Ambarish Bhattacharya Interview

প্রস্থেটিক মেকআপে চেহারা বদলাচ্ছে, অভিনয়টা তো হচ্ছে না! মান পড়ছে, মত অম্বরীশের

অভিনয় বা গান, কোনওটিই কি অম্বরীশের স্থায়ী আশ্রয়? এমন কি খাবারেও ততটা মন নেই ‘গজা’র। তিনি বিশ্বাস করেন কিছু না করায়। সেটিই যে বড় কিছু করা!

Advertisement
তিয়াস বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৩ ১০:১৩
Tollywood actor Ambarish Bhattacharya

সতেরো বছর ধরে সর্বত্র নিজের মুখ দেখতে দেখতে ক্লান্তি এসে গিয়েছে অম্বরীশের। এ বার কী ভাবছেন? ছবি: সংগৃহীত।

বর্তমানে যা ভাল লাগছে, আগামী দিনে তা না-ও লাগতে পারে। এই পরিবর্তনকে স্বাভাবিক ধরে নিয়েই আলাপচারিতায় অম্বরীশ ভট্টাচার্য। আপাতত তাঁর ব্যস্ততা তুঙ্গে। শুটিংয়ের কাজে ধুলাগড়ে রয়েছেন। এর পর যাবেন বোলপুরে। মাঝে ছুঁয়ে আসবেন মুম্বই। তার ফাঁকেই টেলিফোনে ধরা দিলেন আনন্দবাজার অনলাইনে। জানালেন, কম খাচ্ছেন। কিসের প্রস্তুতি এখন জীবনে?

প্রশ্ন: গোটা মাস তো ঘরছাড়া, শুটিং কেমন চলছে?

Advertisement

অম্বরীশ: খুব চাপ চলছে। শুটিংয়ের জন্য এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। একসঙ্গে অনেকগুলো ছবির কাজ চলছে। শিবপ্রসাদ-নন্দিতা রায়ের ‘রক্তবীজ’ ছবির কাজ চলছে। কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’ ছবিতেও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র করছি। সে ছবির কাজেও ঘুরতে হচ্ছে। মুম্বইয়ের একটা ওয়েব সিরিজ়ের কাজেও যেতে হয় মাঝেমধ্যে, এর বেশি ওটা নিয়ে বলব না।

প্রশ্ন: শোনা যাচ্ছে, নতুন প্রেম করছেন? এই শিডিউলে অসুবিধা হচ্ছে না?

অম্বরীশ: প্রেম তো একটা ভাবনা। প্রেম আসে-যায়। আমি কনসিসট্যান্ট প্রেমিক নই, জীবনের কোনও কিছুতেই কনসিসট্যান্ট নই।

Tollywood actor Ambarish Bhattacharya

প্রশ্ন: অভিনয়ের ক্ষেত্রেও না?

অম্বরীশ: নাহ্! মাঝেমধ্যে মনে হয়, অভিনয় করব না আর।

প্রশ্ন: খুব কি একঘেয়ে লাগছে?

অম্বরীশ: হ্যাঁ। নিজেকে অতিরিক্ত ব্যবহৃত মনে হয়। গত সতেরো বছর ধরে সব জায়গায় যাকে দেখা গিয়েছে, এমন একটা মুখ। ক্লান্তিকর লাগে। তাই মনে হয়, এই প্রাতিষ্ঠানিক অভিনয় কিছু দিন বন্ধ করে শিকড়ে ফিরতে পারলে আমার অভিনয়েও কিছু বদল আনতে পারব।

প্রশ্ন: দীর্ঘ সময় ধরে একের পর এক মেগা সিরিয়ালে কাজ করেই এই পরিস্থিতি?

অম্বরীশ: ভাল ছবির কাজ তো সব সময় আসেনি। আমি যে হেতু অভিনয় ছাড়া আর অন্য কিছু করিনি, তাই মেগা করতে হয়েছে রোজগারের তাগিদেই। তবে সিরিয়ালে কাজ করলে এক ধরনের অনুশীলন হয়। অভিনয়ের অভ্যাস বজায় থাকে। হয়তো কনটেন্ট একেবারে পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়, যে সংলাপ বলছি সেটা বিশ্বাসও করছি না, কিন্তু চরিত্রটা তো হয়ে উঠতে হয়।

Tollywood actor Ambarish Bhattacharya

থিয়েটারের গানের প্রতি অম্বরীশের আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছিলেন অভিনেত্রী কেতকী দত্ত। ছবি: সংগৃহীত।

প্রশ্ন: আপনি থিয়েটারে গান গেয়েছেন এবং শিখিয়েওছেন। সোহিনী সেনগুপ্তের সঙ্গে আপনার জুটি তৈরি হল কী করে?

