Celebrity Interview

নতুন প্রজন্মের ‘ঔদ্ধত্য’ সমর্থন করি না, আমার শিক্ষা আমাকে তা শেখায়নি: ঋতুপর্ণা

শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অভিনীত ‘দত্তা’। ছবিমুক্তির আগে আনন্দবাজার অনলাইনের প্রশ্নের উত্তর দিলেন অভিনেত্রী।

Advertisement
অভিনন্দন দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২৩ ১৬:৫৪
Tollywood actress Rituparna Sengupta

ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ছবি: সংগৃহীত।

সাক্ষাৎকার শুরু হবে। মোবাইলের রেকর্ডার অন করার সময় জানা গেল, অভিনেত্রী প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে ছবির প্রচার করে যাচ্ছেন। ক্লান্ত লাগে না? হেসে বললেন, ‘‘এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।’’ সারা দিন খাওয়ার সময় পাননি। সাক্ষাৎকার দেওয়ার আগে সামান্য ভেজ পাস্তা চেখে দেখলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। গ্রিন টির কাপে চুমুক দেওয়ার পর পরিচিত উক্তি, ‘‘চলুন, ঝটপট শুরু করা যাক।’’

প্রশ্ন: কেমন আছেন?

Advertisement

ঋতুপর্ণা: (হেসে) মিলিয়ে-মিশিয়ে ভালই আছি।

প্রশ্ন: মিলিয়ে-মিশিয়ে!

ঋতুপর্ণা: ভাল দিকটাই উল্লেখ করতে চাই। কারণ ঈশ্বরের আশীর্বাদে এমন একটা জীবন পেয়েছি যেখানে অনেক দিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ পেয়েছি। মিলিয়ে-মিশিয়ে বললাম কারণ বিগত কয়েক মাসে আমাকে প্রচণ্ড ঘুরতে হচ্ছে। মুম্বই, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশ— অনেকগুলো ছবির কাজ চলছে।

প্রশ্ন: ‘দত্তা’ নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

ঋতুপর্ণা: অনেকটাই। খুব জটিল ছবি আমরা তৈরি করিনি। পিরিয়ড ছবির হিসাবে আমাদের কাছে খুব বেশি বাজেটও ছিল না। খুব যত্ন নিয়ে চরিত্রদের পোশাক পরিকল্পনা এবং ছবির শিল্প নির্দেশনার চেষ্টা করা হয়েছে। ঋতুদার (পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ) ছবির অন্দরসজ্জাতেও এ রকম এই ছোট ছোট জিনিসগুলো গুরুত্ব দেওয়া হত। অতিমারি সামলে ৪ বছরের চেষ্টায় ছবিটা তৈরি করেছি। আশা করছি দর্শক পাশে থাকবেন।

প্রশ্ন: অজয় কর পরিচালিত ‘দত্তা’য় সুচিত্রা সেন অভিনয় করেছিলেন। ওঁর অভিনীত চরিত্রে সুযোগ পেয়ে আপনি যে গর্বিত সেটা একাধিক বার বলেছেন। আপনার কাছে মহানায়িকার প্রিয় ছবি কোনটা?

ঋতুপর্ণা: একটা নয়, অনেকগুলোই রয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত পছন্দ থেকে দুটো ছবি—‘দীপ জ্বেলে যাই’ এবং ‘উত্তর ফাল্গুনী’। এ ছাড়াও ‘হারানো সুর’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘হসপিটাল’ রয়েছে। আর অবশ্যই ‘আঁধী’।

প্রশ্ন: পরিচালক যখন ‘দত্তা’র প্রস্তাব নিয়ে এলেন, তখন ওঁকে কী বলেছিলেন মনে আছে?

ঋতুপর্ণা: বাপ রে! সুচিত্রা সেন! (হাসি) সুচিত্রা সেন খুব পরিণত বয়সে ছবিটা করেছিলেন। সে দিক থেকে পরিচালকেরও মনে হয়েছিল যে, আমাকে মানাবে ভাল।

প্রশ্ন: কিন্তু ছবিতে আপনার লুক নিয়ে তো সমাজমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে মতামতও চোখে পড়ছে

ঋতুপর্ণা: অনেকেই দাবি করেছেন বিজয়া চরিত্রটির তখন নাকি ১৮ বছর বয়স ছিল। ছবির কাস্টিং নিয়ে তাই তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু বয়স মাথায় রেখে কি সব চরিত্রায়ন সম্ভব হয়? শাহরুখ খান বা সলমন খান কি সব সময় তাঁদের সমবয়সি চরিত্রে অভিনয় করেন? সময়ের সঙ্গে কিন্তু যে কোনও গল্পকে নতুন ভাবে বিশ্লেষণ করাই যায়।

প্রশ্ন: সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আপনার কখনও দেখা হয়েছে?

