‘টুয়েলভ্থ ফেল’ ছবির পোস্টারে বিক্রান্ত ম্যাসি। ছবি: সংগৃহীত।
শেফালি শাহ লিখেছেন, ‘থ্রি অফ আস’ ছবিটা সিনেমাহলে মুক্তি পেয়েছিল। কেউ দেখেননি। কিন্তু নেটফ্লিক্সে ছবিটা মুক্তি পাওয়ার পর দেশ জুড়ে সাড়া পড়েছে। যা থেকে আমাদের এই বিশ্বাসটা জন্মাচ্ছে যে, কাজটা আমরা খারাপ করিনি।’
ডিজ়নি হটস্টারের বড়কর্তা গৌরব বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘টুয়েলভ্থ ফেলের সাফল্য অভূতপূর্ব! আমাদের প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়ার পর তিন দিনের মধ্যে সারা বছরে ডিজ়নি হটস্টারে সর্বোচ্চ দেখা ছবি হয়েছে টুয়েলভ্থ ফেল।’’
২০২৩ সালের শেষে এসে এই দু’টি ছবি দ্বিধাহীন ভাবে প্রমাণ করেছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ‘শক্তি’। প্রমাণ করেছে, প্রেক্ষাগৃহে মাঝারি সাইজের সাফল্য বা অসাফল্যের কাহিনি পুরোপুরি উল্টে দিতে পারে এই মাধ্যম। অমিতাভ বচ্চন থেকে মিমি চক্রবর্তী— মানেন সে কথা।
অমিতাভের ‘গুলাবো সিতাবো’ ওটিটি-তেই মুক্তি পেয়েছিল। আর মিমির ওয়েব সিরিজ়ে অভিষেক হচ্ছে ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’ দিয়ে। যিনি বলছেন, ‘‘আমি ওটিটি নিয়ে এত দিন বেশ নার্ভাস ছিলাম। কারণ এটা এমন একটা মাধ্যম, যা দর্শকের বেডরুমে ঢুকে যায়। আমার অভিনয় পছন্দ না হলে সহজেই আমায় স্কিপ করে চলে যাওয়া যাবে। তবে এটা জানি যে, ওটিটি-ই ভবিষ্যৎ। যদি দেশবিদেশের লোক আমার কাজ সহজে দেখতে পান, তা হলে তো ভালই।’’ ওটিটি এক জন অভিনেতার জন্য কতটা লাভজনক হতে পারে, তা বুঝেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ও। ‘সাংহাই’-এর মতো ছবি দিয়ে তিনি বলিউডে পা রেখেছিলেন বহু আগে। কিন্তু বিক্রমাদিত্য মোটওয়ানের ‘জুবিলি’-র সাফল্যের পর মু্ম্বইয়ে নতুন করে তাঁর ‘কদর’ বেড়েছে। যেমন কোভিডের সময়ে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় রবিনা টন্ডনের সঙ্গে ‘আরণ্যক’-এর মতো ওটিটি সিরি়জ়ে অভিনয় করে মুম্বইয়ে জমি শক্ত করতে পেরেছেন।
ওটিটি যেমন অভিনেতাদের আরও বেশি সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, তেমনই অর্থকরী দিক দিয়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত করছে প্রযোজকদের। ওটিটি থেকে অন্তত প্রাথমিক বিনিয়োগের অর্থ ফিরে পাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা থাকে।
সেই জন্যই কি দেশে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ওটিটি মঞ্চের সংখ্যা? ১১ বছর আগে, ২০১২ সালে ভারতে মাত্র দু’টি ওটিটি (ওভার দ্য টপ) মঞ্চ ছিল। ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা পৌঁছেছে ৪০-এ। অ্যামাজ়ন প্রাইম ভিডিয়ো, ডিজ়নি প্লাস হটস্টার, নেটফ্লিক্স, জ়ি ফাইভ এবং সোনি লিভ তাদের মধ্যে অন্যতম। গত পাঁচ-ছয় বছরে, বিশেষত অতিমারির সময়ে এই ওটিটি মঞ্চগুলিতে ‘ওয়াচ টাইম’ হু-হু করে বেড়েছে।
একটি ছবির বক্স অফিসের সাফল্য আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না। তাই এখন কোনও ছবি হল-এ মুক্তি পাওয়ার আগেই প্রযোজকরা দৌড়ন সেই ছবির ‘ওটিটি স্বত্ব’ বিক্রি করতে। বক্স অফিসে সফল ছবির ক্ষেত্রে ওটিটি-র যত না ভূমিকা, ব্যর্থ ছবির ক্ষেত্রে তার চেয়ে অনেক বেশি। ‘টাইগার ৩’ বা ‘কিসি কা ভাই, কিসি কি জান’-এর মতো বড় বাজেটের ছবি বক্স অফিসে প্রত্যাশিত ফল করেনি। এই ছবিগুলির প্রযোজকদের কাছে ঘরে টাকা ফেরানোর একমাত্র ভরসা ওটিটি স্বত্বের অর্থ। বাংলার মতো ‘আঞ্চলিক’ ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে ওটিটি-র এই ভূমিকা তো আরও বড়! বহু ছবি, যা হল-এ মুক্তি পাওয়ার পর একদম চলে না, সেগুলিও ওটিটি-তে মুক্তি পেলে বহু দর্শক দ্রুত দেখে ফেলেন। ‘টুয়েলভ্থ ফেল’ বা ‘থ্রি অফ আস’-এর মতো এমন উদাহরণ বাংলার ক্ষেত্রেও রয়েছে। যেমন পরমব্রতের ‘বৌদি ক্যান্টিন’, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অভিনীত ‘দত্তা’, এমনকি, ইন্ডাস্ট্রির ‘ফার্স্ট বয়’ সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘এক্স=প্রেম’।
দর্শক কি তা হলে এখন ওটিটি-তেই ছবি দেখতে বেশি স্বচ্ছন্দ?
