‘জঙ্গলে মিতিন মাসি’ ছবিতে কোয়েল মল্লিক। ছবি: সংগৃহীত।
যে দিকে চোখ যায়, শুধুই জঙ্গল। আঁকাবাঁকা সরু পথ। জঙ্গল জুড়ে নানা রকম পশুপাখির বাস। মাঝে একটা ঝিল। বেশ কয়েকটা হরিণ নিরিবিলিতে জল খাচ্ছে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে আরও অনেক প্রাণী লুকিয়ে রয়েছে। তাদের সময় মতো তারাও হয়তো জল খেতে আসবে। পুজোর ছুটিতে এমন একটা জায়গায় ঘুরতে গেলে মন্দ হত না, বলুন? কিন্তু যদি না যেতে পারেন, তা হলে অরিন্দম শীল পরিচালিত ‘জঙ্গলে মিতিন মাসি’ দেখলেও চলবে। কারণ, সেখানেও যত দূর দেখবেন, ফ্রেমে শুধুই জঙ্গল। দু’ঘণ্টার ‘জঙ্গলে মিতিন মাসি’ ছবির বেশির ভাগ জুড়ে রয়েছে অরণ্য।
সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সৃষ্টি ‘মিতিন মাসি’র বেশির ভাগ গল্প ছিল ছোটদের জন্য। তবে অরিন্দম শুধু ছোটদের জন্য ছবি বানান না। সাহিত্য-নির্ভর ছবি তাঁর বিশেষ পছন্দের। তাই যখন কোনও উপন্যাস অবলম্বনে তিনি চিত্রনাট্য সাজান, পরিচালক চেষ্টা করেন যাতে সব বয়সের দর্শকই সেই ছবি উপভোগ করেন। অতীতে তাঁর ফিল্মোগ্রাফিতে চোখ বোলালেও তার প্রমাণ মিলবে ভূরি ভূরি। এ বারও তিনি ‘সারান্ডায় শয়তান’ গল্পটির আধারে নিজের মতো করে ‘জঙ্গলে মিতিন মাসি’র চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন। ২০১৯-এর পর দ্বিতীয় বার পর্দায় মিতিন হয়ে ফিরেছেন কোয়েল মল্লিক।
পরিচালক এবং নায়িকা দু’জনেই যেন এ বার যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েই লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছেন। তাঁরা জানেন, প্রতিদ্বন্দ্বীরা এ বার খুব জোরালো। সেই পর্দায় মিতিনের প্রতিদ্বন্দ্বী আন্তর্জাতিক চোরাশিকারির দলই হোক, কিংবা পর্দার বাইরে মুক্তিপ্রাপ্ত বাকি তিনটে হেভিওয়েট ছবিই হোক। তাই কোনও রকম ফাঁকফোকর ছাড়তে চাননি তাঁরা। পরিচালক চিত্রনাট্যের গতি বাড়িয়েছেন। মিতিন মাসি এখন আর বসে বসে শুধু বুদ্ধিতে শান দেয় না। সে সব সময়ই ফ্রন্টলাইনে। বাকিদের আগলে নিজেই এগিয়ে যায়, ঝাঁপিয়ে পড়ে সব বিপদের মধ্যে। কিন্তু থামে না। সব শত্রুর বিনাশ করে তবেই তার শান্তি। গোটা ছবি জুড়ে মিতিন ছুটছে। সঙ্গে দর্শককেও তাল মেলাতে হচ্ছে তার সঙ্গে। কখনও কখনও মিতিনের গতির সঙ্গে পেরে না উঠে তাঁরা হোঁচট খেতে পারেন। কিন্তু পিছিয়ে পড়লে চলবে না।
ঠিক তেমনই কোয়েল মল্লিকও রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নেমেছেন। তিনি জানেন, পরিচালক এ বার অল্পতে মোটেই সন্তুষ্ট নন। আগের বারের চেয়েও তিনি বেশি কিছু প্রত্যাশা করেন তাঁর মিতিনের কাছে। তাই কোয়েল সব দিকে দিয়ে তৈরি। পুলিশের আগেই অপরাধীকে ধাওয়া করতে হবে? সবাইকে পিছনে ফেলে একাই এক দল গুন্ডাদের সঙ্গে মারপিট করতে হবে? চুপিসারে বন, জঙ্গল, পাহাড় পেরিয়ে রহস্যের সমাধান খুঁজতে হবে? গোটা বন দফতর থাকতেও কারও সাহায্য ছাড়াই একা অসহায় হাতিদের নৃশংস চোরাশিকারিদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে? কোয়েল নিজেকে এমন ভাবে তৈরি করেছেন যাতে পরিচালক যা বলবেন, তা-ই তিনি নিখুঁত ভাবে পালন করতে পারেন। তিনি যে এই চরিত্রের জন্য নিজের ফিটনেসের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন, তা পর্দায় তাঁকে দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন। পরিচালক সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন। এবং হয়তো একটু বেশিই অ্যাকশন করিয়েছেন কোয়েলকে দিয়ে। কিন্তু না করেই বা উপায় কী! ‘লার্জান দ্যান লাইফ’ না হলে গোয়েন্দারা এখন যে আর পাত্তা পায় না। আর নয়নতারা করতে পারলে, কোয়েলই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন? অগত্যা ভরসা মিতিন মাসির অ্যাকশন।
অরণ্যের রূপ, টানটান রহস্য, বিক্রম ঘোষের অসামান্য আবহসঙ্গীত, মানানসই দৃশ্যে বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’-এর উল্লেখ, সপরিবার বেড়ানো, খানিক ইতিহাস, খানিক ভূগোল, খানিক রাজনৈতিক মতাদর্শ— রয়েছে সবই। সঙ্গে রয়েছে স্পষ্ট বার্তা। এই ছবিতে জঙ্গল যেমন একটি চরিত্র, প্রকৃতির সংরক্ষণের বার্তাও যেন একটি চরিত্র। এবং মাঝেমাঝে সেই চরিত্র একটু বেশি স্ক্রিন টাইম পেয়ে গিয়েছে। তাই, সেগুলি দর্শকের মন ছুঁয়ে যাওয়ার বদলে কিঞ্চিৎ বিরক্তি কারণ হতে পারে। তদন্তের বেশ কিছু জায়গা কাকতালীয় লাগতে পারে। কিশোর সাহিত্যে সেগুলো না-দেখা করা যায়। কিন্তু পরিচালক ছবি বানান প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। তার উপর তিনি থ্রিলারে সিদ্ধহস্ত। তাই তাঁর কলম থেকে প্রত্যাশা আরও বেশি থাকে। পুজোর বাজারে অবশ্য এই সব ভুল-ত্রুটি ধরার মানে নেই। হইহই করে সপরিবার ছবি দেখাই আসল উদ্দেশ্য।