কালিকাপ্রসাদ এবং দোহার। ছবি: সংগৃহীত।
মাটির টান, গ্রামবাংলার বিস্মৃতপ্রায় পরম্পরা আর মানুষের ভালবাসা। এই রসদেই বাঁধা গানের সুর। সেই গানই গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে ‘দোহার’। প্রাণপুরুষ কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য বিদায় নিয়েছেন বছর ছয়েক আগে। কালিকাদার অকালমৃত্যুর পরে ছন্নছাড়া হয়ে যেতে পারত তাঁর প্রাণের গানের দল। তা হয়নি। গানের দলকে আরও মন দিয়ে বেঁধেছেন ‘দোহার’-এর অন্যতম স্রষ্টা রাজীব দাস। বছর ঘুরলেই ২৫-এ পা দিচ্ছে ‘দোহার’। প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ততা তুঙ্গে। তার আগে আনন্দবাজার অনলাইনকে সময় দিলেন রাজীব দাস।
প্রশ্ন: বছর ঘুরলেই ‘দোহার’-এর রজতজয়ন্তী। প্রস্তুতি কেমন?
রাজীব: ২০২৪ সালে ৭ অগস্ট ‘দোহার’ ২৫-এ পা দিচ্ছে। এটা একটা বিশেষ মুহূর্ত, উদ্যাপন তো হবেই। কোনও গানের দল প্রতি বছর একটা বিশেষ অনুষ্ঠান করছে, এমন সচরাচর দেখা যায় না। ‘দোহার’ কিন্তু সেই ধারা বজায় রেখেছে। আমরা থিয়েটার করেছি, ‘লোকধ্বনি’ (ফোক অর্কেস্ট্রা) করেছি। ‘লোকধ্বনি’তে প্রায় ৫০-৬০ রকমের লোকযন্ত্র বেজেছে, আমাদের সঙ্গীতশিল্পীরা ছাড়াও বাইরের যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে ‘দোহার’-এর সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, তাঁরাও শামিল হয়েছেন। প্রত্যেক বছরই আমরা নতুন কিছু করার চেষ্টা করি। ২৫ বছরে তো অবশ্যই আরও বিশেষ ভাবে কিছু করব। অনেক পরিকল্পনা আছে। ক্রমশ প্রকাশ্য!
প্রশ্ন: কালিকাদাকে ছাড়া ২৫ বছরে পা রাখছেন...।
রাজীব: যে কোনও পরিবারের এক সদস্য চলে গেলে তাঁর শূন্যতা কখনওই পূরণ হয় না। ‘দোহার’-এর সবটা জুড়ে ছিলেন কালিকাদা। আমরা দু’জনেই অসমের ছেলে। কালিকাদার উদ্যোগে ওঁর হাত ধরেছিলাম। ‘দোহার’-এর সৃষ্টি সে ভাবেই। নিত্যনতুন ভাবনাচিন্তার চিন্তক ছিলেন কালিকাদাই, আর আমরা সবাই কারিগর। আমাদের বলা হত ‘ছায়াসঙ্গী’। ওঁর চলে যাওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি ওঁর সঙ্গে ছিলাম। একটা দল তো দলনেতার মাধ্যমেই পরিচিত হয়। মানুষ ‘দোহার’কে চিনেছেন কালিকাদার মাধ্যমে। একটা সময় ‘কালিকাপ্রসাদ বনাম দোহার’ দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েও যেতে হয়েছে আমাদের দলকে। কালিকাদা নিজেই সব সময় স্বীকার করেছেন, তাঁকে ‘দোহার’-এর থেকে আলাদা করা যায় না। ২০১৭-র ওই দুর্ঘটনার পরে তাঁর শূন্যস্থান এখনও পূরণ হয়নি। তা সম্ভবও নয়। এখন দলনেতার দায়িত্ব আমি নিয়েছি। আমাদের পথচলায় মানুষের নিরন্তর ভালবাসাও আছে। ২০১৭-র পরে আমাদের বেশির ভাগ অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যায়। তখন ওই পরিস্থিতিতেও অনেকে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, আমাদের মঞ্চ দিয়েছিলেন। এমন এক বিপর্যয়ের পরেও যে ‘দোহার’ উঠে দাঁড়াতে পারে, সেই ভরসা জুগিয়েছিলেন মানুষই।
প্রশ্ন: ২০১৭-র পরে ঘুরে দাঁড়ানোটা কতটা কঠিন ছিল?
