‘হীরামন্ডি’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।
‘গরম লাগলে তিব্বত গেলেই পার’, সুকুমার রায় কবেই তো বলে গিয়েছেন! সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিরিজ় ‘হীরামন্ডি’ দেখে মনে হল, সুকুমারের লাইনটি আর একটু বদলে নিলেও মন্দ না, অর্থাৎ, গরম লাগলে সার্কাস গেলেই পারো! বা, গরম লাগলে ফ্যাশান শো যেতেও পারো! জানি অনেকেই হাসছেন। কয়েক জনের মনে হচ্ছে, সঞ্জয় লীলা ভন্সালীকে নিয়ে মশকরা! দু’শো কোটি টাকা বাজেট না হলে, রাজা-মন্ত্রী-গঙ্গুবাই-দেবদাসদের মহাকাব্য না হলে, যিনি ছবি বানানোর আগ্রহই পান না, তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা? ভারতে প্রাপ্তবয়স্ক বিপুলায়তন মার্ভেল কমিক্স, নিদেন ‘গেম অফ থ্রোনস’ বানাতে হলে বিদেশি ওয়েব প্ল্যাটফর্ম কাকে ডাকবে? ওই ভন্সালীকেই তো? তাকে নিয়ে মজা মারতে এসেছে? মার মার মার...
মার্জনা চেয়েই বলছি, ভন্সালীর এ সিরিজ় অত্যন্ত একঘেয়ে। সেকেলে। অবশ্য, ‘সেকেলে’ অনেক কিছুই স্মার্ট হয়। ভন্সালীর আগের কিছু কাজেও কি তার প্রমাণ নেই? নিশ্চিত আছে। কিন্তু ‘হীরামন্ডি’ দেখতে বসে পঞ্চম এপিসোডের পর ঘুম পায়। বোর লাগে। কিছুতেই এগোনো যায় না। এগোনো কষ্টকর মনে হয়। তার কারণ শুধু এই নয় যে, আজকের ভারতে এ সব গল্প অচল। প্রাক্-স্বাধীনতা যুগের লাহোরের ব্রিটিশ বনাম দেহোপজীবিনী বনাম নবাবদের গল্প আজও ধ্রুপদী হতে পারে। না হলে আজও শরদিন্দু বা অবন ঠাকুর আমরা পড়ি কেন? কেনই বা ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ বা ‘লগান’-এর মতো ছবি বা ‘দ্য ক্রাউন’-এর মতো সিরিজ় আজও ভাল লাগে আমাদের? সমস্যা পিরিয়ড ছবি নিয়ে নয়। সমস্যা, তা দেখানো নিয়ে। এবং আজকের সময়ে তা কী ভাবে দেখানো হবে, তা নিয়ে।
দুর্ভাগ্য, এই দু’টি প্রশ্নেই এ কাজে ল্যাং খেয়েছেন ভন্সালী। বুঝতে হবে, বিশালায়তন সেট আর বিপুলায়তন ঘটনা সিরিজ়ের জমানায় অচল। বিশেষত, অসংখ্য চরিত্র আর অনেক ঘটনার আড়ালে কোনও মূল থিম না থাকলে থ্রিলারে মজে থাকা আমাদের হতাশ লাগতে বাধ্য। সে কারণেই তিন ঘণ্টার ছবির বদলে লোকে থ্রিলারকে বেছে নিয়েছে। সে কারণেই ভন্সালীসুলভ মহাকাব্যের বদলে ছোট ছোট মানুষের ছোট ছোট গল্পকেই বেশি ভালবাসছেন দর্শক। কিন্তু এ সিরিজ়ে সে সব কিছুকে পাত্তা না দিয়ে ভন্সালী বানিয়েছেন তাঁর মর্জিমাফিক মহা-উপন্যাস। যা দেখতে দেখতে কোথায় যে মাথা আর কোথায় ল্যাজা, গুলিয়ে যায়! টিভি-সিরিয়ালের শাশুড়ি-বৌমার কাজিয়া না দেশাত্মবোধের বিদ্রোহ— ঠিক কী হয়ে উঠতে চায় ‘হীরামন্ডি’ বুঝতে বুঝতেই ঘুম পেয়ে যায়। আর, শেষ এপিসোডটা দেখা হয়ে ওঠে না!
