নবনীতা দেবসেনের জন্মদিনে মাকে নিয়ে কলম ধরলেন মেয়ে নন্দনা সেন
Nandana Sen

Nabaneeta Dev sen: ‘তোমার দু’চোখ জলে ভরে উঠতেই জাপটে ধরেছি, আজ জন্মদিনে কোথায় হারিয়ে গেলে মা’

তোমায় প্রশ্ন করেছিলাম, ‘‘মা, পরিদের ডানা কী দিয়ে তৈরি? প্রজাপতির? পাখির? নাকি ফুলের পাপড়ি দিয়ে?’’ হেসে বলেছিলে, ‘‘অনেক রকমের পরি হয় সোনা।’’

Advertisement
নন্দনা সেন
নন্দনা সেন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২২ ০৭:১৩

মা, তোমার টুমপুশের মনে পড়ে তার মাথাভরা কোঁকড়ানো চুল আঁচড়ে তোমার বিনুনি বেঁধে দেওয়ার কথা। খুব ছোটবেলায় শত ব্যস্ততার মাঝেও যত্ন করে খাইয়ে দেওয়ার কথা। দিন কত পাল্টে যায় সব! বড়বেলায় একাকী প্রবাসে হঠাৎ তোমার ব্যবহার করা আমার চিরুনিতে দেখি তোমার চুলের ঢেউয়ের টুকরো। বিলাসী হোটেল ছেড়ে মেয়ের দেড় কামরার ডেরায় এসে উঠেছিলে যখন, সেই দিনগুলোয় কে নবনীতা দেবসেন? কে মা? কেই বা মেয়ে?

সে যেন দুই সমবয়সি রুমমেট। আর তোমার টুমপুশ সেদিনই তো তোমার মা হয়ে গিয়েছে যে দিন ছোট্ট মেয়ে হয়ে গেলে তুমি, তোমায় ভুলিয়ে আদর করে চামচে করে দইয়ের সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ানোর কাজ যখন আমার শুরু হল। আমি তখন তো আর সেই ছোট্ট টুম্পা নেই মা। আমার বিশ্ব অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

কয়েক বছর আগে ‘ভাল-বাসা’ বাড়ির বইয়ের তাক ঘাঁটতে ঘাঁটতে বের করেছিলাম ‘৩৬৫ বেডটাইম স্টোরিজ’। পাতা উল্টোতেই একের পর এক ঝরতে লাগল লাল, হলুদ, সোনালি পাতা। পাতার মধ্যে দিয়ে খুলে গেল আমার ছোটবেলা। লন্ডনে খুব ছোটবেলায় জমিয়ে রাখা হেমন্তের ওক, মেপল, ফার্ন পাতা। যে ঢালু জমির উপরে আমাদের বাড়ি ছিল তার নীচের ছোট্ট জঙ্গল থেকে তুমি, দিদি আর আমি পাতাগুলো কুড়িয়ে এনেছিলাম! তখনই এক রাতে তুমি গল্প শোনাচ্ছিলে। আজ মনে হয় কত রকম কাজ করতে তুমি। কিন্তু আমাদের মধ্যে গল্প দিয়ে রূপকথা বুনতে ভোলোনি তুমি। এক বার এমনই এক গল্প শোনার দিনে আমি তোমায় থামিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘‘মা, পরিদের ডানা কী দিয়ে তৈরি? প্রজাপতির? পাখির? নাকি ফুলের পাপড়ি দিয়ে?’’ তুমি হেসে বলেছিলে, ‘‘অনেক রকমের পরি হয় সোনা। ঠিক যেমন অনেক রকমের মানুষ!’’ আমি না থেমে ফের জানতে চেয়েছিলাম, ‘‘সব পরিই কি তোমার মতো দেখতে?’’ তুমি সরাসরি বলেছিলে, ‘‘পরি পরমা সুন্দরী!’’ আমি কিন্তু দমিনি। শরীর মুচড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম, ‘‘তুমিই পৃথিবীর সেরা সুন্দরী।’’ তোমার হাসি সে দিন থামতেই চাইছিল না। এখনও তোমার গলার স্বর স্পষ্ট কানে ভাসে, ‘‘ছোটবেলায় সব মেয়েরাই তার মাকে ‘পরি মা’ দেখে সোনা!’’ কী জানি। যে টুকু জানি,তুমি আমার এক অপরূপা আশ্চর্য পরি।

খুব ছোটবেলায় ঘর ছেড়েছি। খুব সুন্দর কিছু বন্ধু পেয়েছি। ওরাই ধীরে ধীরে আমার পরিবার হয়েছে। কাজের জায়গায় কত সুন্দর মুখের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। রূপবান কত মানুষের সঙ্গে পথ-চলাও। সুন্দর মনকে ভালবেসেছি। হ্যাঁ, আমরা সবাই এখন অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছি মা। তবু তোমার জন্মদিন এলে আমি ফিরে যাই কলেজ বেলায়।