ঋতুপর্ণা: না, কখনও সুযোগ হয়নি। মাঝেমধ্যেই একটু আফসোস হয়। ওঁর পরিবারের সঙ্গে আমার অত্যন্ত ভাল সম্পর্ক। আসলে উনি যে ভাবে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছিলেন, আমিও কখনও আলাদা করে দেখা করার চেষ্টা করিনি। তবে, রাইমার (সেন) কাছে শুনেছি যে, ‘অনুরণন’ দেখে উনি নাকি খুব খুশি হয়েছিলেন। দেখা না হলেও এইটুকুই আমার কাছে অনেকটা পাওয়া।

প্রশ্ন: বলা হয় ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন পরিচালকদের পাশে দাঁড়ান আপনি। এই ছবির পরিচালক নির্মল চক্রবর্তী আপনার প্রচার সহায়ক হিসেবে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন। সেই জন্যই কি ওঁর ছবিটা প্রযোজনা করতে এগিয়ে এলেন?

ঋতুপর্ণা: প্রায় ১০ বছর আগে নির্মলদা ওঁর ইচ্ছার কথা আমাকে জানিয়েছিলেন। আসলে আমার টিমের সদস্যদের কোনও স্বপ্নপূরণে সাহায্য করতে পারলে আমি এগিয়ে আসি। ইন্ডাস্ট্রিতে আমার অনেক বন্ধুরই শুরুর দিকের ছবি আমার সঙ্গে। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী, অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষ— দীর্ঘ তালিকা। এর মধ্যে আমার কোনও স্বার্থ নেই।

প্রশ্ন: আপনার মতো অভিজ্ঞ অভিনেতারা এখনও সিনেমার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকটি মানুষকে সমান ভাবে সময় দেন। নতুনদের মধ্যে এখন অনেকের ম্যানেজার রয়েছে। অনেককে আবার ফোন করলে উত্তর মেলে না। ইন্ডাস্ট্রির এই বদলকে কী ভাবে দেখেন?

ঋতুপর্ণা: নতুন প্রজন্মের এই ঔদ্ধত্যকে আমি সমর্থন করি না! কারণ আমি বিশ্বাস করি, এই ভাবে কিছু প্রমাণ করা যায় না। আমার পারিবারিক শিক্ষা আমাকে শিখিয়েছে যে ঔদ্ধত্য মানুষকে তাঁর চারিত্রিক গুণ থেকে দূরে ঠেলে দেয়।

প্রশ্ন: এর পিছনে কি কোনও ভাবে সহজে প্রচার পাওয়ার ইচ্ছা কাজ করে?

ঋতুপর্ণা: একদমই তাই। দেখুন, আমরা তো সহজে কিছু পাইনি। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে আজকে এই জায়গায় এসেছি। ইন্ডাস্ট্রিতে প্রযোজকরা এখনকার মতো এতটা ‘কর্পোরেট’ ছিলেন না। এখনকার মতো এত পারিশ্রমিকও ছিল না। এসি ফ্লোর ছিল না, মেকআপ ভ্যান তো দূরের কথা। শুক্রবারের কাগজে একটা মাত্র সাদা-কালো বিজ্ঞাপন আর রাস্তায় কিছু পোস্টার, সমাজমাধ্যমও ছিল না— তাই টিকে থাকার গুরুত্বটা বুঝি। ঔদ্ধত্য আমার কাছে বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়!

প্রশ্ন: তার মানে এখনও সাফল্যের জন্য পরিশ্রমেই বিশ্বাস রাখেন?

ঋতুপর্ণা: অবশ্যই। এখনও পরিশ্রম করছি, ভবিষ্যতেও করব। দেখুন, আমার জীবনে যেমন প্রাপ্তি প্রচুর, পাশাপাশি অনেক প্রতিবন্ধকতাও এসেছে। প্রচুর স্বার্থত্যাগ করেছি শুধু সিনেমাকে ভালবেসে। সাফল্য যদি পরিশ্রমের মাধ্যমে আসে, তা হলে তার স্বাদটা কিন্তু অনেক দীর্ঘস্থায়ী হয়।

প্রশ্ন: ‘দত্তা’র নিবেদক পরিচালক প্রভাত রায়। গত বছর উনি অভিযোগ করেছিলেন যে আপনি আর গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া এখন আর কেউ ওঁর খোঁজ নেন না। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সদস্যেরা কি এখন একটু বেশিই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে?

