‘জয়ল্যান্ড’ ছবির দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
‘‘তুমি সমুদ্র দেখেছ কোনও দিন?’’ হায়দরকে জিজ্ঞেস করে বিবা। ‘‘না’’, উত্তর দেয় হায়দর। ‘‘আরও একটু রোজগার করে টাকা বানিয়ে নাও। তার পর আমরা এক দিন সমুদ্র দেখতে যাব করাচিতে’’, বলে বিবা। বিবার বিবর্ণ অন্ধকার ঘরে বসে আছে হায়দর-বিবা। একটি আলোর বলের বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে পড়ছে ঘরময়, যা তাদের প্রেমের সম্পর্কের মতো ঘরটিকেও মায়াবী করে রেখেছে।
বিবা এক আগ্রাসী রূপান্তরকামী। লাহোরের একটি এরোটিক নৃত্য থিয়েটারে নাচে। সেখানে টাকা রোজগারের জন্য আসে বিবাহিত হায়দর। সে নাচতে পারে না। তবে চেষ্টা করে যায়। টাকার জন্য এটুকু করতে পারবে না সে? সেখানেই বিবার সঙ্গে হায়দরের আলাপ। এবং প্রেম।
হায়দর লাহোরের একটি মোটামুটি সচ্ছল যৌথ পরিবারের ছোট ছেলে। তার চাকরি নেই। কিন্তু তার স্ত্রী মুমতাজ চাকরি করে। দুটো ঠান্ডা মেশিন কিনে ঘরে লাগাবে, এই মুমতাজের ইচ্ছে। দুটো কারণ, আব্বার ঘরে না লাগিয়ে নিজেদের ঘরে লাগানো যাবে না। পরিবারের মাথা আব্বা। বড় ছেলে সেলিম ছেলের আশায় এই নিয়ে চতুর্থ বার তার স্ত্রী নুচ্চিকে অন্তঃসত্ত্বা করেছে। কিন্তু এ বারও হয়েছে সেই মেয়ে। তবে তাই নিয়ে পরিবারে যে বিশেষ অসন্তোষ আছে, তা নয়। সেটা দেখা যায় না। কারণ, অসন্তোষটা ভিতরে। আচরণে।
অবশ্য হায়দর-বিবার প্রেম কোনও পরিণতি পায় না। একে পরকীয়া, তার উপর রূপান্তরকামীর সঙ্গে প্রেম! পাকিস্তান যে ‘জয়ল্যান্ড’কে (যেটা এ বছর পাকিস্তানের অস্কারের জন্য মনোনীত ছবি) দেশে নিষেধাজ্ঞার নিদান দেবে, এ তো জানা কথাই।
আসলে পরিচালক সাঈম সাদিকের ‘জয়ল্যান্ড’ সমাজকে যে সব কীট কুরে কুরে খায়, তার সবই সামনে আনে। কিন্তু খুবই সূক্ষ্ম ভাবে। কোনও বড় বড় কথা নেই। নেই কোনও বক্তৃতা। শুধু আছে কয়েকটা সংলাপ। এবং দৃশ্য। যেমন, নাচের অনুষ্ঠানের ঠিক আগের মুহূর্তে বার বার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
হায়দরদের যৌথ পরিবার পুরোপুরি পিতৃতান্ত্রিক। কিন্তু সূক্ষ্ম ভাবে। যেই হায়দরের চাকরির খবর আসে, সেই আব্বা পুত্রবধূ মুমতাজকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলে। অথচ মুমতাজ বিয়ের আগেই হায়দারকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছিল, বিয়ের পর সে চাকরি করতে পারবে কি না। তখন সে উত্তর পেয়েছিল ‘‘তোমার যা ইচ্ছে।’’ চাকরি ছাড়ার পর মুমতাজ মুখে কিছু বলে না। মানিয়ে নেয়। আর কী-ই বা করতে পারে সে?
পরিচালক শুধু যে মেয়েদের সমাজের পরাধীনতার শিকার হিসেবে দেখিয়েছেন, তা নয়। যেমন হায়দারকে তিনি অন্য রকমের পুরুষ দেখিয়েছেন। চলতি অর্থে তার ‘পৌরুষ’ নেই। সে নম্র। অনুভূতিপ্রবণ। বিবা যখন বলে সে টাকা পেয়ে অপারেশন করিয়ে পূর্ণ নারী হবে, হায়দর তাকে বলে যে, বিবা যেমন, তাকে তেমনই ভালবাসে হায়দার। নরম-সরম হায়দরকেও তার দলের অন্য পুরুষরা খেপায়— ‘বিবার অন্তর্বাসের তলায় কী আছে বল’, ‘সত্যিকারের স্তন’?
এ রকম নানা দৃশ্যে পরিচালক সূক্ষ্ম ভাবে সমাজের বিরুদ্ধে নিজের মন্তব্য রেখে যান। যখন সারা পৃথিবী জুড়ে রূপান্তরকামীদের সমানাধিকার আইন নিয়ে সংগঠন এবং ব্যক্তি নির্বিশেষে সবাই লড়ে যাচ্ছেন, সেখানে এখনও পাকিস্তানের সমাজ কী ভাবে তাঁদের কোণঠাসা করে রাখছে, সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখান পরিচালক।
ছবির ক্লাইম্যাক্স শান্ত বোমার মতো ফাটে। মুমতাজ অন্তঃসত্ত্বা। ডাক্তার বলেছে, তার ছেলে হবে। সেই আনন্দে সবাইকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছে আব্বা। এর মধ্যে আব্বার কথা, ‘এক জ্যোতিষী বলেছিল, আমার পরিবারে হায়দারই শেষ ছেলে’ যেন চূড়ান্ত এক সমাপতন নিয়ে আসে। মুমতাজ ছিল মুক্তমনা। তাই সে নিজেই ঠিক করে তার ভবিতব্য। বাথরুমের সিস্টার্নের ভিতর লুকোনো বিষ খেয়ে সে এই সমাজের মেয়েদের বিরুদ্ধে বাধানিষেধ, পরিবারের পিতৃতান্ত্রিক নিয়মের হাত থেকে ‘বেঁচে’ যায়। তখনও অবশ্য তার ভাসুর সেলিম বলে, ‘‘কী করে আমার ভাইয়ের ছেলেকে মেরে ফেলল সে!’’
দম বন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যে দুই জা — মুমতাজ আর নুচ্চির একে অপরের প্রতি ভালবাসা আর বন্ধুত্বের সম্পর্ক একঝলক টাটকা বাতাসের মতো আসে ছবিতে। একমাত্র মুমতাজের সামনেই বড় জা নুচ্চির লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া, আনন্দের জন্যে জয়ল্যান্ড নামে এক পার্কে দু’জনের ঘুরতে যাওয়া— এই বাঁধন সুন্দর, সরল, অকপট।
ছবির অভিনয় অসাধারণ। আলি জুনেজো (হায়দর), রাস্তি ফারুক (মুমতাজ), আলিনা খান (বিবা), শরওয়াত গিলানি (নুচ্চি), সমীর সোহেল (সেলিম) এবং সলমন পীরজ়াদা (আব্বা)— মনে রাখার মতো অভিনয় করেছেন। ছবির চিত্রগ্রহণ দুর্দান্ত। সাঈমের লাহোর ধূসর, ঘিঞ্জি, অন্ধকার। ছবির বিষয়বস্তু এবং মেজাজের মতোই।
অতঃপর, হায়দর সমুদ্রে চলেই যায়। ছবির শেষ দৃশ্য অপর্ণা সেনের ‘যুগান্ত’র শেষ দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়।