পেশার বাইরে সাধারণ জীবনযাপনেই অভ্যস্ত সুদীপ্তা চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: আরজি কর আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। পেশাগত ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে?
সুদীপ্তা: আমার গোচরে আসেনি। আমি বুঝতে পারিনি সে রকম ভাবে। সমাজমাধ্যমে অবশ্য আমাকে কটাক্ষ করা হচ্ছে। আমি নাকি প্রতিবাদ করে, আরজি কর আন্দোলনে মুখ দেখিয়ে টেলিভিশনের কাজ জোগাড় করেছি। আমি নাকি ‘দিদি নং ২’ হয়েছি। কিঞ্জলের (কিঞ্জল নন্দ) সমালোচনা করতে গিয়ে আমাকেও আক্রমণ করেছে সমাজমাধ্যমে।
তা ছাড়া, আমরা তো পাকাপাকি কোথাও চাকরি করি না। আমাদের পেশায় যা যা প্রয়োজন, তা এমনিতেই নেই আমার। যেমন, নায়িকাসুলভ চেহারা, বাজার ধরে রাখার ক্ষমতা। উল্টে আমি সোজাসুজি কথা বলে দিই। প্রতিবাদ করি, পথে নেমে আন্দোলন করি।
প্রশ্ন: রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে আবার ফিরলেন চিকিৎসক অভীক দে ও বিরূপাক্ষ বিশ্বাস। কী মত?
সুদীপ্তা: খুব হতাশাজনক। এটার অপেক্ষাতেই থাকে সকলে। জানে এক- দু’দিন বলবে তার পর যে কে সেই! অন্য দিকে, মানুষ কি সমস্ত কাজ ফেলে সারা ক্ষণ সিস্টেমকে বলে যাবে, তোমার কী করা দরকার। সিস্টেম তো সুযোগ নেবেই!
আমি আন্দোলনে একা ছিলাম না। প্রচুর মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। আমাকে অন্ধকার থেকে খুঁজে খুঁজে বার করা হয়েছে। আমি হাসলেও খবর, কাঁদলেও খবর। আমার ভাল লাগে না। আমি শুধু মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। বাড়তি কিছুই করিনি।
প্রশ্ন: আন্দোলনে যে সেলেবরা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা কাজে ফেরায় সমালোচনার মুখে পড়ছেন…
সুদীপ্তা: একটা উদাহরণ দিতে চাই। স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় পুজোর আগে যে ধরনের ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করে, এ বছর তো সে রকম কিছুই করেনি। ওর কাছে আসেনি সেই ব্র্যান্ড। ক’টা মানুষ সেই খোঁজ রাখে? ওরও ক্ষতি হল। আজ কেউ স্বীকার করবে না কিন্তু ‘টেক্কা’ নন্দনে কেন মুক্তি পেল না?
আজ কিঞ্জলকে নিয়ে এত সমালোচনা হচ্ছে। ও যদি কাউকে আগে থেকে শুটিংয়ের তারিখ দিয়ে রাখে, ও সেই শুটিংয়ে যেতে বাধ্য। এটা তো ওর পেশা। আমার বাবার মৃত্যুর তিন দিনের মাথায় আমি ‘জ্যেষ্ঠপুত্র’-এর শুটিং শুরু করেছিলাম। আমি কি বলতে পেরেছিলাম, এখন আমি শোক পালন করছি। ১৫ দিন পরে শুটিং করব। এটা কি হয়?
আরও একটা ঘটনা বলি। ‘বাঘাযতীন’ ছবিতে দেবের সঙ্গে একটা দৃশ্যের শট দিচ্ছি। খবর এল, মা অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। শট দিতে গিয়ে দেব জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি ঠিক আছ?” লেপেল লাগানো ছিল তাই বলতেও পারছি না। পরিচালক শুনে ফেলবেন। আর আমি চাইনি শুটিংয়ে এই নিয়ে হইচই হোক। লোকে ভাবে, আসছে, সেজেগুজে অভিনয় করছে। খুব ঝাঁ-চকচকে ব্যাপার। অভিনেতারাও লড়াই, হতাশার মধ্যে দিয়ে যান।
প্রশ্ন: আন্দোলন কিছুটা হলেও স্তিমিত, কী মনে হয়?
সুদীপ্তা: আমার অসহায় লাগছে। রাস্তায় নামতে পারছি না। গতকাল ডায়েরি খুলে দেখলাম, ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমার ঘুমোনোর সময় নেই। নালিশ করছি না আমি। বরং এটাই চাই। জানি না, মানুষ আরজি কর নিয়ে একেবারে কেন মুখ ফিরিয়ে নিল। আসলে একটা ঘটনা চায় মানুষ। আবার কিছু একটা ঘটলে মানুষ হয়তো পথে নামবে।
প্রশ্ন: আপনার দু’টি ছবি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হবে। কোন ভাবনা থেকে ছবির প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন?
