O Abhagi movie review

অভাগী আজও কঠিন সামাজিক সত্য! কেমন হল মিথিলার ‘ও অভাগী’? জানাচ্ছে আনন্দবাজার অনলাইন

মুক্তি পেয়েছে অনির্বাণ চক্রবর্তী পরিচালিত ‘ও অভাগী’। ছবির অনুপ্রেরণা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অভাগীর স্বর্গ’। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাফিয়াত রশিদ মিথিলা।

Advertisement
দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:২৭
Review of Bengali film ‘O Abhagi’ starring Rafiath Rashid Mithila

‘ও অভাগী’ ছবির একটি দৃশ্যে রাফিয়াত রশিদ মিথিলা। ছবি: সংগৃহীত।

Review of Bengali film ‘O Abhagi’ starring Rafiath Rashid Mithila

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্ভবত সেই বিরল বাঙালি লেখক, যাঁর একাধিক লেখা থেকে ব্যাপক সংখ্যক ছবি হয়েছে; এবং সে সব ছবি শুধু বাংলা বা হিন্দি ভাষাতেই আটকে থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে নানা ভাষায়, নানা প্রদেশেও। অনিবার্য ভাবে ‘দেবদাস’-এর নাম এ প্রসঙ্গে সবার আগে আসবে। সম্প্রতি অনির্বাণ চক্রবর্তী পরিচালিত ‘ও অভাগী’ দেখতে গিয়ে এ কথাটাই বার বার মনে পড়ছিল। ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পটি আমাদের স্কুলপাঠ্য ছিল। কোন প্রাসঙ্গিকতায় এত দিন পরও কয়েক পাতার সে গল্পকে প্রায় দু’ঘণ্টার সিনেমায় ধরলেন পরিচালক? কেন ধরলেন?

Advertisement

তরুণ পরিচালকের থেকে জানা গেল গল্পে ব্যাপক সংযোজন করেছেন তিনি। শরৎচন্দ্রের অভাগীর করুণ মৃত্যুর বদলে গোটা সমাজব্যবস্থার করুণ চেহারাটাকেই তুলে ধরেছেন পরিচালক। তাই এটি আর শুধু শরতের অভাগী থাকেনি, হয়ে উঠেছে তাঁর অভাগীও। সময়কাল বদলে, তাই ছবির সময়কাল সত্তরের দশকে এনে ফেলেছেন পরিচালক। জমিদারের বদলে

নেতা-বিধায়কদের দুর্নীতি থেকে শুরু করে হাজার হাজার অভাগীর মতো প্রান্তিক নারীদের আজও ন্যূনতম চাহিদার বিনিময়ে শোষণ করা সমাজের নানা চরিত্রদের মুখ যোগ করেছেন পরিচালক। সেখানে যেমন আছে জমিদারের শাগরেদরা, আছে পাড়া-প্রতিবেশী, চরিত্রহীন গায়েন ও তার একাধিক স্ত্রী-সহ অসংখ্য চরিত্র। আর আছে, এ ছবির প্রধান চরিত্র মৃত্যু, যার সঙ্গে বার বার যমরাজের ছদ্মবেশে দেখা হয়ে যায় অভাগীর। ছবির প্রথম দৃশ্য থেকেই ‘মৃত্যু’ই একমাত্র কামনা অভাগীর, ‘মৃত্যু’ই তাঁর ছায়াসঙ্গী, সহচরী, ‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতার মতোই ‘মৃত্যু’র সঙ্গেই গোটা ছবি জুড়ে দাবা খেলে যায় সে।

ছবির প্রথমার্ধ জুড়ে এই সব চরিত্র ঘিরেই গল্প এগোতে থাকে। দ্বিতীয়ার্ধে বস্তুত শরৎচন্দ্রের মূল গল্প অর্থাৎ অভাগীর মারা যাওয়া ও তার চিতার কাঠ কাটাকে ঘিরে বচসা ডালপালা মেলে। জানা গেল, অনুরাগ কাশ্যপের ‘দেব-ডি’ পরিচালকের প্রিয়তম ‘দেবদাস’-এর চলচ্চিত্রায়ণ। সে ধারা মেনেই এ ছবিতেও একাধিক কড়া যৌনমুহূর্ত রেখেছেন পরিচালক। জমিদার থেকে শাগরেদ বা গায়েন সকলেই ব্যাভিচারী। দুর্নীতিগ্রস্ত। শরৎচন্দ্রের মূল গল্পেও এ সবের আভাস আছে বলে মনে করেন পরিচালক। সে ক্ষেত্রে ছবিটা দেখতে বসে কি কোথাও মূল কয়েক পাতার গল্পের থেকে অতিরেক মনে হয় এ ছবিকে?

Review of Bengali film ‘O Abhagi’ starring Rafiath Rashid Mithila

‘ও অভাগী’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

অভাগীর স্বামীর কথা মূল গল্পে যতটা আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি এ ছবিতে। লম্পট চরিত্রের সেই গায়েনকে কি আর একটু কমিয়ে আনা যেত? তার বদলে কি অভাগীর মারা যাওয়ার পর তার শিশুটির অসহায়তাকে আর একটু বেশি দেখানো যেত? ছবিটি দেখতে দেখতে মনে এল এ প্রশ্ন। কারণ শরৎচন্দ্রের মূল গল্পে সেই অসহায়তা অনেকটাই বেশি। এ ছবিতে পরিচালক যদিও অভাগীর ‘পাথরে পাথর’ ঘষা জাতীয় সংলাপকে শিশুটির মুখে ফিরিয়ে এনে, তাকে বিস্তার করেছেন। কিন্তু মনে হল, অরণ্যে ও সমাজে অসহায় শিশুটি, মা মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই ‘সংসারে বুড়া’ হয়ে যাবার যে দ্যোতনা, তা হয়তো আর একটু দেখতে পেলে ভাল লাগত। কারণ এই ‘বোহেমিয়ানিজ়ম’ শরতের অন্যান্য লেখারও প্রধান বীজ।

এ ছবির প্রযোজক প্রবীর ভৌমিক পেশায় শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। কথা বলে জানা গেল, অনাথ শিশুদের জন্য অনেকগুলি হাসপাতাল তৈরি করেছেন তিনি। দীর্ঘ দিন ধরে আপসহীন ভাবে শিশুদের চিকিৎসা করে আসছেন। অভাগীর পরিণতি যাতে না হয় আর কারও, এই কর্পোরেট চিকিৎসা ব্যবস্থার দিনে টাকার অভাবে যাতে একটি শিশুরও মৃত্যু না হয়, সে জন্যেই তিনি চেয়েছিলেন এ গল্পকে সকলের সামনে তুলে ধরতে।

এ ছবির বিশেষ কয়েকটি প্রিয় মুহূর্তের কথা বলি। যমরাজের সঙ্গে অভাগীর দেখা হওয়ার প্রতিটি মুহূর্তের মন্তাজ, যেখানে যৌনতার সঙ্গে শ্মশান একাকার— তা চমৎকার! অরণ্যে মা-হারা সন্তানের হাহাকারের মুহূর্তে ক্লোজ় আপে শিশুটির মুখ এবং নেপথ্যে সারি সারি গাছপালার মুহূর্তটিও মনে দাগ কেটেছে। অভাগীর জমিদার গিন্নির মারা যাওয়ার পর পায়ের আলতা মেখে চলে যাওয়ার বাসনার ‘মোটিফ’টিকে সুচারু ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মিথিলা। কাঠের বিছানায় তাঁর শয্যার শটটি ভাল। তবে গ্রামের দুর্নীতির চেহারাটা আরও নানা ঘটনা দিয়ে বোঝানোর অবকাশ ছিল, সেখানে মূল গল্পে যে হেতু যৌন ব্যাভিচার বোঝাতে শরৎচন্দ্র বাঘ আর বাঘিনীর রূপক ব্যবহার করেছেন, তাই নেতা-বিধায়ক থেকে তাদের শাগরেদ ও গায়েন সকলের যৌন উন্মাদনার বার বার ব্যবহার কিছুটা একঘেয়ে লাগে। যেমন কিছুটা প্রত্যাশিত মনে হয়, ছবির শুরুতে গাছের কাঠের অভাবে হিন্দুদের কবর দেওয়ার প্রসঙ্গটি। যেন পরিচালক চোখে আঙুল দিয়ে বলছেন, এর পর একই রকম একটা ক্লাইম্যাক্স আসতে চলেছে, প্রস্তুত থাকুন।

অভাগীর চরিত্রে মিথিলার মুখ ইতিমধ্যেই শহরে ছেয়ে গেছে। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁকে মানিয়েছে এ চরিত্রে। এক দিকে যেমন অভাগী লাবণ্যময়ী, অন্য দিকে সে অসহায়। এই দু’দিককেই ফুটিয়ে তুলেছেন মিথিলা। ভাল লাগে জমিদার শাগরেদ কেষ্টর চরিত্রটিও। গ্রামের মহিলাদের তুলে আনাই হোক বা অভাগীর মারা যাওয়ার পর তার স্বামী ও শিশুটির সঙ্গে মারামারি— তার নিষ্ঠুরতার তুলনা নেই। সায়ন অভিনীত গায়েনের চরিত্রটির কথা আগেই বলেছি। এবং অবশ্যই জমিদার ও জমিদার গিন্নির চরিত্রে সুব্রত দত্ত ও দেবযানী চট্টোপাধ্যায়র অভিনয় ভাল লাগে। ছবিতে একাধিক গান রয়েছে। রূপঙ্করের গাওয়া গানটি বা বাংলাদেশের অনিমেষ রায়ের গাওয়া গানগুলির ব্যবহার ভাল লাগে। আর সুজয় দত্ত রায়ের সম্পাদনা এ ছবির মেরুদণ্ড।

লেখাটি শুরু হয়েছিল শরৎচন্দ্রর প্রাসঙ্গিকতার কথা দিয়ে। সকালে আর এক বার ‘অভাগীর স্বর্গ’ পড়তে গিয়ে এবং বিকেলে ছবিটি দেখতে দেখতে, এক বারও মনে হল না পিরিয়ড ছবি দেখছি। মনে হল, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এ সময়ের লেখক। আগামী একশো বছরও তিনি সময়ের সঙ্গে এ ভাবেই সংলাপ জারি রেখে যাবেন, নিত্য... কারণ অভাগীরা যুগে যুগে আজও বেড়েই চলেছে এবং চলবে...

আরও পড়ুন
Advertisement