চকদিঘি বাগানবাড়িতে শুটিংয়ের ফাঁকে সব্যসাচী চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
তারকেশ্বর মোড় থেকে ডান দিকে সড়কপথে চকদিঘি প্রায় ৮ কিলোমিটার। গ্রামে ঢোকার মুখে বাঁ দিকে জরাজীর্ণ এক ফটক। সুরকি ঢাকা রাস্তা, দু’পাশে জংলা গাছের ভিড়। হেমন্তের মিঠে রোদ মাখা দুপুরে সেই রাস্তা ধরে এগোতেই সামনে প্রকাণ্ড বাড়িটি, স্থানীয়দের কাছে ‘চকদিঘি বাগানবাড়ি’ নামে পরিচিত। চল্লিশের দশকে বাড়িটি তৈরি করেছিলেন জমিদার কমলাপ্রসাদ সিংহরায়। এখন বাড়ির বাইরে শুটিং ইউনিটের ভিড়। গাড়ি, তাঁবু, মেকআপ ভ্যান, ক্যামেরা এবং আলোর ভিড়। শান্ত পরিবেশ তাই মুখরিত। সম্প্রতি এখানেই শুটিং হয়েছে পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্রের ‘দেবী চৌধুরানী’ ছবির শেষ পর্বের।
বাড়ির সামনে ফোয়ারা রং করা হচ্ছে নতুন করে। পাশেই তদারকিতে ব্যস্ত পরিচালক। বললেন, “এই বাড়িতেই ‘ঘরে বাইরে’ ছবির শুটিং করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। সেখানে আমার ছবির শুটিং হচ্ছে বলে আরও ভাল লাগছে।” বাইরে তাঁবুর নীচে চেয়ারে বসে রয়েছেন একদল বিদেশি। রূপটান চলছে। জানা গেল তাঁরা এই ছবিতে অভিনয় করছেন। ছবির কাহিনি এবং তাঁদের গায়ে লাল-সাদা পোশাক দেখেই বোঝা যায় সকলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মী-আধিকারিক। দোতলার বারান্দায় বসেছে কোম্পানির সদর দফতর। সেখানে ওয়ারেন হেস্টিংসের (চরিত্রাভিনেতা কার্ল হার্ট) সঙ্গে ব্রিটিশ আধিকারিকদের কিছু দৃশ্যের শুটিং করা হবে। কর্নেল মুনরোর চরিত্রে অভিনয় করছেন অ্যালেক্স ও’নীল। এর আগে ‘গোলন্দাজ’ ছবিতে তিনি দর্শকের নজর কেড়েছিলেন। এই পর্বে মূলত বিকাল এবং সন্ধ্যার দৃশ্য। সেই মতো পরিকল্পনা করেছেন পরিচালক।
ছবিতে নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়। ভবানী পাঠকের চরিত্রে রয়েছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের শুটিং আগেই শেষ হয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে সব্যসাচী চক্রবর্তীর শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর অংশের শুটিং পিছিয়ে যায়। সেই শুটিংই দীপাবলির আগে সেরে নিতে চাইছেন পরিচালক। সব্যসাচী ছবিতে জমিদার হরবল্লভের চরিত্রে অভিনয় করছেন। অভিনেতা কিঞ্জল নন্দ তাঁর পুত্র ব্রজেশ্বরের চরিত্রে।
ইউনিটের তরফে খবর পাওয়া গেল সব্যসাচী এবং কিঞ্জল শটের জন্য তৈরি হচ্ছেন। তাই শুভ্রজিৎকে একান্তে পাওয়া গেল। চলতি বছর জানুয়ারি মাস থেকে ছবির শুটিং শুরু করেছিলেন শুভ্রজিৎ। এটি তাঁর স্বপ্নের ছবি। দীর্ঘ সফর প্রসঙ্গে পরিচালক বলেন, “গত বছর প্রস্তুতি নিতে সময় লেগেছে। এখন শুটিং শেষের মুখে। যেন বিশ্বাসই করতে পারছি না।” বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবী চৌধুরাণীকে নিয়ে এর আগেও বাংলায় একাধিক ছবি তৈরি হয়েছে। আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে মুক্তি পায় দীনেন গুপ্তের ‘দেবী চৌধুরাণী’। সেই ছবিতে নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন। তবে কোনও রকম তুলনায় যেতে চাইছেন না শুভ্রজিৎ। তাঁর যুক্তি, “মূল গল্পের সঙ্গে আমি তৎকালীন ঐতিহাসিক তথ্যকে মিশিয়ে একটা কল্পকাহিনি তৈরি করেছি।”