ঋতুপর্ণা: অবশ্যই। ছোট ছোট মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকের কাছে এই যোগাযোগ রাখাটা প্রয়োজনীয় নয় মনে হতেই পারে। কিন্তু আমার পারিবারিক শিক্ষা আমাকে সেটা শেখায়নি। ঠাকুমাকে দেখেছি হাত খুলে প্রত্যেকের জন্য কাজ করতে। আবার আমাদের বাড়িতে পাঁচ দিনের জন্য থাকতে এসে কেউ ১৫ বছরও থেকে গিয়েছেন— তারও সাক্ষী থেকেছি। প্রভাতবাবুর হাত ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেছিলাম। তাঁকে ভুলি কী করে? বিশ্বাস করি, ভাল দিনে হয়তো কারও পাশে দাঁড়াতে পারিনি। কিন্তু তাঁর কঠিন সময়ে ঋতুপর্ণা তাঁর পাশে থাকার চেষ্টা করে। এটা আমার জীবনদর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক।

প্রশ্ন: শুনেছি, ‘শ্বেত পাথরের থালা’ ছবিটির জন্য উনি নাকি আপনার কোনও অডিশন নেননি।

ঋতুপর্ণা: আসলে আমাকে নির্বাচন করেছিলেন বৌদি (প্রভাত রায়ের স্ত্রী জয়শ্রী রায়)। তখন আমি স্কুলে পড়ি। কুশল চক্রবর্তীর সঙ্গে ‘শ্বেত কপোত’ সিরিজ়ে আমাকে দেখে বৌদির খুব পছন্দ হয়। প্রভাতদা বলেছিলেন, ‘‘আমার স্ত্রী যখন কাস্টিং করেছে, আর আমার কোনও আপত্তি নেই।’’

প্রশ্ন: আত্মকেন্দ্রিকতা নিয়ে কথা হচ্ছিল। ধরা যাক, মাঝরাতে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত কোনও বিপদে পড়েছেন। সবার আগে তিনি ইন্ডাস্ট্রির কাকে ফোন করবেন?

ঋতুপর্ণা: (একটু ভেবে) আমার টিমের সদস্যেরা একটা পরিবারের মতো। তাই কোনও বিপদে আমি ওদের মধ্যেই কাউকে আগে ফোন করব। তার পর প্রয়োজন হলে অন্য কাউকে নিশ্চয়ই করব।

প্রশ্ন: নব্বইয়ের দশকে আপনার কেরিয়ার শুরু। তখন কি এখনকার মতো সামনে কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে এগোনো সম্ভব হত?

ঋতুপর্ণা: আমি এমন একটি পরিবার থেকে উঠে এসেছিলাম, যেখানে কেরিয়ারের লক্ষ্য স্থির করা সম্ভব ছিল না। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। বাবা ভেবেছিলেন আমি আইএএস পরীক্ষা দেব। সেখান থেকে অভিনয়ে আসার পর পরিবারের তরফে আমার পেশাকে বাংলা সংস্কৃতিরই অংশ হিসেবে দেখা হত। পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে নিশ্চয়ই কিছু লক্ষ্য ছিল।

প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে তো অনেক রকম গুজব কানে আসে। নিজের জায়গা করে নিতে নতুনদের কী পরামর্শ দেবেন?

ঋতুপর্ণা: আমাদের সঙ্গে এখনকার ছেলেমেয়েদের চিন্তাভাবনারও একটা বিস্তর ফারাক রয়েছে। চটজলদি পাওয়া সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বাড়ি, গাড়ি এবং মোবাইল ফোন কোনও সাফল্যের মাপকাঠি নয়। প্রতিভা অনেকের মধ্যেই থাকে, কিন্তু একাগ্রতা থাকে না। সফল হতে এই দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আবার মাত্রাতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষাও ভাল নয়।

প্রশ্ন: ‘জুবিলি’ দেখেছেন?

ঋতুপর্ণা: হ্যাঁ, খুব ভাল লেগেছে।

প্রশ্ন: ‘জুবিলি’তে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে দেখার পর আপনাকেও কিন্তু অনেকেই হিন্দি ওয়েব সিরিজ়ে দেখতে চাইছেন। প্রস্তাব নেই?

ঋতুপর্ণা: সত্যি বলতে, প্রস্তাব আসতেই থাকে। কিন্তু হিন্দি ওয়েব সিরিজ়ের জন্য মনের মতো চরিত্র না পেলে আমি রাজি হব না। তাই একটু ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে চাই।

প্রশ্ন: এর পর কী কী ছবি আসছে?

ঋতুপর্ণা: অনেকগুলো ছবি রয়েছে। আরবাজ় খানের সঙ্গে ‘কাল ত্রিঘোরী’র ডাবিং শেষ করলাম। বাপ্পি লাহিড়ির প্রযোজিত ছবিতে আমার সঙ্গে রাজপাল যাদবও রয়েছেন। বাংলাদেশের অনেকগুলো ছবি রয়েছে। ‘আ বিউটিফুল লাইফ’, চন্দন রায় সান্যালের সঙ্গে ‘সল্ট’ এবং ইন্দ্রাশিসের (আচার্য) ‘গুডবাই মাউন্টেন’ রয়েছে। শতরূপাদি’র (সান্যালের) একটা ছবি করার কথা রয়েছে। আগামী কয়েক মাস ব্যস্ততার মধ্যেই কাটবে (হাসি)।

আরও পড়ুন
Advertisement