Chiranjeet on Rituparno Ghosh

শেষের দিকে যোগাযোগ থাকলেও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল না! ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যুদিনে অকপট চিরঞ্জিৎ

৩০ মে পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যুবার্ষিকী। পরিচালকের মাত্র একটি ছবিতেই অভিনয় করেছিলেন চিরঞ্জিৎ। সেই ছবি ঘিরেও রয়েছে ‘বিতর্ক’। প্রয়াত পরিচালকের সঙ্গে তাঁর সফর ফিরে দেখলেন অভিনেতা।

Advertisement
চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী
চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২৩ ০৮:৪৭
Rituparno Ghosh

প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের স্মৃতিচারণায় চিরঞ্জিৎ। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

ঠিক দশ বছর হতে চলল ঋতু নেই! ভাবলেই অবাক লাগে। সত্যিই সময় কারও জন্য থেমে থাকে না, কিন্তু সেই মানুষটি আমাদের মনে রয়ে যায়। তখন আমার পরিচালিত ‘ভয়’ ছবিটা সবে মুক্তি পেয়েছে। এ দিকে ঋতুপর্ণ বলে এক জন পরিচালক ছবি করছেন, সেই খবর আমার কানে এসে পৌঁছেছে। হঠাৎ একদিন ও আমাকে ফোন করল। নিজের পরিচয় দিয়ে জানাল যে, ‘ভয়’ ওর খুবই ভাল লেগেছে। তার পর ও আমার বাড়িতে এসেছিল। পরস্পরের জন্মদিনেও আমাদের দেখা হয়েছে। আমাকে ও ডাকত ‘দীপু’ নামে। ধীরে ধীরে আমাদের বন্ধুত্ব হল, ও আমাকে ‘বাড়িওয়ালি’তে কাস্ট করল। আমাকে আরও দুটো-তিনটে ছবির গল্প শুনিয়েছিল। কিন্তু পরে কোনও কারণে সেই ছবিগুলো ও আর আমার সঙ্গে করেনি।

ঋতুপর্ণের মতো জ্ঞানী এবং বিচক্ষণ পরিচালক বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে খুবই কম এসেছে। ওর প্রায় সব ছবিই আমার দেখা। ঋতুর এই দিকটা সকলেরই প্রায় জানা। আমি বরং ‘বাড়িওয়ালি’ ছবির শুটিংয়ের একটা অন্য অভিজ্ঞতা জানাই। তখন ছবির আউটডোর চলছে বর্ধমানের দশঘড়ায়। আমার তখন বিপুল জনপ্রিয়তা। কোনও ভাবে স্থানীয় মানুষদের কাছে খবর পৌঁছে গিয়েছিল যে, আমি ওখানে শুটিং করছি। তার পর শুটিং দেখতে দলে দলে মানুষ রাজবাড়ির আশপাশে ভিড় করতেন। কেউ পাঁচিলে উঠে অপেক্ষা করছেন, তো কেউ গাছে চড়ে! ফলে শুটিংয়েও বেশ অসুবিধা হতে শুরু করল। আর কোনও উপায় না দেখে শেষে ঋতু আমার শরণাপন্ন হল। আমি তখন প্রতি দিনই শুটিংয়ের বিরতিতে বা কখনও শুটিং শেষে রাজবাড়ির ছাদে বা কখনও বাইরে বেরিয়ে এসে অনুরাগীদের সামনে দাঁড়াতাম, হাত নাড়তাম। তাঁর পর ওঁরা শান্ত হতেন। ফলে আর জমায়েত হত না।

