বলিউড ও প্রেম প্রসঙ্গে কী বললেন সোহম মজুমদার? ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: আপনি তো ‘মুম্বইয়ের সোহম’, ‘সিটাডেল’ জনপ্রিয় হওয়ার পরে এ ভাবেই লোকে আপনাকে জানে…
সোহম: আমার কাছে এটা বড় বিষয় নয়। যখন বাংলায় কাজ করি, তখন এখানকার মতো। কাজের সময় আমি ঠিক জলের মতো। যখন যে পাত্রে রাখা হয়, সেই পাত্রের আকার ধারণ করি। এখানে যেমন কম লোক নিয়ে কাজটা হয়, বাজেট কম। মুম্বইয়ে সময় নিয়ে, পর্যাপ্ত লোক নিয়ে কাজ করা হয়।
প্রশ্ন: এই যে বললেন জলের মতো, ইন্ডাস্ট্রিতেও তো নিজেকে মেলে ধরেন না, কেমন চুপচাপ!
সোহম: আমি মানুষটাই এমন। খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজেকে জাহির করতে পারি না।
প্রশ্ন: নায়কসুলভ আচরণ করেন না। অথচ শাহিদ কপূর থেকে অক্ষয়কুমার সকলের সঙ্গে কাজ করেছেন...
সোহম: আমার কাজের কথা লোকে জানেন। ভাল লাগলে বলেন। এতেই খুশি।
প্রশ্ন: আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন?
সোহম: একেবারেই না। কী এমন করেছি? নিজেকে নিয়ে বরং আফসোস রয়েছে।
প্রশ্ন: কী রকম?
সোহম: আসলে নিজেকে নিয়ে আমার প্রচুর প্রত্যাশা। যেটা হয়তো খুব খারাপ এক দিক থেকে। সবচেয়ে ভাল কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে চাই। আমার এই অভ্যেস স্কুলিং থেকে আছে কি না কে জানে! ডন বস্কো, পার্ক সার্কাসে পড়ার সময় থেকেই বোধ হয়। নিজের সেরাটা দিতে হবে, সব সময় এই মনোভাব থাকে।
প্রশ্ন: বরুণ ধওয়ানের সঙ্গে কাজ করার সময় সেরাটা দিতে পেরেছিলেন?
সোহম: আমি নিজের চেয়ে সে সময় বরুণকেই দেখেছি, খেয়াল করেছি। সকলকে আপন করে নেয়। বড় ভাইয়ের মতো ওর স্নেহ। আমি খুব সহজেই ওকে মুখের উপর বলতে পেরেছিলাম যে, এই শটটা ঠিক হল না। আর এক বার নেওয়া যেতে পারে? ও বলত, “হ্যাঁ, আর এক বার করা হোক।” এ ভাবেই নিজের কাজটা চেষ্টা করেছি করার।
প্রশ্ন: শাহিদ কপূর সম্পর্কে কী বলবেন? প্রত্যেকের তো ‘ক্রাফ্ট’ আলাদা…
সোহম: একেবারেই। ‘দৃষ্টিকোণ’ ছবিতে প্রসেনজিৎ স্যরের সঙ্গে আমার প্রথম কাজ। উনি ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল বুঝে প্রতিটি শট দিতেন। সব দিকে তীক্ষ্ণ নজর তাঁর। শাহিদ কপূরও খানিকটা তেমনই। কোনও বাড়তি কথার মধ্যে থাকেন না। সব সময় কানে ইয়ারফোন। যাতে বাইরের কোনও শব্দ মনোযোগে ব্যাঘাত না ঘটায়।
প্রশ্ন: বাংলা নিয়ে আগ্রহ রয়েছে শাহিদের? শুটিংয়ের ফাঁকে বাংলা সম্পর্কে কিছু জানতে চেয়েছেন?
সোহম: ‘কবীর সিং’ শুটিংয়ের সময় সেই অর্থে গল্প-আড্ডার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি খুব একটা। তাই এই প্রসঙ্গে কথা হয়নি শাহিদের সঙ্গে। কিন্তু কার্তিক আরিয়ানের সঙ্গে যখন কাজ করেছি, কার্তিক জানতে চেয়েছে অনেক কিছু। বাঙালি খাবার ইত্যাদি। কার্তিক খুব তাড়াতাড়ি রপ্ত করে ফেলতে পারে সব। ১৫ পাতা একসঙ্গে শুটিং হয়েছে, সবটা মনে রাখতে হয়েছে ওকে।
প্রশ্ন: আর অক্ষয় কুমার?