রাজীব: আমরা তো কোনও দিন স্বপ্নেও ভাবিইনি যে আমাদের এমন বাস্তবের মুখোমুখি হতে হবে। ‘দোহার’-এর জন্মলগ্নে আমি ছিলাম মূল গায়েন, কালিকাদার পরিচিতি তখন স্রেফ তবলাবাদক হিসাবে। পারিবারিক সূত্রে যে উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন, পরে সেটাকেই ধারণ করেন তিনি। কালিকাদার গায়কসত্তা মূলত সামনে আসে ‘দোহার’-এর জন্মের পরে। তার পর আস্তে আস্তে সেটা জনপ্রিয়তা পায়। তবে আমাদের দলের মধ্যে কারও দ্বন্দ্ব ছিল না। পারস্পরিক সম্মানবোধের জায়গা থেকেই সেটা কখনও হয়নি। কালিকাদা চলে যাওয়ার পরে সবাই ভেবেছিলেন ‘দোহার’ অচল। কিন্তু ‘দোহার’ তো ব্যক্তিগত প্রয়াস নয়, দলগত প্রয়াস। এটা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা সমাজমাধ্যমের সাহায্য নিই। তখন ফেসবুকে আমাদের অনুগামীর সংখ্যা মাত্র ছয় হাজার মতো। ২০১৭-তে কালিকাদা চলে যাওয়ার পরে যাঁরা ভরসা করে আমাদের মঞ্চ দিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কাজ করার সময় প্রতি মুহূর্তের ছবি আমরা সমাজমাধ্যমে মানুষের সঙ্গে শেয়ার করেছি। সেই সময় লোপামুদ্রা মিত্রের সঙ্গে আমরা একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম। তখন মানুষ দেখেছিলেন যে, ‘দোহার’ ফের অনুষ্ঠান করছে। কিন্তু, লোপামুদ্রা মিত্রের সঙ্গে। এই তকমাটা তখনও থেকে গিয়েছিল। তার পরে রাঁচিতে আমাদের প্রথম একক অনুষ্ঠান হয়। ওই অনুষ্ঠানে অন্য কোনও শিল্পী ছিলেন না। এই সবটাই আমরা সমাজমাধ্যমে শেয়ার করি। তার পর বিদেশেও ফের ডাক আসতে থাকে। এখনও আমাদের অনুগামী সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ। সবটাই হয়েছে আমাদের সম্মিলিত চেষ্টায়।
প্রশ্ন: শিবপ্রসাদ-নন্দিতার ‘রক্তবীজ’ ছবিতে গান বাঁধছে ‘দোহার’।
রাজীব: ২০১৮ সালে ‘রসগোল্লা’ ছবিতে কয়েকটি গানের দায়িত্ব পড়েছিল কালিকাদার উপরে। সেখানে কিন্তু ‘দোহার’ নেই। ২০১৭-তে কাজ চলেছে। ওই বছরই কালিকাদার অকালপ্রয়াণ হয়। সেই সময় ‘রসগোল্লা’র কাজ শেষ করেছে ‘দোহার’ই। পাঁচ বছর পরে ২০২৩ সালে উইন্ডোজ় এবং শিবপ্রসাদ-নন্দিতার সঙ্গে ‘রক্তবীজ’ ছবিতে কাজ করছে ‘দোহার’। শিবুদা ও নন্দিতাদির সঙ্গে ‘দোহার’-এর এটাই প্রথম কাজ। ‘রক্তবীজ’-এ ‘দোহার’ তিন-চারটে গান করছে। গানগুলোয় ‘দোহার’ তো থাকছেই, সঙ্গে অন্যান্য শিল্পীরাও থাকছেন। ‘গৌরী এল দেখে যা লো’ গানে ‘দোহার’কে ছবিতেও দেখা যাবে।
প্রশ্ন: গানের দল বা ব্যান্ড বলতে এখনও আমরা ‘দোহার’, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ‘চন্দ্রবিন্দু’, ‘ক্যাকটাস’, ‘ফসিলস’-কেই বুঝি। বাংলায় আজকাল নতুন ব্যান্ড উঠে আসছে না।
