কেমন হল অজয় দেবগনের ‘ময়দান’? ছবি: সংগৃহীত।
লেখাটা শুরু করার আগে একটা আর্জি জানাতে চাই। সব বাঙালি এক বার ‘ময়দান’ ছবিটা অবশ্যই দেখবেন। তার পর আবারও দেখতে ইচ্ছে করতে পারে।
বাঙালি আর ফুটবল— এই দুইকে সাধারণত আলাদা করা যায় না। আর এই দুটোর সঙ্গে পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় আর চুনি গোস্বামীর নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ‘ময়দান’ ছবিটা পিকে, চুনি, অরুণ ঘোষের উদ্দেশে শ্রেষ্ঠ সম্মান। প্রখ্যাত ফুটবল কোচ সৈয়দ আব্দুল রহিমের জীবনী অবলম্বনে ‘ময়দান’ ছবিটি বানানো হয়েছে। ১৯৫২ থেকে ১৯৬২-এর সময়কালে আব্দুল রহিমের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ভারতীয় ফুটবলকে বিশ্বের মানচিত্রে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল, সেটা আমরা এই ৩ ঘণ্টার সিনেমা দেখে জানতে পারি।
ছবি শুরু হয় হেলসিঙ্কি অলিম্পিক্সে ভারতীয় ফুটবল দলের যুগশ্লোভিয়ার কাছে হার দিয়ে। ভারতীয় দলের কোচ তখন ছিলেন রহিম সাহেব। নিজের যুক্তি দিয়ে টিম তৈরির সম্পূর্ণ অধিকার নিয়ে নেন তিনি। ভারত জুড়ে নিজে পরখ করে, নিজের হাতে ভারতীয় ফুটবল দল গড়ে তুলে, ১৯৫৬-তে অস্ট্রেলিয়া অলিম্পিক্সে চতুর্থ এবং ১৯৬০-এ রোম অলিম্পিক্সে চতুর্থ হন। কিন্তু কোয়ালিফাইং রাউন্ডে পৌঁছতে না পারায় কোচ রহিম সাহেবকে বহিষ্কার করা হয়। এর পর গল্প সেই দিকে অগ্রসর হয়, যেখানে আমরা দেখতে পাই কী ভাবে রহিম সাহেব সমস্ত প্রতিকূলতার ঊর্ধ্বে উঠে ভারতীয় ফুটবল দলকে জাকার্তা এশিয়ান গেমসে চ্যাম্পিয়ন বানান।
‘ময়দান’-এর সব থেকে বড় আকর্ষণ সিনেমার পার্শ্বশিল্পীরা। পিকের ভূমিকায় চৈতন্য চৌধুরী, চুনি গোস্বামীর ভূমিকায় কলকাতার অমর্ত্য রায়, এবং নেভিল ডি’সুজার ভূমিকায় সেই টলিউডেরই সন্তু, আরিয়ান ভৌমিক মনে বেশ দাগ কাটেন। নিঃসন্দেহে এই তিন জনের অভিনয় ছবির একটা বড় আকর্ষণ। প্রত্যেকটি দৃশ্যে এঁদের অভিনয় দর্শককে প্রভাবিত করবে। অভিনেতাদের সঙ্গে খেলোয়াড়দের চেহারার গঠনগত মিল খুঁজে পাওয়াই এই ছবির সব থেকে বড় প্রাপ্তি। রুদ্রনীল ঘোষ এবং গজরাজ রাও -এর বলিষ্ঠ অভিনয় নজর কাড়ে। রহিমের স্ত্রী সাইয়ার ভূমিকায় প্রিয়ামণিকে প্রত্যেক দৃশ্যে অদ্ভুত সপ্রতিভ লেগেছে । প্রিয়ামণির একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তাঁর নায়কদের সঙ্গে একটা খুব প্রয়াসহীন রসায়ন তৈরি করে নেওয়ার। সামনে শাহরুখ খান থাকুন বা অজয় দেবগন—উনি অনায়াসে নিজেকে তেল আর জলের মতো মিশিয়ে নেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অজয় দেবগন নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ‘ময়দান’ও তার ব্যতিক্রম নয়। ফিল্মে অজয়ের শরীরী ভাষা কখনও কখনও কোচ রহিমকে ছাপিয়ে গিয়েছে, এবং কিছু দৃশ্যে অজয় কেবল তাঁর চোখ দিয়ে অভিনয় করেছেন...অনবদ্য। চরিত্রায়নের সাফল্যের পিছনে আর একটি বড় কারণ, বেশিরভাগ অভিনেতা, যাঁদের খেলোয়াড় হিসেবে নেওয়া হয়েছে, তাঁদের ছবিতে বা অন্য কোনও মাধ্যমে খুব একটা দেখা যায় না।
অমিত রবীন্দ্রনাথ শর্মার পরিচালনায়, তুষারকান্তি রায় এবং ফয়দোর ল্যাসের সিনেমাটোগ্রাফি ‘ময়দান’-এর খুব বড় আকর্ষণ । ছবির শেষ ৩৫ মিনিট যে ফাইনাল ম্যাচ বড় পর্দায় দেখা যায়, তার পিছনে সিজিআই এবং ভিএফএক্স-এর অবদান অনেক। ইতিহাসের পাতা থেকে ফাইনাল ম্যাচ চোখের সামনে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। দেশাত্মবোধক ছবিতে এ আর রহমানের কম্পোজিশনের কোনও জুড়ি মেলা ভার। ‘ময়দান’ও তার ব্যতিক্রম নয়। ছবির আবহ এবং গান দর্শককে বেঁধে রাখে। তবে ছবিটি যে সম্পূর্ণ ত্রুটিবর্জিত, তা একেবারেই নয়। এক, দৈর্ঘ্য অনায়াসে ৪০ মিনিট কম করা যেত। আর কলকাতা মানেই কিন্তু কেবল হাওড়া ব্রিজ আর ট্রাম নয়, কারণ কলকাতা ময়দান এই ছবির একটা প্রধান চরিত্র। তাই শহরটাকে যদি একটু বিশদ ভাবে দেখানো হত, তা হলে অন্তত বাঙালিদের আরও ভাল লাগত।
ছবির শেষ বড় আকর্ষণ ক্রেডিট লিস্ট। ভুলেও তার আগে হল ছাড়বেন না। ২০১৮ সালে কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে পিকে-চুনির সঙ্গে পরিচালক অমিত শর্মা একটা অনবদ্য মন্তাজ শুট করেছিলেন, যা দেখে আপনার চোখে জল আসতে বাধ্য। জানা গেল, অমিত যখন এই বিশেষ শুটটি ২০১৮ -তে পরিকল্পনা করেন, তখন পিকে এবং চুনি দু’জনেরই শরীর যথেষ্ট খারাপ। কিন্তু তা-ও তাঁরা পূর্ণ সহযোগিতা করেছিলেন। সে দিনের কথা ভাবলে আজও শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে।