Review of Jaanbaaz Hindustan Ke

চেনা রোমাঞ্চও কখন যে অচেনা হয়ে যায়, নতুন হিন্দি সিরিজ়ে দেখালেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়

এই সিরিজ়ের কাহিনি আর তার পরিবেশনের আঙ্গিক এক নতুন সৃজিতের সঙ্গে পরিচয় করায়। ‘রেক্কা’ বা ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এর অতিকথন থেকে দূরে এ যেন এক অন্য সৃজিত মুখোপাধ্যায়!

Advertisement
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:৫৯
Jaaanbaz Hidustan ke— a new move from Srijit Mukherji

তাঁর নতুন সিরিজ়ে কি চেনা ছন্দ থেকে বেরিয়ে এলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়? ছবি: সংগৃহীত।

বাংলাদেশ-মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করছে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক। সেই বিন্দু থেকে তা ছড়িয়ে পড়বে দেশের যে কোনও প্রান্তে। তার পর বিস্ফোরণ যে কোথায় ঘটবে, তা কারও জানা নেই। বিস্ফোরণ ঘটে। তাকে রোখা যায় না। বেপরোয়া আইপিএস অফিসার কাব্য আইয়ার বুঝতে চেষ্টা করে জঙ্গিদের গতিবিধি। কিন্তু কিছু করে ওঠার আগেই ঘটে যায় অঘটন।

সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত হিন্দি ওয়েব সিরিজ় ‘জাঁবাজ হিন্দুস্তান কে’-র গল্পকাঠামো অচেনা নয়। কিন্তু এই ওটিটি ছবি এমন কিছু বিষয়কে প্রকাশ করেছে, যা ইতিপূর্বে সৃজিতের ক্যামেরা থেকে দৃষ্ট হয়নি।

Advertisement

কাব্য আইয়ার উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক হলেও নিজহাতে (এবং নিজস্ব সিদ্ধান্তে) অপরাধ দমনে বিশ্বাসী। তার স্বামী সমীর আইএএস আধিকারিক। বাড়িতে মা এবং এক শিশুপুত্রও রয়েছে। মা, স্ত্রী, কন্যা হিসেবে কাব্যের অবস্থান আর তার সমান্তরালে তার ঘাত-প্রতিঘাতের কর্মজীবন ছবির মূল গল্পকাঠামোর ধ্রুবপদ বেঁধে দেয়। হিন্দি ওয়েব সিরিজ়ের সাম্প্রতিক রেওয়াজ হিসেবে বার বার দেখা যায় পুলিশ বা সরকারি গোয়েন্দা আধিকারিকদের কর্মজগৎ ও ব্যক্তিগত জীবনের সংঘাত ও সহাবস্থানের কাহিনি। ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’, ‘স্পেশাল অপ্‌স’ প্রভৃতি সিরিজ় এই ঘরানার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ‘জাঁবাজ হিন্দুস্তান কে’ সেই পথেরই পথিক। কিন্তু যেখানে এই সিরিজ় এই ঘরানার বাকিদের থেকে ভিন্ন রাস্তা নেয়, তা এর ‘ট্রিটমেন্ট’। অন্যত্র যেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটার আগেই রুখে দেওয়া যায় দুর্ঘটনা, এখানে ঘটছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। জঙ্গিরা তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার পরে টনক নড়ছে প্রশাসনের। পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগ সব সময়েই এক কদম পিছিয়ে থাকছে জঙ্গিদের থেকে।

Regina Cassandra in Jaaanbaz Hidustan ke

এই সিরিজ়ে রেজিনা কাসান্ড্রা একঝলক টাটকা বাতাস। ছবি: সংগৃহীত।

কাব্য আইয়ার তার বেপরোয়াপনার জন্য নির্বাসিত হয় পুলিশের ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে। পরে তাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয় ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)-র এক বিশেষ মিশনে। সেখানে তার মাথার উপর রয়েছে দুঁদে আধিকারিক মাহিরা রিজভি। মাহিরা এবং কাব্যর ব্যক্তিত্ব সংঘাত এবং তা থেকে ক্রমশ বেরিয়ে আসা— এ সিরিজ়ের এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। মনে রাখা দরকার, কাব্য এবং মাহিরা দু’জনেই নারী এবং দু’জনেই তাদের কাজের প্রতি বা আপাতদৃষ্টিতে দেশের প্রতি জীবন উৎসর্গ করতেও পিছপা নয়।

