গ্রাফিক: সনৎ সিংহ
মানুষের মাথার মতোই কাজ করছে কৃত্রিম মেধা। চারুকলার নানা বিভাগেও পা ফেলতে শুরু করেছে সে। যে গান শুনে মন ভরে গেল, হয়তো সে গান কোনও গায়কের গাওয়াই নয়, এমন দিন আসতে আর বাকি নেই! গত এক বছরে হইহই ফেলে দিয়েছে কৃত্রিম মেধা। ‘ডিপ লার্নিং’ বদলে দিচ্ছে যাবতীয় ভাবনা।
গত বছরই সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল অরিজিৎ সিংহের গাওয়া একটি গানের ভিডিয়ো। শাহরুখ খান অভিনীত সিনেমায় ওই গানের গলা কৃত্রিম মেধার মাধ্যমে বদলে ‘মহম্মদ রফি’ করে দেওয়া হয়! এমনকি সুর ও লয়ে কিছু পরিবর্তন এমন করা হয় যে, বোঝার উপায নেই, গানটি ২০২৩ সালের, না ১৯৬০-’৬৫-র!
চলতি বছরের শুরুতে এমন ভাবেই কৃত্রিম মেধা ব্যবহার করে মৃত গায়কের গলা পুনরুদ্ধার করে ব্যবহার করেছেন স্বয়ং এ আর রহমান। এক প্রবাসী বাঙালি (বাংলাদেশের নাগরিক) এর মধ্যেই প্রকাশ করে ফেলেছেন একটি গোটা অ্যালবাম, যার গায়ক ‘আইজ্যাক’ আসলে কৃত্রিম মেধাবান। তার পর থেকেই ‘সামাল-সামাল’ রব উঠেছে। তবে কি সব ভেসে যাবে?
এমন একটি পরিস্থিতিতে বিশ্ব সঙ্গীত দিবসে অবশ্যই মনে পড়তে পারে নাটকের গানের কথা। নাটক এমন এক শিল্পমাধ্যম, যেখানে সরাসরি দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন শিল্পীরা। অভিনয়ের পাশাপাশি গান একটি বড় সম্পদ হয়ে ওঠে সেখানে। সেই গান প্লেব্যাকের থেকে একেবারে আলাদা। সরাসরি মঞ্চে গান ধরেন অভিনেতা। কখনও হয়তো যন্ত্রানুষঙ্গের সাহায্যটুকুও থাকে না।
কৃত্রিম মেধার এই বাড়বাড়ন্তের দিনে, নাটকের গান কি বাঁচিয়ে রাখতে পারবে শুদ্ধ সঙ্গীতের সাবেক অধিকার? বাংলা নাটকে গানের বহুল প্রয়োগ অতি পরিচিত।
বছর কয়েক আগে ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ নাটকে বিখ্যাত গায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন দেবশঙ্কর হালদার। কৃত্রিম মেধা ও নাটকের গান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “নাটক সংযত এক মাধ্যম, মানুষের সামনে সরাসরি ঘটে তার প্রকাশ। তবে নাটকেও তো বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। আজকাল নাটকে প্লেব্যাক গান বাজে। হয়তো কোনও দিন কৃত্রিম মেধার ব্যবহারও হবে। কারণ এই পৃথিবীর চলনের সঙ্গে নাটককেও তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমার এই কৃত্রিম মেধার মাধ্যমে সৃষ্টি করা গান পছন্দ হবে না। হয়তো চেষ্টা করব এড়িয়ে চলতে।”
নাটকের গান নিয়ে নতুন করে কাজ করছেন অভিনেত্রী সোহিনী সেনগুপ্ত। তাঁর বা তাঁদের নাট্যদল নান্দীকারের তরফে পুরনো নাটকের গান সংরক্ষণ করার চেষ্টা শুরু হয়েছে। কৃত্রিম মেধা নিয়ে সোহিনীর কথায় অবশ্য ফুটে উঠল খানিকটা সংশয়। সোহিনী বললেন, “আগের মতো নাটকের গান গাইবার মানুষ ক্রমশ কমে আসছে। ছন্দাদি (চট্টোপাধ্যায়) বা সুরঞ্জনাদি (দাশগুপ্ত)-র মতো করে এখন আর কেউ গান করেন না। চেতনা-র তরফে লালদা (সুমন মুখোপাধ্যায়) বা নীল (সুজন মুখোপাধ্যায়) গানের দিকটা ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। আমি এবং অম্বরীশ (ভট্টাচার্য) চেষ্টা করছি গানগুলি সংরক্ষণ করতে।”
তবে কৃত্রিম মেধা নিয়ে এই মুহূর্তে অবশ্য তেমন আতঙ্কিত নন সোহিনী। তাঁর মতে, “সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিও বদলাবে। কিন্তু নাটকে কৃত্রিম মেধার দ্বারা তৈরি গান ব্যবহৃত হবে বলে আমার মনে হয় না। অন্তত আমি তার প্রয়োগ করব না। কারণ নাটকে সব কিছু একেবারে নিখুঁত হয় না। তার মধ্যে একটা কল্পনা থাকে। সেখানে দর্শকের সামনে নিজেকে ফুটিয়ে তোলাই সব থেকে বড় বিষয়।”
নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা সুমন মুখোপাধ্যায় বললেন, “নাটকের গান এক দিকে যেমন সরাসরি দর্শকের সামনে উপস্থাপিত হয়, তেমনই আবার রেকর্ডিংও করা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই যে গান মঞ্চে উপস্থিত অভিনেতা গাইছেন, সেখানে কৃত্রিম মেধা ব্যবহৃত হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। তবে বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির ব্যবহার করে গান রেকর্ডিং করা হলে, হয়তো আগামী দিনে কৃত্রিম মেধার ছোঁয়া লাগবে নাটকের গানেও। সেটাও মেনে নিতে হবে।”