শ্যাম বেনেগল ‘মন্ডি’ নামের একটি ছবি তৈরি করেন ১৯৮৩ সালে। প্রায় এ সিরিজ়ের কাছাকাছি একটি গল্পকে ঘিরে। সেখানে অবশ্য ইংরেজদের বদলে দেহোপজীবিনীদের সঙ্গে কাজিয়া বাধে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের। দু’টি ছবি পাশাপাশি রেখে দেখলে অবাক হই, কয়েক দশকের মধ্যে আমাদের সিনেমা ব্যক্তি থেকে সরে গিয়ে ‘সেট ডিজ়াইন’ বা সাজগোজকেই মুখ্য ভাবছে! কোটি টাকা খরচ করে সেট, আলো, নাচ, গান, প্রচারই মুখ্য হয়ে উঠছে। ধ্রুপদী ঘরানাকে অটুট রাখতে দামি-দামি ভিএফএক্স আর মূল্যবান মেটা-দুনিয়ার নীচে হারাচ্ছে ব্যক্তিমানুষের স্বাভাবিক সঙ্কট। শিল্প হয়ে উঠছে আইপিএল। ক্রিকেট ও শিল্পের মজাটাই চলে যাচ্ছে তার পর।
প্রাক্-স্বাধীনতা পর্বের এ সিরিজ়ের গল্প বাস্তব অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে। মূল গল্পটি মইন বেগের। দেহোপজীবিনীদের সঙ্গে নবাবদের সম্পর্ক ঘিরেই এ সিরিজ়। প্রথমে মনে হয়, তাদের রেষারেষি চাওয়া-পাওয়াকে ঘিরেই গল্প এগোবে। মনীষা কৈরালা অভিনীত দেহোপজীবিনীদের সম্রাজ্ঞী আর তাঁর বিরোধী সোনাক্ষী সিন্হা অভিনীত ফারিদানকে ঘিরে গল্প এগোতেও থাকে। তাঁদের সন্তানজন্ম, বিক্রিবাটা, নবাবদের সঙ্গে প্রেম ও শরীরচক্রকে ঘিরে গল্প ডালপালা মেলতে থাকে নানা ভাবে। মাঝেমাঝে মনে হয়, প্রাচীন যুগের শাশুড়ি-বৌমা কাজিয়াই কি চলত প্রাক্-ব্রিটিশ পর্বে শুধু? অচিরেই ‘দস্যু মোহন’ সাহিত্য সিরিজ়ের মতো নবাব আর ব্রিটিশদেরও আগমন ঘটে তার পর। কখনও ব্রিটিশদের সঙ্গে দেহোপজীবিনীদের শরীর আর নবাবদের সঙ্গে মন লেনদেন চলতে থাকে অকাতরে। আবারও এই অধমের মনে হয়, ‘অহো! ব্রিটিশ আর নবাবরা কি এতই প্রেমিক ছিল তা হলে? ভারতে এসে তাদের একমাত্র কাজ কি ছিল প্রেম করা?’
দামি ভিএফেক্সে এর পর ভন্সালী স্টাইলে লাহোর নগর দেখা যায় বটে। কিন্তু সেখানে ব্রিটিশদের চেয়েও বেশি ভন্সালীর রাজত্ব যেন, এতই পরিপাটি ও রঙিন সে নগরের বিদ্রোহ, মিছিল, ‘ইনকিলাব’ বলা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চেহারা... তাদের গল্পে আসার সঙ্গে সঙ্গেই কোথায় যেন হারিয়ে যায় দেহোপজীবিনীরা! শেষের কয়েকটি পর্বে মুখ্য হয়ে ওঠে ব্রিটিশ বনাম স্বাধীনতা সংগ্রাম। হারিয়ে যায় ভন্সালীর শাশুড়ি-বৌমার বিশালায়তন মার্ভেল কমিক্স। ব্রিটিশ তাড়ানো আইপিএল শুরু হয়।
এত কিছুর পরেও ভাল লাগে মনীষা কৈরালা, সোনাক্ষী সিন্হা, অদিতি রাও হায়দরি, শেখর সুমন, ফারদিন খানদের। চিত্রগ্রহণের জন্য বিশেষ সাধুবাদ প্রাপ্য সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের। এ ছাড়াও, সেটের স্থাপত্যের ব্যবহার আর নৃত্য পরিচালনার জন্য এ ছবি সাধুবাদ পাবে। কিন্তু তার প্রয়োগেই তো সমস্যা!
সেট, প্রপস, নাচ, গান দেখতে তো সার্কাসেও যাওয়া যায়। অথবা সুন্দর নরনারী দেখতে পাওয়া যায় ফ্যাশন শোয়ে! অবশ্য নেটফ্লিক্স আগাম সতর্কতা জারি করেছে, এ ছবিতে নেশার দ্রব্য, মারামারি, প্রাপ্তবয়স্ক ‘কন্টেন্ট’ আছে। কিন্তু এ সব নেটফ্লিক্সে দেখতে দেখতে এতই ক্লান্ত হয়ে যান দর্শক, যে তখন মনে হয়, গরম লাগলে সরাসরি তিব্বত যাওয়াই ভাল।