জাতীয়তাবাদের দু’রকম ‘নজর’ দেখা যায় এই সূত্রে। একটি অপারেশন পরিচালনাকারীর ‘নজর’, যা তৎক্ষণাৎ সমস্যার শিকড় উপড়ে ফেলতে চায়। অন্যটি তার ঊর্ধ্বতন আধিকারিকের ‘নজর’, যেখানে লালফিতের ফাঁস, মন্ত্রী বা অন্য ক্ষমতাবানদের চাপ ইত্যাদি সামলে এগোতে হয় গন্তব্যের দিকে। প্রথম নজরের সঙ্গে দ্বিতীয়টির সংঘাত অনিবার্য, অনেকটা জেমস বন্ড ও তার ঊর্ধ্বতন আধিকারিকের ক্ষেত্রে যেমন ঘটে। এই ঘরানার অধিকাংশ ছবি বা সিরিজ়েই এই সংঘাত বার বার ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই সিরিজ় সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। মনে রাখা দরকার, কাব্য ও তার বস্, নারী বলে দু’জনেরই ঘর-সংক্রান্ত পিছুটান রয়েছে। প্রাথমিক অপছন্দের গণ্ডি পার হয়ে মাহিরা কাব্যকে পছন্দ করতেই শুরু করে। ঊর্ধ্বতন-অধস্তনের সম্পর্কের বাইরে একটি তৃতীয় ‘নজর’ এখানে আবছা ভাবে ফুটে ওঠে। সেটি দুই নারীর সখ্য। এখানে সৃজিত বেশ সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। ছবির নেপথ্যে খেলা করতে থাকে মিতবাক মাহিরা আর টগবগে কাব্যর মধ্যে সম্পর্ক। সে অর্থে প্রকট হয়ে না উঠে ফল্গুস্রোতের মতো খেলা করে দুই নারীর সম্পর্ক-রসায়ন। পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির গহিনে যেন খানিকটা অন্তর্ঘাতের ছায়া খেলা করে এই সম্পর্কে।

Regina Cassandra played  Kavya Iyer IPS

বেপরোয়া আইপিএস কাব্য আইয়ারের ভূমিকায় রেজিনা আগাগোড়া সাবলীল থেকেছেন সিরিজ়ে। ছবি: সংগৃহীত।

জঙ্গি নেটওয়ার্ক নিয়ে সাধারণত যে একতরফা খেলা এ ধরনের ছবি বা সিরিজ় খেলে থাকে, ‘জাঁবাজ…’ সে দিক থেকেও বেশ আলাদা। আইসিস-এর মতো বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদী সংগঠন কী ভাবে তার ‘মিনিওন’দের তৈরি করে এবং ক্রমে ‘ইডিয়োলজির দাস’-এ পরিণত করে, তা এই ঘরানায় প্রায়শই দেখা যায়। কিন্তু এখানে সৃজিত ভিন্ন পথ নিয়েছেন। সাইবার অপরাধ এবং ‘ডিপ ওয়েব’ বা ‘ডার্ক ওয়েব’ মারফত কী ভাবে তৈরি হয় বিশ্বজোড়া সন্ত্রাসের নেটওয়ার্ক, তার আভাস এই সিরিজ়ে রয়েছে। চন্দন নামের এক ওয়েব বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি চিত্রনাট্যকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। চন্দনের অবয়ব অতি সাধারণ। কিন্তু তার প্যাশন আন্তর্জালের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা রহস্যের উদ্ঘাটন। নিছক চাকরি নয়, এনআইএ-র এই কর্মচারীটি তার বেশি কিছু কাজ নীরবে করে যায়। তার এই উদ্যমের পিছনে ঠিক কী কাজ করে? চন্দন, কাব্য, মাহিরা— এরা প্রত্যেকেই চাকুরে। কিন্তু যে বিষয়টি তাদের সীমানা পেরিয়ে কাজ করতে উদ্দীপিত করে, তা কি জাতীয়তাবাদ? এই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসতেই থাকে। জাতীয়তাবাদ আর জঙ্গিদমনের ইতিবৃত্ত হিন্দি মূলধারার ছবিতে এত বেশি ব্যবহৃত হয়েছে যে, তা এক পর্যায়ের পর ক্লান্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই সিরিজ়ে সৃজিত সেই উদ্দীপককে এক ধূসর জায়গায় রেখেছেন। কাব্যর ব্যক্তিগত জীবনের টানাপড়েন, স্বামীর সঙ্গে তার ব্যক্তিত্ব সংঘাত, মা হিসাবে তার কর্তব্যপালন ইত্যাদির জট ছাড়াতে গিয়ে যখন সে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তখনই সে হয়ে ওঠে ‘শিলং কি শেরনি’, এক বেপরোয়া সৈনিক। ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’-র চেয়েও অনেক বেশি করে যেন তার সাংসারিক পিছুটান তাকে নিয়ে যায় ‘স্বাভাবিক’-এর সীমানা লঙ্ঘনের দিকে। চন্দনও নেশাগ্রস্তের মতো বিচরণ করে আন্তর্জালের জগতে। তার কাজ-পাগলামিই যেন মুখ্য এখানে। দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদ নয়।