অম্বরীশ: থিয়েটারের গানের প্রতি আগ্রহ কেতকীদিই তৈরি করে দিয়েছিলেন। উনি চলে যাওয়ার পর থিয়েটারের গানের ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা, গবেষণা শুরু করি। আমি একশোরও বেশি গান জানি থিয়েটারের। সেই ১৮৩৫ থেকে শুরু করে গ্রুপ থিয়েটারের আমল পর্যন্ত। সোহিনীকে আমি চিনতাম মঞ্চের শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসাবে। কিন্তু আলাপ ছিল না। ‘খড়কুটো’ ধারাবাহিক করতে গিয়ে আলাপ হয়। আউটডোরে কথাপ্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম, অনুষ্ঠান করতে পারি, যদি সোহিনীও সঙ্গে গাইতে রাজি থাকে, আর যদি নান্দীকারের সহযোগিতা পাই। এ ভাবেই শুরু। তিনটে অনুষ্ঠান হয়েছে, সবগুলোই হাউসফুল।

প্রশ্ন: থিয়েটারে গান গাইছেন কিন্তু অভিনয়ে ফিরতে ইচ্ছে করে না?

অম্বরীশ: ২০১৩ সালে শেষ মঞ্চে অভিনয়। এখন আর সময়ের অভাবে করতে পারি না। পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রোডাকশনে কাজ করতে বলেছিলেন সম্প্রতি। সময় বার করতে পারিনি। রিহার্সালের জন্য যে ডেটগুলো চেয়েছিলেন, একটাও ফাঁকা ছিল না। আসলে অন্য কিছুর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে থিয়েটার করতে পারব না। অন্য কাজ ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর থিয়েটার করতে হবে।

প্রশ্ন: কোনও ছবির বা সিরিজ়ের মুখ্য ভূমিকায় নিজেকে দেখার স্বপ্ন নেই?

অম্বরীশ: যদি কোনও পরিচালক, প্রযোজক ভাবেন কখনও, বেশ মজা হবে। চেষ্টা করব ভাল করে কাজ করতে। কিন্তু যোগ্যতার চেয়ে বেশি পেয়েছি বলে আমার আর স্বপ্ন নেই কিছু। না হলেও আফসোস থাকবে না।

প্রশ্ন: চরিত্রের প্রয়োজনে কখনও ওজন কমাতে হলে রাজি হবেন?

অম্বরীশ: নিশ্চয়ই। করছিও তো। একটা বড় কাজের জন্য আমাকে বেশ কিছুটা ওজন ঝরাতে হচ্ছে। সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছি। যদিও চরিত্র নির্মাণে এই বদলগুলো খুব একটা সাহায্য করে বলে আমি মনে করি না। আমার ধারণা, অভিনয় যথাযথ হলে ‘লুক’ খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয় না। চরিত্রটাকে অভিনয় দিয়ে ফুটিয়ে তোলাটা আমার কাছে বেশি জরুরি।

প্রশ্ন: তা হলে যে এখন প্রস্থেটিক মেকআপের এত জয়জয়কার?

অম্বরীশ: অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দেখছি প্রস্থেটিক মেকআপ করে চেহারা বদলাতে। কিন্তু অভিনয়টা তাঁরা বদলাতে পারেননি। অথচ আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে বহিরঙ্গের বদলের দিকেই নজর বেশি। বাইরের চমকটা পাঁচ মিনিটের বেশি মনে রাখেন না দর্শক। অন্তরঙ্গের বদলটাই তাঁদের টানে। কিন্তু টলিউডে ইদানীং চ‌েহারা বদলটাই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। কী পড়া দরকার, কী ভাবা দরকার, এ সব নিয়ে কেউ ভাবে না। আমার মনে হয়, অভিনয়ের ‘প্রস্থিটিকেশন’ হলে এর চেয়ে অনেক ভাল হত।

প্রশ্ন: স্বপ্ন ছিল অভিনেতা হবেন, তার সঙ্গে উপরি জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন। তবুও কি কোথাও আক্ষেপ রয়ে গিয়েছে?

