‘শেরনী’-তে বিদ্যা বালন
জঙ্গলে গেলে আমরা জঙ্গলকে দেখতে পাই না, কিন্তু জঙ্গল আমাদের দেখতে পায়। অচেনা কীট-পতঙ্গের ডাক বা স্বাভাবিক উদ্ভিদের ঘনত্বের রহস্যময় আড়াল থেকে জঙ্গল দেখে মানুষের প্রকৃতি জয়ের মূর্খ দম্ভ। প্রকৃতি ও মানুষের আদি অকৃত্রিম এই দ্বন্দ্ব হল অমিত মাসুরকরের নতুন ছবি 'শেরনী'-র পটভূমি, যার মুখ্য চরিত্র বিদ্যা ভিনসেন্টের ভূমিকায় স্বয়ং বিদ্যা বালন।
নাম শুনে এবং নারীকেন্দ্রিক ছবিতে বলিউডের গতানুগতিক ধারার ইতিহাস দেখলে মনে হতেই পারে, এ ছবির শেষে লম্ফঝম্প এবং দুর্ধর্ষ সংলাপের মাধ্যমে মারপিটে সিদ্ধহস্ত নায়কের মতোই ভিলেন পিটিয়ে নায়িকা বিদ্যার উত্থান হবে আসল শেরনী রূপে। শেরনী বা বাঘিনীর সঙ্গে বিদ্যাকে এক স্থানে বসিয়েও, বলা যেতে পারে এক অসাধ্য সাধন করেছেন মাসুরকর। কারণ এই ধরনের ক্ষেত্র নির্বাচন অনেকটা সরু তারের উপর হাঁটার মতো, একটু এদিক ওদিক হলেই একটা ছকে বাঁধা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। আশঙ্কা থাকে খুব স্থূল ভাবে কোনও শিক্ষামূলক বা উপদেশধর্মী ছবি তৈরি হওয়ার, যা আমাদের দেখানোর বদলে সরাসরি বলে দেয় অনেক কিছু। কিন্তু পরিবেশের সংকট এবং পাশাপশি পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় একজন মেয়ের কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকার লড়াইয়ের মতো সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজ করেও মাসুরকর বলিউডি ছকের ফাঁদ এড়াতে পেরেছেন অনেকটাই, ওঁর আগের ছবি ‘নিউটন’-এর মতোই।
ছবির গল্প ভীষণ জটিল কিছু নয়, বরং ট্রেলার থেকেই তা আন্দাজ করা যায়। টি১২ নামের এক মানুষখেকো বাঘিনীর উৎপাতে অতিষ্ঠ জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামের মানুষ। এবং এই বাঘিনী ধরার অভিযান নিয়েই ছবির গল্প। বনবিভাগের নতুন ডিএফও বিদ্যা। স্বচ্ছ, দুর্নীতি-বিরোধী, চটপটে এবং কর্মঠ এক জন আধিকারিক। বিভাগের উপরতলা থেকে নীচতলা একেই দুর্নীতিগ্রস্ত, তার উপর অনেকাংশে পুরুষশাসিত। এ হেন অবস্থায় সততা বজায় রাখা বিদ্যার কাছে এক প্রকারের সংগ্রাম, বিশেষ করে তার নারী আত্মপরিচয়ের জন্য। আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষিতে বাঘের হাতে প্রাণহানির ঘটনা অবশ্যম্ভাবী রূপে হয়ে পড়ে রাজনীতির বিষয়। বিদ্যার বসের (ব্রিজেন্দ্র কালা) প্রশ্রয়ে এবং রাজনৈতিক দলনেতার ইন্ধনে বাঘিনীকে ধরার সম্পূর্ণ দায়িত্বই সরকারি বনবিভাগের হাত থেকে চলে যায় এক প্রাইভেট শিকারির কাছে, শিকারের পৈশাচিক উল্লাসে নিজের কর্তৃত্ব ফলানোই যার একমাত্র তৃপ্তি। টি১২-কে জীবিত অবস্থায় ধরার কাজে বিদ্যাকে একমাত্র সাহায্য করে যায় এক সহৃদয় অধ্যাপক নুরানী (বিজয় রাজ)।
মাসুরকর বার বার ছবিতে রেখে যান তাঁর সূক্ষ্মতাবোধের পরিচয়, এ হেন জটিল ও বহুমাত্রিক সমস্যার চিত্রায়ণে তাঁর পরিমিতি বোধ, বাস্তবের সঙ্গে সংযোগ এবং শিল্পবোধ। ছবির প্রথম দৃশ্যে আউট অফ ফোকাস ক্যামেরায় ধরা দেয় এক অস্পষ্ট অবয়ব, জঙ্গলের অন্যান্য শব্দ ও বাঘের ডাকের সঙ্গে মিলে যা দেখে আন্দাজে কোনও বাঘই মনে হয়। ফোকাসের সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায়, এই ডাকটি আসলে এক জন