সিরিজ়ের প্রাণভোমরাটি লুকিয়ে আছে এর নির্মাণে। সৃজিতের ছবি বলতে যে ব্যাকরণটি দর্শক চেনেন, তা এখানে অনুপস্থিত। সৃজিত কিন্তু আবার এই ঘরানার অন্য সিরিজ় বা ছবিগুলির আঙ্গিকেও হাঁটছেন না। জোর গলায় নারীশক্তির জয়গান গাওয়ার চেষ্টাও এখানে নেই। তখনই খটকা লাগে। ‘বেগমজান’ বা ‘দ্বিতীয় পুরুষ’-এর পরিচালক কী উপায়ে বেরিয়ে এলেন তাঁর ‘এক্সেস’ বা অতিকথন থেকে? বিষয়টি নজর কাড়ে। তার উপর সিরিজের নামটিও কেমন যেন আশির দশকের জগঝম্প হিন্দি ছবির অনুসারী। চিত্রনাট্য, চরিত্রায়ন, চিত্রগ্রহণের যে পথ এখানে অনুসৃত হয়েছে, তার সঙ্গে ‘জাঁবাজ হিন্দুস্তান কে’ কিছুতেই যেন মেলানো যায় না! তা হলে বিষয়টি কি ধামাকাদার হিন্দি মূলধারার ছবির নামের আড়ালে অন্য কিছু বলার চেষ্টা? গুপ্তচর রহস্যে এই মুহূর্তে হিন্দি ছবি এবং ওটিটি-র বাজার গুলজার। সেখানে ফ্যামিলি ম্যান থেকে সুপার হিরো, সব রকম আয়োজনই লভ্য। এ সিরিজ় কি সেই ধামাকার খোলসটুকু নিয়ে অন্য কিছু কথা বলতে চাইল?

দুই নারীর অভিযানের পাশে এখানে রয়েছে আর এক নারীর অভিযানও। সে সন্ত্রাসবাদী। পুং পৃথিবীর ঘেরাটোপে এক দিকে যেমন মাহিরা আর কাব্য তাদের কর্মকাণ্ডকে ভিন্ন আড়াল দেয়, তসলিনা নামের সেই আবছায়া মেয়েটিকেও কাজ করতে হয় পুরুষতান্ত্রিক জঙ্গিয়ানার দ্বারা নির্ধারিত ব্যাকরণে। এই বিন্দু থেকে দেখলে সৃজিতের অন্য ছবি বা সিরিজ় থেকে ‘জাঁবাজ…’ একেবারেই আলাদা। কাব্যর চরিত্রে রেজিনা কাসান্ড্রা টাটকা বাতাস। তসলিনার ভূমিকায় গায়ত্রী নজর কাড়েন। চন্দনের ভূমিকায় চন্দন রায়ের কাস্টিংও প্রশংসার্হ। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে রয়েছেন মিতা বশিষ্ঠ। এনআইএ প্রধান মাহিরার চরিত্রে তাঁর অভিনয় দক্ষতা বহুমাত্রিক হয়ে দেখা দেয়। সব মিলিয়ে, ‘জাঁবাজ হিন্দুস্তান কে’ এক অন্য সৃজিতের সঙ্গে পরিচয় করায়। দর্শককে দাঁড় করিয়ে রাখে পরবর্তী সিজ়নের অপেক্ষায়।

আরও পড়ুন
Advertisement