‘ফড়িং’, ‘মায়ার জঞ্জাল’-এর পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী মেনে নিলেন, তিনি যে ধরনের ছবি বানান, তা দেখতে কিছু দর্শক নন্দনে যেতে পারেন। কিন্তু মাল্টিপ্লেক্সে যাবেন না। তাঁর কথায়, ‘‘কয়েক বছর আগেও অপর্ণা সেন বা গৌতম ঘোষের ছবি দেখতে বাঙালি সিনেমা হল-এ যেত। কিন্তু এখন তারা ওটিটি মুক্তির জন্যই অপেক্ষা করে। অনুরাগ কাশ্যপ বলিউডে নিজের জায়গা হারিয়েছেন। হনসল মেহতা, বিক্রমাদিত্য মোটওয়ানেদের এখন ওটিটি-র জন্যই ছবি তৈরি করতে হচ্ছে।’’ দর্শক যে আরও বেশি ‘মোবাইলমুখী’ হয়ে যাচ্ছেন, তা মেনে নিচ্ছেন সুমন ঘোষ, অতনু রায়চৌধুরী, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকেরাও।
ইদানীং প্রচলিত ধারণা, ‘স্পেক্টাক্ল’ তৈরি না করতে পারলে দর্শককে হল-এ নিয়ে আসা যাচ্ছে না। সুপারহিরো ফিল্ম বা ‘পাঠান’-এর মতো অ্যাকশন ছবি না-হলে দর্শক মাল্টিপ্লেক্সের টিকিট কাটবেন না। সব ছবির ক্ষেত্রে তাঁরা গড়ে ৩৫০ টাকা খরচ করতে রাজি নন। ওটিটি এসে যাওয়ায় সিনেমা হল সম্পর্কে একটা ‘অনীহা’ও তৈরি হয়েছে। যাঁরা ফোনে বা ল্যাপটপে বা বাড়ির টেলিভিশনে সিনেমা দেখতে অস্বচ্ছন্দ নন, তাঁরা সাধারণত হল-এ যেতে চান না। ওটিটি-তে কোনও ছবি নিজের ইচ্ছে মতো, সময় মতো, পছন্দ মতো জিনিস দেখা যায়। মাঝপথে ছবি থামিয়ে রাখা যায়। দেখতে না চাইলে আঙুলের ছোঁয়ায় ‘অসহ্য’ দৃশ্য এড়িয়ে যাওয়া যায়।
সুজয় ঘোষের ‘জানে জান’, অর্জুন সিংহের ‘খো গ্যয়ে হম কহাঁ’, মনোজ বাজপেয়ী অভিনীত ‘সির্ফ এক বান্দা কাফি হ্যায়’-এর মতো ‘সফল’ ছবি ওটিটি-তেই প্রশংসিত হয়েছে। সিনেমা হল-এ মুক্তি পেলে কি ছবিগুলি ‘সফল’ হত? সে বিষয়ে নির্মাতারাও নিশ্চিত নন। যেমন, একগুচ্ছ তারকা-সন্তানের অভিষেক হওয়া সত্ত্বেও ‘দ্য আর্চিজ়’ নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না জ়োয়া আখতারও। তাই তাঁরা সিনেমা হল-এর চেয়ে ওটিটি-তেই বাজি রেখেছিলেন।
শেফালি শাহ বা পঙ্কজ ত্রিপাঠীর মতো অভিনেতাদের উত্থানই ওটিটি-র মাধ্যমে। সিনেমায় তাঁদের অভিনয় প্রশংসিত হলেও তাঁদের আসল পরিচিতি দিয়েছে ‘দিল্লি ফাইল্স’ বা ‘মির্জাপুর’। করিশ্মা তন্না, সুস্মিতা সেন এমনকি, ববি দেওলেরও সফল কামব্যাক হয়েছে সিরিজ়েই। আবার ‘পঞ্চায়েত’ খ্যাত জিতেন্দ্র কুমার বা ‘লিট্ল থিংস’-এর মিথিলা পলকরের আত্মপ্রকাশই ওটিটি-র মঞ্চে। ফলে প্রযোজক-পরিচালকদের পাশাপাশি অভিনেতাদের ভাগ্য ঘোরাতেও ওটিটি-র ‘শক্তি’ কাজ করে বইকি!
তবে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচালক-প্রযোজক ডিজিটাল স্বত্বের কদর বুঝেও এখনও বক্স অফিসকেই বেশি গুরুত্ব দেন। তাঁর সাফ কথা, ‘‘বাংলা দর্শকের বাজার না বাড়লে কোনও কিছুতেই লাভ নেই।’’ দিনের শেষে বক্স অফিসের ব্যবসাই আসল। তাই ‘জওয়ান’-এর ১১০০ কোটির কাছে ‘টুয়েলভ্থ ফেল’-এর ৬৬ কোটি দাঁড়াতে পারে না। এখনও। ওটিটি কি অর্থের দৌড়ে কখনও বড় পর্দাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে? নাকি থেকে যাবে ‘ভাল খেলিয়াও পরাজিতে’র দলে?