Advertisement

ঋতুর সঙ্গে একটা ছবিতেই আমি কাজ করেছিলাম। আর খারাপ লাগে সেই ছবিকে ঘিরেই পরে বিতর্ক দানা বাঁধল। অনেকেই জানেন, এই ছবিতে অভিনেত্রী কিরণ খের ছিলেন। চরিত্রটিকে মুখে আঁচল দিয়ে কথা বলানোর স্টাইলটা ঋতু শিখিয়ে দিয়েছিল। কারণ সে ক্ষেত্রে পরে ডাবিংয়ে লিপ নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না। পরে তো রীতা (কয়রাল) ওঁর হয়ে ডাবিং করলেন। বলা হয়েছিল কিরণই ডাবিং করেছেন। কারণ ছবিটা জাতীয় পুরস্কারে যাবে। এ দিকে আমার কণ্ঠস্বর ডাব করল সব্যসাচী চত্রবর্তী। হয়তো আমারও জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেই সুযোগ হারালাম।

movie poster of Bariwali

‘বাড়িওয়ালি’ ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত।

অনেকেই হয়তো জানেন না, ‘বাড়িওয়ালি’র জন্য আমি ডাবিংও করেছিলাম। কিন্তু শেষে সেটা বাদ দিয়ে সব্যসাচীকে দিয়ে ডাবিং করাল ঋতু। আমার থেকে ও এনওসি চেয়ে নিয়েছিল। অনেকেই আমাকে তখন বারণ করেছিল। অনেকেই বলেছিলেন, এটা অন্যায়! কিন্তু আমি অন্যায় হচ্ছে জেনেও দিয়েছিলাম। ছবির স্বার্থে দিয়ে দিয়েছিলাম। পরে বেণু (সব্যসাচী চক্রবর্তীর ডাক নাম) পর্যন্ত আমাকে বলেছিল যে, ‘‘না রাজি হলেই পারতেন।’’ আমি ওকে তখন একটাই কথা বলেছিলাম, ‘‘সিনেমাই জীবন নয়, জীবনে আরও অনেক কিছু রয়েছে। সিনেমা করে তো নোবেল পাওয়া যায় না।’’ একটা সুযোগ ছেড়ে দিয়ে খুব বেশি কিছু হারালাম কি! আজকে এই কথাগুলো বলছি বটে, তবে ঋতুর প্রতি আমার এই নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই।

‘বাড়িওয়ালি’র পরেও ঋতুর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। তবে বন্ধুত্বটা আর সেই পর্যায়ে আর ছিল না। মনে পড়ছে, পরবর্তী সময়ে ঠিক করল যে, একটা ছবির জন্য কয়েকটা দৃশ্য আমার বাড়ির বারান্দায় শুট করবে। আমাকে বলতেই আমি রাজি হয়ে যাই। হইহই করে ওরা শুটিংও করেছিল। আমি কোনও রকম আপত্তি করিনি। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বের গভীরতা আর সেই আগের মতো ছিল না।

এতটা পড়ে অনেকই হয়তো ভাবতে পারেন যে, আমি ঋতুর সমালোচনা করছি। এটা সমালোচনা নয়, এটা সত্য। আর আমার মনে হয়, আমার সঙ্গে ঋতুর সম্পর্কে সেই স্বচ্ছতা ছিল। তাই সত্যি কথাটা বলতে আমার কোনও ভয় নেই। আমি কিন্তু ওর অত্যন্ত গুণমুগ্ধ। বাংলায় আজকে ওর মতো পরিচালকের খুব দরকার। কারণ ঋতু বাংলা ছবিকে জাতীয় স্তরের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। আরও একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই। এখন তো বাংলা বাণিজ্যিক ছবির সংখ্যা কমে গিয়েছে। ঋতু কিন্তু বাংলা মসালা ছবির সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিল। আমাকে স্পষ্ট বলত, ‘‘স্বপন সাহা ইন্ডাস্ট্রি বাঁচান, আমরা তাই ছবি করতে পারি।’’ এই সত্যিটা ঋতু কিন্তু সহজেই বলতে পারত। দুঃখ, এই কথাটা অন্য কেউ কিন্তু বলেন না। ঋতুকে আমি আজও মিস্ করি। ওর ছবি মিস্ করি। এত প্রতিভা ছিল ওর। এতটা তাড়াতাড়ি না চলে গেলেও পারত।

(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)

আরও পড়ুন
Advertisement