সুদীপ্তা: দু’টি ছবিরই পরিচালক মহিলা। আর মহিলা পরিচালক ফ্লোরে কাজ করলে আমার ভাল লাগে। এটা পক্ষপাত ঠিকই, কিন্তু মহিলা পরিচালকের সংখ্যা এতই কম! প্রমিতা ভৌমিক পরিচালিত ‘অহনা’। অন্যটি সুদেষ্ণা রায় পরিচালিত ‘আপিস’। দুই মহিলা কর্মীর প্রেক্ষাপটে তৈরি এই ছবি।
অন্য দিকে এত বছর পরে বাংলা ছবিতে নামভূমিকায় এই প্রথম আমি। “ছোট চরিত্র, কিন্তু তোমাকে ছাড়া চলবে না”, এই শুনে শুনেই তো কেরিয়ার চলল এত দিন। জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পরেও পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করে গিয়েছি। “তুমি ছাড়া ছবিটা হবেই না” বলেছে, এ দিকে পোস্টারে আমি নেই, ক্রেডিট লিস্টে প্রথম দিকে আমার নাম নেই! পোস্টারে আমার মুখ রেখে পরে তা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বহু বছর ধরে তো এই সবই চলছে। হাসিও পায়! আমাকেও তো কোথাও গিয়ে আটকাতে হবে। আমি ঠিকই করেছি, মুখ্য চরিত্র না হলে আমি আর কাজই করব না। আমি পরিচালক প্রমিতা ভৌমিককে বলেছিলাম, তুমি আগে ভেবে নাও। প্রথম পরিচালনা। আমাকে নিয়ে ছবি বানিয়ে বিক্রি করতে পারবে তো? আমি তো জানি, চ্যানেলে মিটিংয়ের পরে কী কী কথাবার্তা হয়।
প্রশ্ন: আপনার অভিনীত চরিত্রে নিজের ছায়া দেখতে পেয়েছেন?
সুদীপ্তা: চরিত্রের সঙ্গে আমার জেদ মিলে গিয়েছে। যেটা আমি ভাবি করব, যা-ই হয়ে যাক, সেটা করবই।
প্রশ্ন: যেমন…
সুদীপ্তা: এত বছর ধরে ছবিতে আমাকে না নেওয়ার জন্য নানা কারণ দেখানো হয়েছে। এক বার বলা হয়েছে, ছবি নয়, তোমার জায়গা টেলিভিশনে। বলা হল, নায়িকার মতো সুন্দর চেহারা নয় তাই মুখ্য চরিত্র দেওয়া যাবে না। তার পর বলা হল, আগে টেলিভিশনে কাজ করো, তার পর ছবিতে ফিরবে। কত কী! আমাকে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কখনও ডাকা হয় না। অথচ এই যে আমার দুটো ছবি দেখানো হবে, দু’টি ছবিতেই মুখ্য চরিত্রে আমি। আমাকে কি পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পারল ওরা? আমি জেদ বজায় রেখেই কাজ করলাম।
প্রশ্ন: আপনি তা হলে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন না…
সুদীপ্তা: একেবারেই না। আমার জীবনে নিরাপত্তাহীনতার কোনও জায়গা নেই। গতকালই বাংলা ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির এক নায়িকা ফোন করে বলল, “তুমি মরতে পারো না। তুমি ফ্লোরে না থাকলে আমি ঠিকঠাক ভাবে শট দিতে পারব না। আত্মবিশ্বাস নেই আমার।”
প্রশ্ন: আপনার মধ্যে অভিনেত্রীর সত্তা রয়েছে। আপনি অভিনেত্রীকে চরিত্র হয়ে উঠতে সাহায্য করছেন,মনে হয়নি আমি তো নিজেই অভিনয় করতে পারতাম?
সুদীপ্তা: কখনও ভাবনাতেও আসেনি! আমি করলে কী করতাম, সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করি সব সময়। রুক্মিণী, কৌশানী তো আমার থেকে অনেক ছোট। জয়া, রাইমা আমার সমসাময়িক। তা-ও আমি তাঁদের তৈরি করার বা বোঝানোর চেষ্টা করি। আমার কোনও নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে না। জয়া নিজের ক্ষমতায় কাজ পেয়েছে। এখন আমি যদি ভাবি, বাড়ি বসে সেই কাজগুলো পেয়ে যেতাম, তা হলে কী করে হবে! একই ভাবে আমি যে কাজগুলো পেয়েছি সেগুলো জয়া পেত না। নিজেদের মধ্যে হিংসা করে লাভ নেই।
প্রশ্ন: পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে?
সুদীপ্তা: পরিকল্পনা তো রয়েছেই। কিন্তু সময়ই পাচ্ছি না। মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমি কিছুই করতে পারছি না। প্রতি মাসে অভিনয়ের কর্মশালা করি। যতটুকু সম্মান পাই, মনে হয় তা-ও আমার প্রাপ্য নয়। সম্প্রতি এক সাংবাদিক সম্মেলনে এক জন বলে উঠল, “সুদীপ্তাদি একমাত্র, যে কলব্যাক করে!”
প্রশ্ন: অনুরাগীদের মতে সুদীপ্তা সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত…
সুদীপ্তা: কাজের বাইরে আমি খুব সাধারণ একটা মানুষ। গোলপার্কের মোড়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাই। চায়ের দোকানে বসে লেবু চা খাই। উচ্চমানের জীবনযাপনে কোনও দিনই যাইনি। গেলে সেটা বজায় রাখতে হত।
প্রশ্ন: মানুষের বিরাগভাজনও হতে হয় কখনও?
সুদীপ্তা: কেউ দুর্ব্যবহার করলে মনে হয়, সে কিছু নিয়ে বিরক্ত অথবা তার কোনও বিষয়ে নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে। এই তো সে দিন একটি অনুষ্ঠানে, আমার এক ছাত্রী আমার কাছে অভিনয়ের ক্লাস করে— আমাকে চিনতেই পারল না! সে এখন বড় তারকা। তার জামার লেজ ধরে চার জন ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরে মুখোমুখি হয়ে যাওয়ায় জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছ?” পরে ভাবলাম, ও মুখ্যমন্ত্রীর খুব কাছের। আর এ দিকে আমি আন্দোলন করে যাচ্ছি নিয়মিত। সেই বোধটাই কাজ করেছে বোধ হয়। দিদি বকে দেবে! পাশাপাশি মঞ্চের পিছনে কাঞ্চনের সঙ্গেও সৌজন্য বিনিময় হল।
প্রশ্ন: অভিনয় শেখানো যায়?
সুদীপ্তা: কিছু কৌশল শেখানো যায়। শুধু অনুভূতি দিয়ে অভিনয় হয় না। কৌশলও মাথায় রাখতে হবে।
প্রশ্ন: চারপাশে বিচ্ছেদের ছড়াছড়ি। আপনি কী ভাবে দাম্পত্য সামলাচ্ছেন?
সুদীপ্তা: বেশির ভাগ কৃতিত্ব আমার স্বামীর। আমাদের মধ্যে বোঝাপোড়াটা খুব ভাল। ১০ বছর কাটিয়ে ফেলেছি একসঙ্গে। অভিষেক অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি, বুদ্ধিমান। বিচারবুদ্ধি প্রখর। এমনিই দ্বিতীয় ইনিংস, আর নয়। আমার যেমন সব কিছুতেই তীব্র প্রতিক্রিয়া। টানা হাঁ-হাঁ করে কিছু বলে যাচ্ছি, ও বলবে, “একটু জল খাবে?” কিংবা বলবে, “আচ্ছা তোমার কি এটা নিয়ে কথা বলা শেষ হয়েছে?” আমার আরও গা জ্বলে যায় তখন। বলবে, “একটু কি ওয়াইন খাবে?” মানে অসহ্য একেবারে!
প্রশ্ন: সংসার ও পেশা, সমানতালে চলছে কী ভাবে?
সুদীপ্তা: মাঝেমাঝে অপরাধবোধ কাজ করে। মেয়েকে সময় দিতে পারি না একদম। যদিও অভিষেক সবটা সামলে নেয়। সে ক্ষেত্রেও মনে হয়, অভিষেককে কেন এতটা করতে হচ্ছে। সমাজ আমাদের এ ভাবে ভাবতে শিখিয়েছে।
প্রশ্ন: বিনোদন দুনিয়ায় ফিরবেন না অভিষেক?
সুদীপ্তা: মনের মতো কাজ করতে পারছে না তো। ও যে ছবিগুলো বানাতে চায় সেগুলো বানানোর প্রযোজক নেই। ‘উড়নচণ্ডী’ বানানোর পরে ও ছয় বছর কোনও কাজ করেনি। কিন্তু তাতে তো কিছু আটকায়নি। আমার ধারণা, সেটা ও আরও ভাল বলতে পারবে। আমাদের রান্নাঘর বন্ধ হয়ে যায়নি এতে। মেয়ের স্কুল, মায়ের দেখাশোনা, আমাদের বাড়ি— কোনও কিছুই স্থগিত থাকেনি।