সন্ধ্যা নেমেছে। আলো-আঁধারির মধ্যে ব্রিটিশদের শুটিং শুরু হয়েছে। মনিটরে শট দেখছেন শুভ্রজিৎ। তত ক্ষণে বাগানে ভিড় করেছেন আশেপাশের গ্রামের মানুষ। তাঁদের কাছে খবর ছিল প্রসেনজিৎ এসেছেন শুটিং করতে। দূরে ভ্রাম্যমাণ খাবারের স্টলও দেখা গেল। বাগানের এক কোনায় জুড়িগাড়ি রাখা হয়েছে। এক জোড়া সাদা ঘোড়া এনে তাতে জুড়ে দিতেই স্থানীয়দের মধ্যে শুরু হয়ে গেল ছবি তোলার হুড়োহুড়ি। তত ক্ষণে ইউনিট জানিয়ে দিয়েছে প্রসেনজিতের শুটিং আগেই হয়ে গিয়েছে, তিনি আসেননি। সন্ধ্যার অন্ধকারে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল উৎসাহী জনতা। তার পরই খবর এল সব্যসাচী এবং কিঞ্জল লোকেশনে আসছেন।
তখন সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ৭টা। আলো-আঁধারি বাগানবাড়ি নিজেই হয়ে ওঠে রহস্যময় এক চরিত্র। বাড়ির সিঁড়িতে হরবল্লভ এবং ব্রজেশ্বরের কথোপকথনের দৃশ্যের শুটিং হবে। বাবা-ছেলের চরিত্রে দুই অভিনেতার পোশাক ও লুক প্রায় দু’শো বছর আগের বাংলায় হাজির করেছে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দু’জনের শট শেষ হতেই মনিটরের পিছন থেকে পরিচালকের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “কাট”। সব্যসাচী এখন বেছে কাজ করেন। হেসে বললেন, “আমার অসুস্থতার কারণে ওদের শুটিংয়ের অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। আজ শুটিং শেষ হলেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচব।”
বিরতির মাঝে সব্যসাচী এবং কিঞ্জলের পোশাক পরিবর্তন করতে হবে। তার আগে সময় দিলেন কিঞ্জল। সম্প্রতি আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছেন কিঞ্জল। বেশ কয়েক মাস পর শুটিং ফ্লোরে ফিরে মনের অবস্থা কী রকম? কিঞ্জল বললেন, “চিকিৎসার পাশাপাশি অভিনয় আমার ভাল লাগার জায়গা। তাই চেনা জায়গা ফিরে ভাল লাগছে।” এর আগে এপ্রিলে এই ছবির শেষ শুটিং করেছিলেন কিঞ্জল। কিন্তু ফিরে এসেও চরিত্রে প্রবেশ করতে তাঁর কোনও অসুবিধা হয়নি বলেই জানালেন। কিঞ্জল এর আগেও পিরিয়ড ছবিতে অভিনয় করেছেন। বললেন, “খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছবি। এখনই খুব বেশি কিছু বলতে চাই না। তবে যে ভাবে ছবিটা তৈরি হচ্ছে, বাংলার দর্শকের জন্য একটা বড় চমক অপেক্ষা করছে।”
এর পরই বিরতির ঘোষণা করা হল। কিন্তু পরিচালক জানালেন শুটিং চলবে প্রায় ভোর পর্যন্ত। তাঁর কথায়, “এক দিনের সময় পাওয়া গিয়েছে। তাই সবটা শেষ করতেই হবে।” রাত বাড়ছে। অগত্যা ফেরার প্রস্তুতি নিতে হল। অন্ধকারে মায়াবী চকদিঘি বাগানবাড়িকে পিছনে রেখে পা বাড়াতে হল কলকাতার উদ্দেশে। ‘অ্যাডিটেড মোশন পিকচার্স’ এবং ‘লোক আর্টস কালেক্টিভ’ প্রযোজিত ছবিটি আগামী বছর মুক্তি পাবে।