাংলার শার্লকলক্ষ্য কি বলিউড?

ঋষভ: বলিউডে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছে নেই। যেমন আসবে, তেমন করতে থাকব। একটা তেলুগু ছবি করলাম, ওড়িয়া ছবিতেও কাজ করলাম। বলিউডের একটা বড় কাজ হয়তো আসবে ওটিটিতে। খুব বিস্তারিত বলছি না এখনই। বাংলাতেও তিনটি কাজের কথা চলছে।

Tollywood actor Rishav Basu speaks about his acting career

কোথাও গেলে এখনও লোকে তাঁকে ‘শ্রীকান্ত’ই বলে, সেলফি তুলতে চায়। ছবি: সংগৃহীত।

প্রশ্ন: ব্যোমকেশ, ফেলুদার বাজারে হঠাৎ বিলিতি মুখ শার্লকের! দর্শক কতটা নেবেন বলে মনে হয়?

ঋষভ: এই মুহূর্তে বাংলায় গোয়েন্দা চরিত্ররা একটু সিরিয়াস। গায়ের উপর চাদর জড়িয়ে সিগারেটে টান দিতে দিতে রহস্যের সমাধান করে ফেলছে। যদিও কিছু সিনেমার ক্ষেত্রে শুনছি, দর্শক আগেই কেস সল্‌ভ করে ফেলছেন, গোয়েন্দা দু’ঘণ্টা পরে করছেন। সেখান থেকে শার্লক একেবারেই আলাদা। অফবিট, মুডি। সেটা করতে আমি মজা পেয়েছি। তবে ফেলুদা, ব্যোমকেশকে নিয়ে সিনেমা হিট হতেই থাকে। শার্লকের ঝুঁকিটা এই যে, সে বাঙালি নয়, ব্রিটিশ। যদিও বিশ্বব্যাপী আবেদন আছে তার। আমরা চেষ্টা করেছি বাংলায় গোয়েন্দা চরিত্র যেমন হচ্ছে, তার বাইরে যেতে। এটায় প্রচুর ফাইট সিকোয়েন্স আছে। বাঙালি গোয়েন্দা গল্পে যেটা খুব বেশি নেই।

প্রশ্ন: বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে মিল পাচ্ছেন?

ঋষভ: (হেসে) চুলের মিল খানিক আছে। যাঁরা ‘বিবিসি’র শার্লক দেখেছেন, তাঁরা সকলেই কাম্বারব্যাচের ভক্ত। তবে আমি যে চরিত্রটা করছি ‘সরলাক্ষ হোমস’-এ, সেটা একেবারেই আলাদা। পাইপ নয়, এই শার্লক অন্য কিছু খায়। রাজশেখর বসুর একটা গল্পে শার্লকের এক ভক্তের নাম ছিল সরলাক্ষ হোম। সে ছদ্মনামে রহস্যের সমাধান করত। আমাদের গল্পে রাজশেখর বসুকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। এ গল্পে শার্লক অর্ধেক বাঙালি, অর্ধেক ব্রিটিশ। তার জন্ম, বেড়ে ওঠা কলকাতায়। এই ভাবনা চিত্রনাট্যকার পদ্মনাভ দাশগুপ্তর। সরলাক্ষের বাবার নাম এই ছবিতে রাজশেখর।

প্রশ্ন: ‘শ্রীকান্ত’ সিরিজ়ে আপনাকে ব্যর্থ প্রেমিকের ভূমিকায় আশ্চর্য মানিয়েছিল...

ঋষভ: ‘শ্রীকান্ত’ করার সময় আমাকে খুব একটা অভিনয় করতে হয়নি। পরিচালকও বলেছিলেন, ‘‘তুই যে রকম, আমার ঠিক সেটাই চাই।’’ কাজ করার সময় বুঝতে পারিনি, পরে দেখতে গিয়ে বুঝলাম, আমার জীবনেরই প্রতিফলন এটা। আর আমার ভিতরে একটা শিশুসুলভ ব্যাপার এখনও রয়ে গেছে। খুব পরিণত হয়েছি বলে মনে হয় না। শার্লক দেখলেও সেটা বোঝা যাবে। সেখানেও ওই শিশুমনের প্রকাশ আছে।

প্রশ্ন: ব্যক্তিজীবনে আপনি দেবদাস না বিন্দাস?