অম্বরীশ: বিরাট কিছু আকাঙ্ক্ষা আমার ছিল না, কপালজোরে নাম করে গিয়েছি, মানুষের ভালবাসা পেয়েছি। আক্ষেপ নেই কোনও। আমি অন্তর থেকে নিজেকে একজন মাঝারি মানের অভিনেতা বলে মনে করি। আমার থেকে হাজার গুণ ভাল বহু অভিনেতার ভাগ্য সহায়ক হয়নি বলে তাঁদের চেনেন না কেউ। আমি এক জন নির্ভরযোগ্য পেশাদার অভিনেতা। ভাল পরিচালকের হাতে পড়লে হয়তো কখনও ভাল অভিনয় করতে পারি। ঋত্বিক, অনির্বাণ বা ঋদ্ধির মতো প্রশিক্ষিত অভিনেতা আমি নই। তবুও অবাক লাগে ভাবতে, কলকাতার সব পরিচালকের সঙ্গেই আমি কাজ করেছি।

প্রশ্ন: ইদানীং অভিনয় জগতে ছায়া ফেলছে দুর্নীতিইন্ডাস্ট্রিতে দেখনদারির প্রতিযোগিতা কি অতিরিক্ত চাপ তৈরি হচ্ছে?

অম্বরীশ: খোলাবাজার তো ক্রমাগত আমাদের লোভ দেখাচ্ছে। শিক্ষা আমাদের গ্রহণ-বর্জনের বোধটা এনে দেয়। শিক্ষার মানও তো পড়ে গিয়েছে সারা দেশে, গোটা পৃথিবীতেই।

Tollywood actor Ambarish Bhattacharya

ছবি- সংগৃহীত

প্রশ্ন: তা হলে কি ইন্ডাস্ট্রিতে অশিক্ষিত তারকার সংখ্যা বাড়ছে?

অম্বরীশ: খোলাবাজারে তো আর আইকন থাকে না। অভিনেতার সেই ভগবানতুল্য জায়গাটা আর নেই। প্রকাশ্যে তাঁদের সব কিছু। আগে লোকে জানতই না, উত্তমকুমার বাড়িতে কী ভাবে থাকেন। আইকন হতে গেলে এই আড়ালটা দরকার হয়। সে আড়াল আর নেই আজ। শোয়ার ঘরে ঢুকে গিয়েছে সব। সাধারণ মানুষের কিছু নেওয়ারও নেই তাঁদের থেকে। মুম্বইতে আয়ুষ্মান খুরানার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, ওরা বুঝে গিয়েছে, স্টারদের দিন শেষ। ওরা সহজ ভাবে মিশছে, যেখানে-সেখানে বসে পড়ছে। ওরা জানে খাটতে হবে, ভাল অভিনয় করে টিকে থাকতে হবে। এখন আমরা চাইলেই কোরিয়ান ওয়েব সিরিজ় দেখতে পারি, বিশ্বের যে কোনও প্রান্তের ছবি দেখতে পারি । তুলনার জায়গাটা বড় হয়ে গিয়েছে। স্টারডম দিয়ে আর কিচ্ছু হবে না।

প্রশ্ন: পেশাদার অভিনেতা হয়েও কোনও আদর্শে স্থির থাকা কি জরুরি বলে মনে হয়?

অম্বরীশ: এটা নির্ভর করে মানুষের উপর। আদর্শবান অভিনেতা এখনও আছেন। আগেও ছিলেন। আদর্শহীন অভিনেতাও ছিলেন কিন্তু। তখন একটা রাখঢাক ছিল। এখন সেটা নেই বলে কে আদর্শবান, কে আদর্শহীন, সেটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে আরও। তবে, এতে সাধারণ মানুষ আর প্রভাবিত হন না। সময়টা বদলে গিয়েছে একেবারে। সবাই এত ব্যস্ত, এত অস্থির। রাস্তায় প্রত্যেককে দেখি ফোনে ব্যস্ত। তারা আকাশ দেখে না, পাশের মানুষটাকে দেখে না। মানুষে-মানুষে সংযোগ কমে আসছে।

প্রশ্ন: রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা নেই?

অম্বরীশ: রাজনীতিটা শিখতে হয়। এখন এক জন রাজনীতিবিদ হঠাৎ অভিনয় করতে এলে আমি তো বিদ্রুপ করব তাঁকে নিয়ে। আমি রাজনীতিতে গেলেও লোকে সেটাই করবে। ভোটে দাঁড়ালে হয়তো জিতে যাব। কিন্তু সেটা সত্যি জেতা হবে না। আর আমি মনে করি, মানুষের ভাল করতে চাইলে আরও অনেক পথ আছে। আমার কোনও যোগ্যতাই নেই রাজনীতি করার।

আরও পড়ুন
Advertisement