‘ঘুমর’ ছবির একটি দৃশ্যে অভিষেক বচ্চন এবং সইয়ামি খের। ছবি: সংগৃহীত।
ছবিটা দেখতে বসে বার বার একটা প্রশ্নই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। অভিনেত্রী সইয়ামি খের কি সত্যিই বাঁহাতি না কি তিনি ডানহাতি? কারণ মানুষের দুই হাতই নাকি জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলে। সেখানে কোনও একটি হাতের অনুপস্থিতিতে ব্যক্তির কাছে জীবনের অর্থটাই বদলে যাওয়া স্বাভাবিক। তার সামনে হাজির হয় অসম লড়াই। সেই লড়াই জেতার এক আখ্যানকেই তাঁর কেরিয়ারের প্রথম স্পোর্টস ড্রামা ‘ঘুমর’-এ তুলে ধরেছেন পরিচালক আর বালকি।
প্রতিভাবান ক্রিকেটার আনিনা (সইয়ামি খের)। দলের হয়ে ওপেন করে। পরিশ্রমে ভর করে ইংল্যান্ড ট্যুরে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট টিমের জায়গাও পেয়ে যায়। এ দিকে ট্যুরের মাত্র দু’দিন আগে এক মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয় আনিনা। কাঁধের কিছুটা নীচ থেকে ডান হাত বাদ যায় অস্ত্রোপচারে। সেই সঙ্গে দূরে সরে যায় দেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন। কিন্তু ক্রিকেট তো শুধু ব্যাটস্ম্যানদের খেলা নয়। সেখানে বোলারও তো রয়েছে। আনিনাকে স্পিন বোলার হিসেবে জাতীয় দলে পৌঁছে দিতে তার পাশে দাঁড়ায় পদম সিংহ সোধি ওরফে প্যাডি (অভিষেক বচ্চন)। ‘ঘুমর’ শব্দটির অর্থ বৃত্তাকারে ঘোরা। মনের জোর থাকলে যে আবার ঘুরে দাঁড়ানো যায় সেই কথাই বলে।
ছবিতে ছোট পরিসরে অনেক বড় বার্তা দিতে চেয়েছেন বালকি। পেশাদার ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে এক জন মহিলা ক্রিকেটারের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। এই রকম একটি চরিত্র অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। চরিত্রে প্রবেশ করতে সইয়ামিকে দুটো রাস্তাকে মেলাতে হয়েছে। এক দিকে ক্রিকেটারের চরিত্র। অন্য দিকে রয়েছে বাঁ হাতে বিশ্বজয়ের মতো কঠিন পরীক্ষা। সেই লড়াইয়ে তাঁর অভিনয় মন্দ নয়। ছবির জন্য প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার মুরলী কার্তিকের কাছে দীর্ঘ দিন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সইয়ামি। সেই পরিশ্রম পর্দায় ধরা পড়েছে। তবে আবেগপ্রবণ দৃশ্যে তাঁর অভিনয় কোথাও কোথাও একটু উঁচু তারে বাঁধা। সইয়ামি যদি ছবির একটি স্তম্ভ হন, তা হলে বিপরীতে রয়েছেন অভিষেক বচ্চন। দু’জনের সমীকরণ এই ছবির অন্যতম আকর্ষণ। ১৯৯৫ সালে দেশের হয়ে একটি মাত্র টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ পাওয়া এবং অধুনা মদ্যপ একাকিত্বে ডুবে থাকা বদমেজাজি কোচের ভূমিকায় অভিষেক বচ্চন ছক্কা হাঁকিয়েছেন। এক দিকে ক্রিকেটের প্রতি প্যাশন ও দূরত্ব এবং অন্য দিকে শিষ্যের মাধ্যমে সেই জয় ছুঁয়ে দেখতে চায় প্যাডি। মদ্যপ অভিষেকের মুখে, ‘‘দর্শকের কাছে স্পোর্টস শুধু একটি খেলা। কিন্তু যাঁরা খেলে তাঁদের কাছে সেটা স্বার্থত্যাগ’’— এই সংলাপ চরিত্রটির মধ্যে জমে থাকা আগুনকে চিহ্নিত করে।
ছবিতে আনিনার ঠাকুমার চরিত্রে ক্রিকেট উৎসাহী শাবানা আজ়মিকে দর্শকের পছন্দ হবে। নাতনির প্রতি নিবেদিতপ্রাণ তাঁর চরিত্র। তবে ছবির দ্বিতীয় ভাগে তাঁকে খুব একটা পাওয়া গেল না। আনিনার বাল্যবন্ধু থুড়ি প্রেমিকের চরিত্রে অঙ্গদ বেদীর অভিনয় বিশ্বাসযোগ্য। এই ছবির মাধ্যমেই সিনেমাকর্মী শিবেন্দ্র সিংহ দুঙ্গারপুর বলিউডে পা রাখলেন। আনিনার বাবার চরিত্রে তাঁর খুব বেশি কিছু করার ছিল না। স্বল্প পরিসরে রূপান্তরকামী অভিনেতা ইভাঙ্কা দাস দর্শককে ভালই হাসিয়েছেন। সব শেষে ছবির সবচেয়ে বড় চমক— অমিতাভ বচ্চন। ছবিতে তিনি ক্রিকেট ধারাভাষ্যকারের ভূমিকায়। সত্যি বলতে তাঁর অভিনয় এবং সংলাপে ভর করেই ছবির ক্লাইম্যাক্স আরও উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার বিষেণ সিংহ বেদীকেও এক ঝলক দেখা গিয়েছে। তবে তিনি অঙ্গদের বাবা বলেই অভিনয় করতে রাজি হয়েছেন বলে মনে হয়।
এ বার কয়েকটা কথা না বললেই নয়। স্পোর্টস ফিল্ম হিসাবে বালকি কিন্তু খুব ভাল রকম প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু বাদ সেধেছে ছবির চিত্রনাট্য। গল্পে কী ঘটতে চলেছে, তা দর্শক অনেক আগে থেকেই অনুমান করে নেওয়া যায়। তবুও মন্দের ভাল, সেখানে কিছু চমক রাখার চেষ্টা করেছেন পরিচালক, তবে তা যথেষ্ট নয়। প্রথমার্ধ খুবই ধীর গতির। আসলে আনিনার লড়াইকে প্রতিষ্ঠা করতেই তিনি বেশি সময় নিয়েছেন। ফলে দ্বিতীয়ার্ধে দ্রুত তাঁকে লাটাই গোটাতে হয়েছে। ফলে ক্রিকেট যে আদতে একটা টিম গেম সেটাই ছবিতে ধরা পড়ল না। তৈরি হল না আরও একটা ‘চক দে ইন্ডিয়া’ গোত্রের ছবি। আসলে পরিচালক এখানে ক্রিকেটের তুলনায় জীবনে হার না মানা মানসিকতার উপরে জোর দিয়েছেন বেশি। তাই এই ছবি যে অনুপ্রেরণা জোগাবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। দুঃখের বিষয়, ‘গদর ২’ এবং ‘ওএমজি ২’ এ ভিড়ে এই ছবি প্রেক্ষাগৃহে শেষ পর্যন্ত কতটা জায়গা পাবে, সেটাই দেখার।