ঋষভ: এমনিতে বিন্দাসই! জীবনের কোনও পর্যায়ে হয়তো ‘দেবদাস মাইনাস দ্য অ্যালকোহল’! যে হেতু একা থাকি, মাঝেমধ্যে কাজ না থাকলে একাকিত্ব গ্রাস করে। তবে, সেটাকে কাটানোর জন্য সিনেমা দেখি, বই পড়ি। অসুবিধা হয় না।

Tollywood actor Rishav Basu speaks about his acting career

অনুরাগ কাশ্যপ একমাত্র পরিচালক, যাঁকে ঋষভ নিজে বলেছেন তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চান। ছবি: সংগৃহীত।

প্রশ্ন: কাজের চেয়ে বেশি আপনার প্রেম নিয়ে চর্চা হয়। আক্ষেপ হয় না?

ঋষভ: জানি না সত্যিই, কেন এমনটা হয়। এটা কি ‘শ্রীকান্ত’ করার জন্য, না কি এমনিই, কে জানে! আমার মনে হয়, মিডিয়া এটা চায়, কৌতূহলী লোকজন এটা পড়ে বেশি। ইন্ডাস্ট্রির সকলের ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বেশি চর্চা হয়। আমার জীবন নিয়ে বেশি জল্পনা হয়, কারণ বন্ধুবান্ধব নিয়ে আমার একটা অন্য জগৎ আছে। আমার ব্যক্তিগত জীবনটা একদম নিজের মতো। সেটার সঙ্গে ইন্ড্রাস্ট্রির কোনও সম্পর্ক নেই। আমি ইন্ডাস্ট্রির কোনও বিশেষ গোষ্ঠীর অংশও নই। প্রথম দিকে এ সব খারাপ লাগত। এখন মজা পাই। অন্তত, আমায় নিয়ে চর্চা তো হয়!

প্রশ্ন: এগুলো সবই তো শিল্পীজীবনের অংশ। আপনি কি বরাবরই অভিনেতা হতে চেয়েছিলেন?

ঋষভ: আমি মনেপ্রাণে ফুটবলার হতে চেয়েছিলাম। খেলেওছি ফার্স্ট ডিভিশনে। কিন্তু চোট লাগল। খেলা বন্ধ হয়ে গেল। মধ্যবিত্ত পরিবারের কিছু চাপও ছিল। আমি চাইতাম এমন কিছু করতে, যাতে লোকে চিনবে, আবার খুব বেশি লেখাপড়াও করতে হবে না। রেডিয়ো জকি হতে চেয়েছিলাম একটা সময়। ভাল কথা বলতে পারতাম। একটা চ্যানেলে গিয়েছিলাম ইন্টারভিউ দিতে। তখন আমি ক্লাস টুয়েলভে পড়ি। আমার বয়স শোনার পর ওখানে শেষ অবধি হয়নি। তবে শিশু দিবসে আলাদা শো করতে দিয়েছিল। তার পর রেডিয়ো জকি রাকেশদার পরামর্শে আমি মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়তে যাই, জেভিয়ার্সে পড়তাম। সেখান থেকে এ পথ-সে পথ ঘুরে এসে পড়ি থিয়েটারে। থিয়েটারে ব্যাকস্টেজে কাজ করেছি, বড় অভিনেতাদের চা-ও দিয়েছি। সেখান থেকে কোরাস, লিড কোরাস, একটু বড় পার্ট। ধীরে ধীরে আরও একটু বড় কাজ। বুঝলাম, এটা ভালবেসে ফেলেছি।

প্রশ্ন: পাকাপাকি ভাবে সিরিয়ালে অভিনয় করতে চাননি কখনও?

ঋষভ: থিয়েটারে এত জড়িয়ে ছিলাম যে, সিরিয়ালের প্রস্তাব অনেক ফিরিয়ে দিয়েছি। সিরিয়ালে ওই একই সংলাপ রোজ বলা, সকাল থেকে সন্ধে অবধি বসে থাকা— ভাল লাগত না। ওই প্রক্রিয়ার মধ্যে কাজ করতে দমবন্ধ লাগত। অল্প বয়সে নানা আদর্শও ছিল। এখন ভাবি, প্রথমেই কোনও সিরিয়ালে নায়ক হয়ে গেলে শিল্পী হিসাবে আমার উত্তরণটা হত না। আমি যে ধাপে ধাপে এগিয়েছি, সেটা হত না।

প্রশ্ন: কবে বুঝলেন বিখ্যাত হয়ে গিয়েছেন?

ঋষভ: আমি এখনও মনে করি না যে আমি বিখ্যাত। রাস্তা দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াই। তবে কোথাও গেলে এখন লোকে ‘শ্রীকান্ত’ বলে চিনতে পারে। বিশেষ করে এই প্রজন্মের অনেকে সেলফি তুলতে চায়, এই আর কী! এখন বোধ হয় সেলফি তুলতে চাওয়াটাই বিখ্যাত হওয়ার মাপকাঠি।

প্রশ্ন: কোন কোন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা?

ঋষভ: অনুরাগ কাশ্যপ একমাত্র পরিচালক, যাঁকে আমি নিজে গিয়ে বলেছি, “আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই।” তিনিও বলেছেন, “মুম্বই এলে আমার বাড়িতে ঘুরে যাস বেটা।” এখন রাজ আর ডিকে খুব ভাল কাজ করছেন, ওঁদের সঙ্গেও কাজ করার প্রস্তাব এলে ভাল লাগবে। তালিকায় অনেকেই আছেন।

প্রশ্ন: ‘প্রসেনজিৎ ওয়েডস ঋতুপর্ণা’তে শেষ দেখা গিয়েছিল, কিন্তু ছবি নিয়ে দর্শকের তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। মনখারাপ হয়?

ঋষভ: সিনেমার প্রচারে সে ভাবে থাকতে পারিনি। তখন লন্ডনে ছিলাম। আমি যতটা আগ্রহী ছিলাম, হয়তো নির্মাতাদের তরফে সেই সাড়া মেলেনি। আবার ছবির নামটা থেকে হয়তো অনেকের এমন একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল যে, এটা প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণার ছবি। সেখানে আমাদের দেখে ধারণা ধাক্কা খেয়েছে। এখন বাংলা ছবি চলছে মার্কেটিংয়ের জোরে। মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে আমি খুব একটা প্রচার পাইনি। সে কারণেও হয়তো সমস্যা হয়েছে। কী করে দর্শককে হলে আনতে হবে, সেটা তো আমার হাতে নেই। ছবির গুণমানের উপর ছবি চলা নির্ভর করে না।

প্রশ্ন: কেরিয়ারের গ্রাফ তো চড়চড়িয়ে উঠছে, মনের খবর কী? একাই তো কাটিয়ে দিচ্ছেন?

ঋষভ: আমরা কবিতা লিখি, কারণ আমরা মানবজাতির সদস্য। ঠিক তেমনই প্রেমে পড়ি মানুষ বলেই। আবার প্রেমে পড়লে পড়ব। সেটার মধ্যে একটা ম্যাজিক আছে। বিচ্ছেদ হলে হবে। তা নিয়েও ভাবি না। প্রত্যেকটা প্রেমের আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতা হয়, সেই অভিজ্ঞতা আমি সারা জীবন ধরে বয়ে নিয়ে যেতে চাই। কিন্তু সংসারে বাঁধা পড়ার ইচ্ছা নেই।

প্রশ্ন: দশ বছর পরে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?

ঋষভ: অভিনেতা হিসাবে অবশ্যই নিজেকে আরও ভাল জায়গায় দেখতে চাই। আর মন থেকে বললে, এমন একটা জায়গায় দেখতে চাই, যখন আমি ছ’মাস কাজ করব, সেই ছ’মাসের সঞ্চিত অর্থে বাকি সময়টা নিজের মতো করে কাটাব। তিনটে মাস পাহাড়ে কাটাব। অন্য কিচ্ছু করব না! বই পড়ব, গান শুনব। বাকি তিন মাস ঘুরে বেড়াব।

আরও পড়ুন
Advertisement