Bohurupi movie review

চোর-পুলিশের গল্পে রুদ্ধশ্বাস ‘বহুরূপী’ দর্শককে শেষ পর্যন্ত আসন আঁকড়ে বসে থাকতে বাধ্য করে

‘বহুরূপী’ আসলে একটি নির্ভেজাল ‘থ্রিলার’ ছবি। মূলত পুলিশ এবং অপরাধীর একে-অপরের বিরুদ্ধে শানিত বুদ্ধির দাবা খেলা।

Advertisement
সুদীপ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪ ১০:১০
Review of the Bengali movie Bohurupi

‘বহুরূপী’ ছবির একটি দৃশ্যে শিবপ্রসাদ ও কৌশানী। ছবি: সংগৃহীত।

পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক ইতিহাসে ঘটে যাওয়া কোনও অপরাধ নিয়ে টালিগঞ্জে খুব একটা সিনেমা হয় না সাধারণত। হলিউডে হয়-টয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় যা হয়, অন্তত আমার যেটুকু স্মৃতিতে আছে, তাতে সত্যিকারের ঘটে যাওয়া অপরাধের ঘটনা নিয়ে কোনও ছবি টলিপাড়ায় তেমন একটা হয়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় জুটি। তাঁরা প্রথমে ২০২৩ সালে মাত্র দশ বছরের পুরনো ঘটনা নিয়ে করেছিলেন ‘রক্তবীজ’। ২০১৪ সালে বর্ধমান জেলায় ঘটে যাওয়া বোমা কেলেঙ্কারির ঘটনার প্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছিল এই মানবিক টানাপড়েনের ছবি। আর ২০২৪-এ এসে পুজোর ছবি হিসাবে তাঁরা নিয়ে এসেছেন ‘বহুরূপী’, যার কাহিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়পুরে পর পর ঘটে যাওয়া ব্যাঙ্ক ডাকাতির উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা।

Advertisement

‘বহুরূপী’ আসলে একটি নির্ভেজাল ‘থ্রিলার’ ছবি। মূলত পুলিশ এবং অপরাধীর পরস্পরের বিরুদ্ধে শানিত বুদ্ধির দাবা খেলা। কিন্তু সেই কাহিনির মধ্যেই চিত্রনাট্যের মাধ্যমে বুনে দেওয়া হয়েছে মানবিক কিছু সম্পর্ক, পারিবারিক টানাপড়েন, অথৈ প্রেম, সাহসিকতা, রোমাঞ্চ, রক্ত গরম করা সংলাপ, এবং ভীষণ রকমের বাঙালি ‘সেন্টিমেন্ট’। অথচ সারা ছবিতে এক টুকরোও অপভাষার প্রয়োগ নেই কোথাও। এই রকম ঘটনা নিয়েও যে বাংলায় এমন পরিশীলিত ভাষ্যে চিত্রনাট্য লেখা যায়, এটি একটি অনুধাবনীয় বিষয়। অর্থাৎ, এই বছর পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সঙ্গে নির্দ্বিধায় বসে দেখার মতো একটি বাংলা ছবি ‘বহুরূপী’।

Review of the Bengali movie Bohurupi

‘বহুরূপী’ ছবির একটি দৃশ্যে শিবপ্রসাদ ও কৌশানী। ছবি: সংগৃহীত।

পারিবারিক ছবি হিসাবে ‘বহুরূপী’র আরও বহু গুণ নিহিত আছে সিনেমাটির চলনে। কিছু দুর্ধর্ষ প্রেমের গান আছে। একটি ‘থ্রিলার’ ছবিতে প্রেমের গান! ভাবতে কষ্ট হলেও, মনে সন্দেহ উঁকি মারলেও, গানগুলিকে একফোঁটাও বেখাপ্পা লাগে না। ‘তুই আমার হয়ে যা’ গানটিকে ছবির দুরন্ত গতির মধ্যে যেন এক ঝলক তাজা হওয়ার মতো লাগে। এছাড়াও শিলাজিতের একটি গান আছে, যেটিকে মোটামুটি ‘বহুরূপী’র ‘চমক’ বলা চলে। পর্দায় শিলাজিৎ নিজেই এই গানটি গেয়েছেন, সঙ্গে নেচেওছেন। গানটি আসে ছবির প্রায় অন্তিম পর্যায়ে, ‘ক্লাইম্যাক্সে’। এবং এ কথা হলফ করে বলা যায়, এটিই ছবির শ্রেষ্ঠ গান। অন্তত এই প্রতিবেদকের তা-ই মনে হয়েছে। সে যতই ‘শিমূল-পলাশ’ বা ‘ডাকাতিয়া বাঁশি’ জনপ্রিয় হয়ে যাক না কেন ছবিমুক্তির আগেই।

Review of the Bengali movie Bohurupi

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

এই ছবির আরেকটি পাওনা ছবির নায়িকারা— ঋতাভরী এবং কৌশানী। বাংলা ছবিতে ঐতিহাসিক ভাবে একটু ভারী চেহারার নায়িকারাই জনপ্রিয়তায় বহু যোজন এগিয়ে আছেন বহু যুগ ধরে। ভাবুন, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, অপর্ণা সেন, মহুয়া রায়চৌধুরী, দেবশ্রী রায় বা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের কথা। ক্ষীণাঙ্গীরা বাংলা বাজারে কোনও দিনই বিশেষ পাত্তা পাননি, তিনি যতই সুন্দরী বা শহুরে পালিশওয়ালা আদবকায়দা রপ্ত করে ফেলুন না কেন। ঋতাভরী এবং কৌশানী, দু’জনেই সেই উত্তরাধিকার বহন করছেন। কৌশানীকে তো এই ছবিতে রীতিমতো ‘স্বপ্নসুন্দরী’ মনে হয়েছে। সেই দিক থেকে এ ছবি হয়তো টালিগঞ্জের সামনে এই দু’জনকে নতুন অবতারে আত্মপ্রকাশ করাবে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য, অভিনয়টা কৌশানীর থেকে ঋতাভরী অনেক ভাল পারেন। ছবিতে কৌশানীর চরিত্র ঝিমলি গঞ্জের পকেটমার। ধরে নেওয়াই যায় ঝিমলির চরিত্রটি হয়তো প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডিও পেরোয়নি। সুতরাং সেই চরিত্রের মুখে ইংরেজি শব্দগুলির উচ্চারণে যে পালিশ, তা বেশ বেমানান লাগে। ‘রিস্ক’ উচ্চারণটি তিনি যে ভীষণ কষ্ট করেই ‘রিক্স’ উচ্চারণ করেছেন, সেটিও বোঝা যায়।