রাজীব: তার একটা বড় কারণ, এখন আমাদের বাংলা মৌলিক গান শোনানোর কোনও প্ল্যাটফর্ম নেই। রেডিয়ো চ্যানেলে বাংলা গান শোনানো নিয়ে অনেক দিন ধরে অনুরোধ, চেষ্টা সবই চলছে। কেউ খুব একটা গ্রাহ্য করেননি। ক্যাসেট, সিডির যুগের পরে গানের জগতে বড় একটা বিবর্তন আসে। সেই সংশয়ের সময় কাটিয়ে এখন ইউটিউবের যুগ। সব কিছু সহজলভ্য হয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে আমাদের রুচিও নিম্নমুখী হয়েছে। আগেকার দিনে হাজার হাজার গান তৈরি হত না, তাই গুণগত মানের দিকে নজর দেওয়া হত। আগে যে কেউ চাইলেই এইচএমভিতে গান গাইতে পারতেন না। তার আগে অডিশন দিতে হত। নির্বাচিত হলে তবেই গান রেকর্ড করার প্রশ্ন। ‘ফসিলস’, ‘ভূমি’, ‘চন্দ্রবিন্দু’, ‘ক্যাকটাস’... সবই ওই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এখনকার বলিউড বা টলিউডের যে গান... চারটে লাইনের পরে কিছু বোঝা যায় না। টলিউডে তবু কিছু ভাল গান আছে, বলিউডে তো তা-ও নেই। এখন গান রেকর্ড করা হয় বিক্ষিপ্ত ভাবে। ট্র্যাক তৈরি হল, বাদ্যযন্ত্র বাজল, গায়ক-গায়িকা এসে গান গাইলেন। গান তৈরি হয়ে গেল। যে যার অংশটুকু রেকর্ড করে চলে গেলেন। একসঙ্গে বসে মহড়া দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। কেন গান গাইছেন, কোন পরিস্থিতির গান, কী বৃত্তান্ত... তা জানার কোনও গল্পই নেই। এখন তো কয়েকটা টেক নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে দিলেই গান তৈরি। এ রকম চললে তো গুণগত মান নামবেই। আর মানুষের তো এখন না আছে সময়, না আছে ধৈর্য। নতুন নতুন গান তৈরি হচ্ছে, কিন্তু গানের মান এমনই, তা মানুষের মনেই থাকছে না। তা ছাড়াও আরও কিছু সমস্যা তো আছেই।
প্রশ্ন: যেমন?
রাজীব: গানবাজনা শিল্প ঠিকই। কিন্তু সেটা কিন্তু এক ধরনের পণ্যও। বিভিন্ন সংস্থা এর আগেও গানকে পণ্য হিসাবেই বিক্রি করেছে। সেই পণ্য চাহিদা আর জোগানের বৃত্তেই ঘোরাফেরা করে। ১০টা গানের চাহিদা, অথচ তৈরি হচ্ছে ১ লক্ষ গান। তা হলে কি আর গানের কদর থাকে! আজকালকার দিনে ইউটিউব ছাড়া আর একমাত্র সিনেমার মঞ্চেই নতুন গান জায়গা পায়। এ বার বলিউডের মতো টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতেও তো কম স্বজনপোষণ নেই। কিছু কিছু হাউসের সঙ্গে পরিচিতি না থাকলে, বা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে আপনি ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গাই পাবেন না। নতুন ব্যান্ডের বেশির ভাগের তো সেই সুযোগটাই নেই।
প্রশ্ন: রিয়্যালিটি শো থেকে নতুন প্রতিভা পাওয়া কতটা সম্ভব বলে আপনার মনে হয়?