সোহম: ওঁকে দেখে তো আমরা বড় হয়েছি। ভীষণ পেশাদার, কিন্তু একই সঙ্গে শিশুসুলভ। একটা উদাহরণ দিই। একটা নাচের সিক্যুয়েল চলছিল। হঠাৎ ঝাড়লণ্ঠনের উপর উঠে নাচতে শুরু করেন। এই দৃশ্যটি ছিল না কিন্তু উনি বললেন, “আমি ওটার উপর উঠব, শট নাও।” বড় তারকা হয়েও এই যে তরতাজা মন, এর জন্যই এঁরা আজও প্রাসঙ্গিক।
প্রশ্ন: ‘পাটালিগঞ্জের পুতুলখেলা’ ছবি কতটা প্রাসঙ্গিক?
সোহম: এই গল্প শিকড়ে ফেরার। গোপাল মুখোপাধ্যায় আমার অভিনীত চরিত্র। সে পুতুলনাচ দেখায়। তার বাবা শৈবাল মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরান বন্দ্যোপাধ্যায় স্যার। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্কের কর্মী। ভাতা পায়। এই উপার্জনে পাকা বাড়ি বানানো সম্ভব হয়নি, টালির বাড়িতে দিন গুজরান হয় পরিবারের। ছেলে পাকা ছাদ বানাতে পারবে, বাবার এই আশা। এর পর এই পাকা বাড়ি বানানোর জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক শক্তির মুখোমুখি হতে হয় তাদের। নিশ্চয়ই মানবেন, প্রতিটি মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক দিক থাকে, সেটাই তুলে ধরা হয়েছে মজার ছলে।
প্রশ্ন: সচেতন ভাবে বাংলা ছবি থেকে বিরতি নিয়েছিলেন?
সোহম: ঠিক বিরতি নয়। অন্যান্য কাজ করেছি। যেমন, ‘সিটাডেল হানি বানি’ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তা ছাড়া ‘দুকান’ ছবিটি রয়েছে। তবে দু’বছর পরে বাংলা ছবিতে ঘর ওয়াপসি আমার। স্বাভাবিক ভাবে, ভালই লাগছে।
প্রশ্ন: টলিপাড়ায় একই মুখ ঘোরাফেরা করে। এই ছবিতে দিতিপ্রিয়ার সঙ্গে আপনার জুটি সে ক্ষেত্রে নতুন…
সোহম: আসলে ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন মুখ যাঁরা, তাঁদের কাজের প্রচুর সুযোগ এমন তো নয়, সে রকম কোনও ফর্মুলা নেই। তাই একই মুখ ফিরে আসছে। যাঁরা ভাল অভিনয় করেন তাঁদের তো বেশি কাজ করাই উচিত। পাশাপাশি নতুনদেরও সুযোগ দেওয়া উচিত।
প্রশ্ন: আর কোন জায়গায় ফাঁক থেকে যাচ্ছে বলে মনে হয়?
সোহম: আমরাও এখানে হৃদয় দিয়ে কাজ করি। আমি শুরু থেকেই বলি, মাঝেমধ্যে ভুল করে ফেলি হয়তো আমরা। কিন্তু আমরাও চেষ্টা করে যাচ্ছি ভাল গল্প বলার।
প্রশ্ন: বাজেট সংক্রান্ত অভিযোগ সারা ক্ষণ থাকে…
সোহম: হ্যাঁ, এই অভিযোগ থেকে বেরোতে হবে আমাদের। ইরানে এর থেকেও কম বাজেটে ছবি বানানো হয়। এই সমস্যাকে আলিঙ্গন করেই আমাদের গল্পের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত, যে এই বাজেটের মধ্যেই কী ভাবে ভাল ছবি বানানো যায়। একই জঁরের ছবি পর পর হলে মুশকিল।
প্রশ্ন: এখন তো ভারতীয় ছবি অস্কারের দৌড়ে শামিল হচ্ছে?
সোহম: হ্যাঁ, ঠিকই। একটাই সূত্র, যত বেশি স্থানীয় গল্প তুলে ধরা হবে ছবিতে, তত বেশি আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছনোর সম্ভাবনা। একজন ছবির দর্শক মার্কিন মুলুকে তার চারপাশে বসে যা দেখতে পায়, ভারতীয় ছবিতে সেই একই জিনিস দেখতে আগ্রহী হবে না। তারা নতুন বিষয়ই দেখতে চাইবে। ঠিক সেই কারণেই ‘স্লামডগ মিলিওনেয়ার’ বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। ছবি ভাল না খারাপ, সেই আলোচনা পরের বিষয়।
প্রশ্ন: পাশাপাশি পারস্পরিক সমর্থনের প্রয়োজন…
সোহম: সেটা তো অবশ্যই জরুরি। আমি যেমন, যেখানেই যাচ্ছি ‘বহুরূপী’ ছবির কথা বলছি। আমি কিন্তু এই ছবির সঙ্গে কোনও ভাবেই যুক্ত নই। শিবপ্রসাদ স্যর, নন্দিতা ম্যাম দেখিয়ে দিয়েছেন, বাংলা ছবি ঘুরে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু তা-ও আমি মৌখিক ভাবে এই ছবির কথা বলি, যাতে মুম্বই বা হায়দরাবাদের পাঁচটা লোক এই ছবি সম্পর্কে জানতে পারে। জাতীয় স্তরে বাংলা ছবির প্রাসঙ্গিকতা ফিরে না পেলে, আমরা একাগ্রতা নিয়ে না বললে বিষয়টা একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্ন: বাঙালিরা কি যথেষ্ট সরব নন বাংলা ছবি নিয়ে?
সোহম: আমি চেষ্টা করি বলার। কিন্তু সেটা বলতে গেলেও তো দুটো ছবির উদাহরণ দিতে হবে আমাকে।
প্রশ্ন: মানে পর পর বলতে পারা যায় অনেকগুলো বাংলা ছবি, এমন হচ্ছে না?
সোহম: হবে। সময় লাগবে।
প্রশ্ন: বাংলায় আপনার কাজের পরিমাণ মুম্বইয়ের তুলনায় কম?
সোহম: মুম্বইয়ে মোটামুটি ৭ মাস ধরে কাজ চলে। ফলে লম্বা সময় ধরে ওখানে আটকে পড়ি। অনেকেই হয়তো দু’দিকে ভারসাম্য রাখতে পারে। কিন্তু আমি পারি না। তা ছাড়া প্রতিটি ছবির ভিন্ন লুক থাকে। সমস্ত চরিত্রে একই লুক হলে তো মুশকিল। তবে এ বছরে আমাকে অনেক বাংলা ছবিতে দেখতে পাবে দর্শক।
প্রশ্ন: এই যে দেব, জিৎ, যিশু, ঋত্বিক, অনির্বাণ, পরম— একের পর এক নাম বলা যায়, নতুন প্রজন্মে এ রকম একঝাঁক অভিনেতা আসছেন না কেন?
সোহম: আসছে না, তা বলব না। উজান, বিক্রম এবং আরও অনেকে ভাল কাজ করছে। চেষ্টা করছে অনেকেই। ধীরে ধীরে তৈরি হবে। ঋদ্ধি, ঋতব্রত রয়েছে। ঋদ্ধি যেমন পরিচালনা শুরু করবে। ওর পরিচালনায় অভিনয় করতে পারলে ভালই লাগবে আমার।
প্রশ্ন: কর্ণ জোহরের ছবি করার ইচ্ছে আছে নিশ্চয়?
সোহম: অবশ্যই, ডাকলে অবশ্যই করব।
প্রশ্ন: আলাপ আছে কর্ণ জোহরের সঙ্গে?
সোহম: হ্যাঁ, যোগাযোগ আছে। উনি আমাকে বেশ পছন্দও করেন। তবে আমি কাজ পাওয়ার আশায় ‘স্যর, কেমন আছেন’ বলে বাড়তি আলাপচারিতা করি না। ওটা পারি না আমি। যখন মনে হবে, আমাকে নিজেই ডাকবেন। আর মুম্বইয়ে এত মেধা। কাকে ছেড়ে কাকে কাজে নেবেন! ফলে, ‘আমি কাজটা পেলাম না’ এই ভেবে দুঃখ করে বসে থাকলে হবে না। যেটা আমাদের এখানে প্রায়শই হয়ে থাকে। দুঃখ করে লাভ নেই। প্রতিযোগিতা থাকুক। ঋতব্রত, বিক্রমদের সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতা চলে। সৌম্য মুখোপাধ্যায় তো আমার ছোটবেলার বন্ধু। মাঠে নামলে আমরা সকলেই প্রতিযোগী, কিন্তু তাই বলে এর-তার কাজ ছিনিয়ে নেব এটা হয় না। এই ধরনের রাজনীতি আমরা পারি না, কোনও দিন শিখিনি। একে অন্যের কাজের প্রতি মর্যাদাপূর্ণ থাকতে হবে। নিজের জায়গায় খুশি থেকে চেষ্টা করে যেতে হবে। সুজয় ঘোষ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “কোনও চরিত্রই খারাপ নয়। তোমার অভিনয় দিয়ে চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তুলতে হবে।”
প্রশ্ন: ব্যক্তিজীবনেও সোহম তাঁর আলাপচারিতা প্রকাশ করেন না…
সোহম: নিশ্চয়ই। বাবা একটা কথা বলতেন সব সময়, “নিজেকে এতটাও প্রকাশ্যে নিয়ে এসো না, যাতে মানুষ তোমার সুযোগ নিতে পারেন।” ‘সিটাডেল’ করার সময়, কারা লিখেছিল, ‘অমুকের প্রেমিক কাজ করছেন ‘সিটাডেল’-এ…’ আমার কাজটাই তো আমার পরিচয় হওয়া উচিত। আমি অনুমানসাপেক্ষে কার প্রেমিক সেটা আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হতে পারে না। আর প্রেম তখনই প্রকাশ্যে আসবে যখন তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেব।
প্রশ্ন: সিচুয়েশনশিপ, একত্রবাস এই বিষয়ে সাবলীল আপনি?
সোহম: আমি এই প্রজন্মের একটু আগের। সিচুয়েশনশিপ আমার ভাল লাগে না। একত্রবাসে যদিও আমার অসুবিধা নেই। তবে তার পর একটা জায়গায় আসতে হবে। সম্মান, বিশ্বাস না থাকলে কোনও সম্পর্কেই থাকা উচিত নয়।
প্রশ্ন: তা হলে আপনার প্রেমিকা নেই বলছেন?
সোহম: না, সত্যিই নেই।
প্রশ্ন: তা হলে শোলাঙ্কির সঙ্গে নাম জড়িয়ে গেল কী ভাবে?
সোহম: সৌরভ চক্রবর্তীর ‘সাড়ে ৩৭’ ওয়েব শোয়ে জুটি বেঁধেছি আমরা। এখনও মুক্তি পায়নি। শোলাঙ্কি আমরা খুবই ভাল বন্ধু। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে যোগাযোগ কমে গিয়েছে। মধুমিতার সঙ্গেও আমার নাম জড়ানো হয়েছিল। মধুমিতার যে হেতু প্রেমিক রয়েছে তাই সেই গুঞ্জন চাপা পড়ে গিয়েছে। আশা করি, শোলাঙ্কিরও যখন কোনও প্রেমিক আসবে আমাকে নিয়ে এই টানাটানি বন্ধ হবে।
প্রশ্ন: পাশাপাশি বসে ছবি দেখছিলেন সেই নিয়েও তো আলোচনা…
সোহম: আমি তো অস্বীকার করছি না বন্ধুত্ব নিয়ে। আমরা ভাল বন্ধু, কিন্তু প্রেমের সম্পর্ক নেই। ওর আগে পরিবার ছিল, অনেক কিছু সামলাতে হয়েছে ওকে। আমি পুরুষ হয়েই এই কথা বলছি, পুরুষদের পক্ষে এগুলো সামলানো সহজ। মেয়েদের পক্ষে এই বিষয়গুলি খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।