Review of the Bengali movie Bohurupi

‘বহুরূপী’ ছবির একটি আবীর ও ঋতাভরী। ছবি: সংগৃহীত।

‘বহুরূপী’র দুই পুরুষের মধ্যে আবীরের চেয়ে শিবপ্রসাদ খানিক এগিয়ে থাকবেন অভিনয়ে। নাটকের পরিবারে জন্মেও আবীর কখনওই মঞ্চে অভিনয় করেননি। শিবপ্রসাদ এ দিকে প্রথম জীবনে লম্বা সময় কাটিয়েছেন ‘নান্দীকার’ নাট্যদলের সদস্য হয়ে। সুতরাং, স্বভাবতই তাঁর উচ্চারণে রাঢ়বাংলার টান প্রায় নিখুঁত শুনিয়েছে। অবীরের অভিনয়ে এমনিতে কোনও খুঁত নেই। কিন্তু, তিনি পেশাদার অভিনেতা। তার উপর টালিগঞ্জের নায়ক। বহু দিনের অভ্যাসে তিনি খানিকটা ছকে ফেলে নিয়েছেন নিজেকে। এটিও কিন্তু বাণিজ্যিক ছবির নায়কদের জন্য কখনও না কখনও একটি ফাঁদ তৈরি করতে পারে। সেই ফাঁদ কেটে বেরোনোও কিন্তু খুব সহজ নয়। আবীর হয়তো এই ছবিতে সেখানে খানিক আটকে গিয়েছেন। সেই জায়গায় শিবপ্রসাদ অনেক বেশি সাবলীল। তিনি কোনও মতেই ‘বাণিজ্যিক নায়ক’ নন। বাণিজ্যিক বাংলা ছবির পরিচালক। কিন্তু, যে হেতু এক সময়ের মঞ্চাভিনেতা, তাঁর অভিনয়ে তাই কোনও ছকই নেই।

দু’জনকে তাই পাশাপাশি অভিনয় করতে দেখলে পার্থক্যটি পরিষ্কার হয়ে যায়। এর সঙ্গে প্রশংসনীয় শিল্প নির্দেশক আনন্দ আঢ্যের কাজ। আনন্দ আগে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মতো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন। বুদ্ধদেবের শেষ ছবি ‘উড়োজাহাজ’-এর জন্য আনন্দ জমশেদপুরের অদূরে জঙ্গলের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের গোটা একটি জাপানি উড়োজাহাজ খাড়া করে দিয়েছিলেন। ‘বহুরূপী’তেও তাঁর সামান্য কাজের মধ্যে সেই পরিপাট্যের ছাপ বিদ্যমান।

এ ছাড়াও এই ছবিতে বেশ কিছু গাড়ি এবং দৌড়ে ধাওয়া করার দৃশ্য আছে, যেগুলি রুদ্ধশ্বাস। দিনের শেষে ‘বহুরূপী’ তো চোর-পুলিশের গল্পই! সুতরাং, ধাওয়া করার দৃশ্য থাকা অনিবার্য। তবে সে ভাবে শারীরিক ধাওয়া না থাকলেও, ‘ক্লাইম্যাক্স’ দৃশ্যটি জমাটি। সব মিলিয়ে ‘বহুরূপী’ আসলে সমাজে একেবারে হেরে যাওয়া মানুষের কিছুতেই হার না মানার কাহিনি, যা শেষ পর্যন্ত দর্শককে আসন আঁকড়ে রুদ্ধশ্বাসে বসে থাকতে বাধ্য করবে।আর দর্শক হিসাবে ভীষণ ভাল লাগবে সেই দৃশ্যটি, যেখানে অপরাধীর কাছে বুদ্ধির খেলায় হার মানতে বাধ্য হয় পুলিশ। আসলে ছবি যত এগোয়, দর্শক মনে গভীর ছাপ ফেলে বিক্রমের (শিবপ্রসাদ) মূল্যবোধ। চরিত্রটি অনায়াসে টেক্কা দেয় সুমন্ত (আবীর) চরিত্রটির চারিত্রিক ঋজুতাকেও। মাটির গন্ধ মাখা ‘বহুরূপী’ কী ভাবে যেন হয়ে ওঠে একটি জমজমাট পারিবারিক ছবি, যা অবাক করে দেবে দর্শককে, এ দাবি বোধ হয় করে ফেলাই যায় এখন।

আসলে এই ছবি সামাজিক ভাবে ব্রাত্য, প্রান্তিক প্রত্যেকটি হেরে যাওয়া মানুষের স্বপ্নের গল্পটি বলে। যেখানে সে নিজের রোয়াবে যুদ্ধটি শেষ পর্যন্ত জিতে যায়। এই স্বপ্নপূরণের ছবি যদি পুজোতে না দেখেন, তবে আর কবে দেখবেন?

আরও পড়ুন
Advertisement