মানুষের— বনবিভাগের এক কর্মীর, যিনি ক্যামেরার অবস্থান পরীক্ষার জন্য বাঘের অভিনয় করছিলেন। ছবিতে বার বার ফিরে আসে এমন সব দৃশ্য, যেখানে মাসুরকর পরোক্ষ ভাবে উল্টে দিচ্ছেন পাশবিকতা ও মানবিকতার চেনা রূপ, শিকারি ও শিকারের সমীকরণ, সূক্ষ্ম চিত্রনির্মাণের মাধ্যমে। মদ্যপ অবস্থায় আগুনের চারপাশে গোল হয়ে অনেকের পশুর ডাক নকল করার দৃশ্যে (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই দৃশ্যে উপস্থিত সব চরিত্রই পুরুষ), বা মিটিংয়ের দৃশ্যে, যেখানে দেওয়ালে ঝোলানো ট্রোফির সামনে বিদ্যার বসের মুখ দেখে মনে হয়, যেন তার মাথাতেই রয়েছে দুটো শিং-- আশ্চর্য ভাবে মিলে যায় প্রকৃতি ও সভ্যতা এবং নারী ও পুরুষের দ্বন্দ্ব।
এই ছবির ‘শেরনী’ নিঃসন্দেহে বিদ্যা বালন। তাঁর মার্জিত অভিনয় মুগ্ধতার ছাপ রেখে যায় গোটা ছবি জুড়েই। গর্জন নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে নিঃশব্দে তিনি শুনিয়ে দেন তাঁর প্রতিবাদের ভাষা, তাঁর বহুমুখী লড়াইয়ের ভাষ্য। পার্শ্বচরিত্রে সকলেই নজরকাড়া। দুর্বলচিত্ত এবং লোভী বসের ভূমিকায় ব্রিজেন্দ্র কালার অভিনয় মনে থেকে যায়, মনে থেকে যায় নুরানীর ভূমিকায় বিজয় রাজ এবং কাঠখোট্টা শিকারির ভূমিকায় শরৎ সাক্সেনাকে। নীরজ কবি তার স্বভাবসিদ্ধ ঢংয়ে ভাল, কিন্তু নিজেকে প্রমাণের বিশেষ জায়গা তিনি এখানে পাননি। তবে, বিদ্যা এ ছবির শেরনী হলেও, তিনি হয়তো একমাত্র শেরনী নন। গ্রামের ঠোঁটকাটা মেয়ে জ্যোতির চরিত্রে শম্পা মণ্ডল এ ছবির চমক। বিদ্যার প্রতিবাদের ভঙ্গী যদি হয় শান্ত, স্থির— শম্পার প্রতিবাদে সত্যিই শোনা যায় বাঘিনীর গর্জন।
ক্যামেরা কখনও ড্রোন শট, এক্সট্রিম লং শট, বা ক্লোজ আপে; কখনো স্থির ফ্রেমে আবার কখনো প্যানিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে ধরেছে জঙ্গলের অদ্ভুত রহস্যময়তা। রাকেশ হরিদাসের দক্ষ চিত্রগ্রহণে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের পাশাপাশি ধরা পড়েছে প্রকৃতির পাশে মানুষের অসহায়তা, তার ক্ষুদ্রতা। অনীশ জোনির শব্দগ্রহণে জঙ্গলের নিজস্ব ছন্দ আর ধ্বনি শোনা যায়, তবে তা অনেক ক্ষেত্রে ঢাকা পড়ে যায় ছবির আবহসঙ্গীতে— যা অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দের সঙ্গে বেমানান। তবে ময়ূর নর্ভেকরের সুরে ছবিতে ব্যবহৃত একটি মাত্র গান ভাল লাগে। আস্থা টিকুর চিত্রনাট্য যথাযথ, পরিণত, কিন্তু একটু দীর্ঘায়িত মনে হয়। যার ফলে ধৈর্যচ্যুতির সম্ভাবনা থেকে যায়।
পরিবেশের উপর মানবসভ্যতার আগ্রাসন, আর নারীর উপর পুরুষতন্ত্রের— এই দুই শোষণকে একই সারিতে ফেলে দেখানো সম্ভবত মাসুরকরের ছবির সবচেয়ে সার্থক কৃতিত্ব। দুইই আসলে এক ধরনের ক্ষমতা প্রদর্শনের তথা ‘শিকার’-এর উদযাপন, যার কেন্দ্রে মানুষ, বিশেষ করে পুরুষ, নিজেকে বসাতে চায়। 'শেরনী' কেবল এই দ্বন্দ্বের উন্মোচন করে না, পাশাপাশি আলোকপাত করে আরও অনেক সমস্যার— পরিবেশের ভারসাম্যের বিনাশ, সরকারি কাজে রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ ও মুনাফা লাভ, বনাঞ্চলের অধিবাসীদের অধিকারহরণ— যার দ্বারা দর্শক সাদা-কালোর অন্তরালে ভিতরের ধূসর স্তরগুলিও দেখতে পান। এইখানেই এই ছবির সার্থকতা।