রাজীব: এখন তো রিয়্যালিটি শো নিয়েও প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে! আগে একটাই ভাল রিয়্যালিটি শো ছিল, এখন আরও অনেকগুলো গজিয়ে উঠেছে। এটা ঠিক, নিজেকে চেনানোর জন্য রিয়্যালিটি শো একটা মঞ্চ দেয়। অরিজিৎ সিংহ, শ্রেয়া ঘোষাল এঁরাও কিন্তু রিয়্যালিটি শো থেকেই উঠে এসেছেন। তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে রিয়্যালিটি শো থেকে উঠে এলেও টিকে যাওয়া মুশকিল। একটা গান হঠাৎ করে জনপ্রিয় হয়ে গেল। এখন তো জনপ্রিয় মানেও ভাইরাল। ‘কুত্তার বাচ্চা ফুটফুটে সুন্দর’-ও ভাইরাল! আমাদের রুচিটা তো এখন বাদামভাজায় এসে ঠেকেছে। এগুলো কি গান? অথচ এগুলোই আমরা এখন গুনগুন করছি। আগে নবীন প্রজন্মের ভাবাবেগ প্রকাশের উপায় বেশি ছিল না। এখন সেই সুযোগ হয়েছে, কিন্তু গুণগত মানের মূল্যায়নটা হচ্ছে কোথায়!
প্রশ্ন: লোকসঙ্গীতে কোথাও গিয়ে কাঁটাতারে বেড়াটা মুছে যায়। আগামী বছর ‘দোহার’ ২৫-এ পা দিচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে কাজ করার পরিকল্পনা আছে?
রাজীব: লোকগীতি বলে শুধু নয়, গান মাত্রই কাঁটাতারের বেড়ার পরিপন্থী। দুই বাংলার সুরের মধ্যে যেমন মিল আছে, ফারাকও আছে বিস্তর। আঞ্চলিকতা লোকসঙ্গীতের জন্ম দেয়। যেমন উত্তরবঙ্গে ভাওয়াইয়া, রাঢ় বাংলায় ঝুমুর, কুষ্ঠিয়া-নদিয়ায় কীর্তন। আবার পূর্ববঙ্গের সিলেট-ময়মনসিংহে ভাটিয়ালির সুর। অসমের বরাক উপত্যকায় করিমগঞ্জে আমার জন্ম, শিলচরে কালিকাদার। ওই গোটা জায়গাটাই বাঁধা ভাটিয়ালির সুরে। আমি যেখানে জন্মেছি, সেটা এক সময় সিলেটের অন্তর্গত ছিল। কালিকাদা গেয়েছিলেন, ‘এ পার বাংলা ও পার বাংলা, মধ্যে জলধি নদী’। কাঁটাতারের বেড়া কখনও সুরের যাত্রাপথ রুখে দিতে পারে না। মানুষ বৃন্তচ্যুত অবস্থাতেও সেই গান ভালবেসেছেন। অবিভক্ত বাংলার যত লোকযন্ত্র আছে, সবটাকে এক মঞ্চে এনে আমরা একটা কাজ করতে চাই। কালিকাদা চলে যাওয়ার পর থেকে ওঁকে স্মরণ করে প্রতি ছ’মাসে আমরা ওয়ার্কশপ করি। সেখানে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে নবীন প্রজন্মকে লোকগান নিয়ে আমরা একটা সামগ্রিক শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করি। লোকগানের ঐতিহ্য ও ধারাটাকে বজায় রাখার নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছি।