মদন কুমার এবং জয় খন্নাকে কেন্দ্র করে গল্প এগোলেও সেখানে বটবৃক্ষের মতো প্রভাব বিস্তার করেছেন প্রসেনজিৎ। ছবি: সংগৃহীত।
হিন্দি ছবির নতুন তারকা মদন কুমারকে তার মেন্টর শ্রীকান্ত রায় বলছে, ‘‘তোকে স্টার বানিয়েছি, স্টার হয়েই থাক। অভিনেতা হওয়ার চেষ্টা করিস না!’’ চল্লিশের দশকের শেষের দিকে বম্বে শহর। এক দিকে দেশভাগে জর্জরিত মানুষ দিশাহীন। অন্য দিকে, দেশবাসীর অলীক স্বপ্নপূরণের কাণ্ডারি হয়ে রুপোলি পর্দার আবির্ভাব। সময়ের সঙ্গে বম্বের হিন্দি ছবির বাজার কী ভাবে কলেবরে বড় হতে শুরু করে, বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে পরিচালিত ওয়েব সিরিজ় ‘জুবিলি’ সেই আখ্যানই ধরার চেষ্টা করেছে।
অতীতের হিন্দি ছবি এবং ইন্ডাস্ট্রির তারকাদের সম্পর্কে প্রচলিত এবং বিভিন্ন আখ্যান থেকে উপাদান সংগ্রহ করে পরিচালক এই সিরিজ়কে সাজিয়েছেন। তাই গল্পের পরতে পরতে বাস্তবের সঙ্গে মিল খুঁজে পেতে পারেন অনেকে। রয়েছে রায় টকিজ় এর মালিক শ্রীকান্ত রায় (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়)। সে একজন ‘স্টার মেকার’। তার ব্যবসার অংশীদার এবং স্ত্রী সুমিত্রা কুমারী (অদিতি রায় হায়দারি)। সুমিত্রা আবার ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠিত নায়িকাও বটে। রয়েছে শ্রীকান্তের ছায়াসঙ্গী থুরি বিশ্বস্ত অনুচর বিনোদ দাস (অপারশক্তি খুরানা) এবং তার স্ত্রী রত্না (শ্বেতা বসু প্রসাদ)। রয়েছে করাচি থেকে আসা উদ্বাস্তু জয় খন্না (সিদ্ধান্ত গুপ্ত) যে পরিচালক হতে চায়। এ ছাড়াও রয়েছে সিনেমায় বিনিয়োগকারী সমশের ওয়ালিয়া (রাম কপূর) এবং তাঁর রক্ষিতা নিলোফার (ওয়ামিকা গাব্বি)। আপাতত সিরিজ়ের পাঁচটি পর্ব (মোট ১০টি পর্ব) মুক্তি পেয়েছে।
সিনেমার জৌলুসের আড়ালে যে প্রতিযোগিতা, প্রতিশোধ, লালসার অন্ধকার জগতের কথা শোনা যায়, বিক্রমাদিত্য এবং সৌমিক সেন (সিরিজ়ের অন্যতম স্রষ্টা) সেই সমান্তরাল পৃথিবীকে ধরতে চেয়েছেন। কিন্তু বাস্তবকে বাদ দিয়ে নয়। যেমন শ্রীকান্ত রায় চরিত্রটিকে দেখলে তৎকালীন বম্বে টকিজ়ের কর্ণধার হিমাংশু রাইয়ের কথা মনে পড়ে। বিনোদের মদন কুমার হয়ে ওঠার সঙ্গেও অশোক কুমারের উত্থানের মিল রয়েছে। সুমিত্রা দেবী আর জমশেদের পরকীয়া মনে করাবে দেবিকা রানি এবং নজমুল হুসেনের বিতর্কিত প্রেমপর্ব। প্রশ্ন উঠতেই পারে, তা হলে কি জয় খন্না চরিত্রটিকে গড়ে তোলা হয়েছে রাজ কপূরের আদলে? না কি পাকিস্তান থেকে আসা যশ চোপড়ারই অন্য রূপ? হতে পারে তাঁরা সকলেই এই চরিত্রের অনুপ্রেরণা।
মদন কুমার এবং জয় খন্নাকে কেন্দ্র করে গল্প এগিয়েছে। কিন্তু সেখানে বটবৃক্ষের মতো প্রভাব বিস্তার করেছেন প্রসেনজিৎ। সিনেমাপাগল, কিছুটা নিষ্ঠুর, অল্প কথার এক জটিল চরিত্র শ্রীকান্ত। এই চরিত্রে প্রসনেজিতের মাপা অভিনয় চমৎকার। এই সিরিজ়ে তাঁর ফার্স্টলুক প্রকাশের পর থেকেই চর্চায় রয়েছেন তিনি। ব্যাকব্রাশ করা চুল, পাতলা গোঁফ এবং স্যুটে তাঁকে মানিয়েছেও ভাল। যাঁরা বলেন, অপারশক্তি শুধুই কমিক চরিত্রে পারদর্শী, তাঁদের এই সিরিজ় অবশ্যই দেখা উচিত। অন্য দিকে, জয়ের চরিত্রে অবশ্যই নতুন আবিষ্কার সিদ্ধান্ত। তবে তাঁর অভিনয় আরও সাবলীল হতে পারত। তুলনায় অদিতি বরং কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন। বাকিরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সিরিজ়ের সেট পরিকল্পনা এক কথায় অসাধারণ। চল্লিশের দশকের আবহকে ফুটিয়ে তুলতে টিমের পরিশ্রম চোখে পড়ার মতো। সামান্য প্রপ থেকে শুরু করে পোশাক পরিকল্পনা— চোখের সামনে হাজির করে অতীত মায়ানগরীর নস্ট্যালজিয়াকে। সেখানে অনুঘটকের কাজ করেছে প্রতীক শাহর ক্যামেরা। সিরিজ় জুড়ে সেপিয়া টোনের ব্যবহার সিরিজ়কে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। ‘কলা’র পর আরও এক বার পিরিয়ড ড্রামায় সুরকার অমিত ত্রিবেদী তাঁর ম্যাজিক হাজির করেছেন।
ছবির মাঝে বিরতির মতোই বেশ কিছু প্রশ্ন জাগিয়ে সিরিজ়ের পাঁচটি পর্ব প্রকাশ্যে এসেছে। এখনও পর্যন্ত দুই বিরোধী পক্ষকে কেন্দ্র করেই গল্প এগিয়েছে। তাই সেখানে হিন্দি ছবির বাজারের সামগ্রিক চিত্র রয়ে গিয়েছে অধরা। সিরিজ়ের প্রথম ভাগে মদন কুমারের উত্থান হলে, ধরে নেওয়া যায় পরবর্তী ভাগে জয় খন্নার স্বপ্নপূরণের আখ্যান তুলে ধরা হবে। আপাতত আগামী সপ্তাহে বাকি পর্বগুলির অপেক্ষা।