কেমব্রিজে আচমকাই এক বার তুমি। সঙ্গী এক গাদা সম্মেলন, স্যুটকেস আর তোমার অগুন্তি অনুরাগী। আমার সে বার প্রথম সেমেস্টার। অভিজাত আতিথ্য ছেড়ে তুমি সটান আমার দেড়খানা কামরার ডেরায় হাজির। যেটায় থাকতাম আমি আর আমার রুমমেট। শুধু থাকা? তুমিও যেন ফিরে গেছ তোমার ছাত্রবেলায়। ডর্মেটরি লাগোয়া কাচ আর স্টিল দিয়ে ঘেরা চৌখুপিতে মিনিট তিনেকের স্নান সেরে তুমি হলে আমাদের সই।

তার পর তোমার দেশে ফিরে যাওয়া। আর আমার এ পারের পরবাস। ঘাড়ের পিছনে শ্বাস ফেলছে মিডটার্ম পরীক্ষা। প্রথম দিন তড়িঘড়ি উঠে স্নানঘরে পা রাখতে গিয়ে দেখি সব খুপরি আটকা! নিরুপায় আমি অগত্যা সেই পুরনো বাথরুমে। কোনও মতে কাক স্নানের চেষ্টায় যখন ব্যস্ত তখনই চোখ গিয়েছিল তোমার ছেড়ে যাওয়া লাল বিন্দির উপরে। পুরনো, শ্যাওলা সবুজে ঝলমল করছে! ঠিক তোমার কপালে যেমন করত। ওই লাল বিন্দু নিমেষে এত্ত বড় হয়ে যেন ঘিরে ফেলল আমায়। আমি যেন তোমার গায়ের গন্ধ পেলাম! আমার স্নানের জলে কি মিশে গেল শিশুদিনের বাথটাব! তোমার হাতের বেবি সাবান আর কপালের লাল সুয্যিমামার মতো গোল টিপের দুপাশে তোমার ঢেউখেলানো চুলের ঝর্ণা...

আসলে তুমি এ রকমই। এক আশ্চর্য মেয়ে।যদি তুমি আমার মা নাও হতে। যদি শুধুই কলেজের অধ্যাপিকা হতে। কিংবা নিছক কোনও কেজো সম্পর্কে বাঁধা পড়তাম আমরা। জন্ম-বৃত্তান্ত পেরিয়ে শুধুই যদি হতে বন্ধু, কবি, চিত্রকর বা বিমানের সহযাত্রী! আমার মনে হয় তা হলেও তুমি এমনই হতে! এ রকম মা! জাপটে, জড়িয়ে থাকার মতো কেউ এক জন। হঠাৎ আসায়, হঠাৎ ডাকায়, দাবিতে, ত্যাগে স্নেহে, বালিকার মতো অভিমানে, ভালবাসায় মাখা এক ভীষণ 'ভাল' মানুষ।

আমার প্রবাসের স্মৃতির বাতাসে লেগে আছে তোমার শাড়ির রঙ। গাঢ় নীল দক্ষিণী সিল্ক, বেগনী পাড়। মেরুন গাদোয়াল, কালো পাড়ে সোনালি জড়ি। গলার সেই মঙ্গলসূত্র। কেমব্রিজে তোমার থাকাকালীন আমার চিরুনিতে তোমার লম্বা কাঁচা-পাকা চুল। নৈশভোজে আমার হাত ধরে হল ঘরে ঢুকলেই হাজার ছাত্রের চোখের দৃষ্টির মুগ্ধতা। তোমার মত গ্রেসফুল আর কে আছে বলো! তাদের সামনে দিয়ে রানির মতো তোমার হাঁটাচলা! তোমার ব্যবহার করা সুগন্ধি। রাত জেগে কাজের ভার নামানো। তারই ফাঁকে দুই বোনের রুখু গালে ক্রিম ঘষা। সাদা ক্যানভাস রঙিন হয়ে উঠত তোমার তুলির আঁচড়ে। তোমার স্বপ্ন আর অতীতচারণ, তোমার আকাশে মেলে দেওয়া ডানা আর তোমার গভীর শিকড়ের ঘ্রাণ।

হিয়ামন আর মেঘলা, দুই পরির মতো নাতনিকে ঘিরে তোমার স্বপ্ন আর আদর দেখতে আমরাও সত্যি সত্যিই, কত বড় হয়ে গেলাম মা গো। তোমার দুই মেয়েকে বড় করতে গিয়ে তাদের কত জেদ তুমি সহ্য করেছ। কত ঝগড়া করেছি তোমার সঙ্গে! আমায় না বুঝলে কেঁদে ভাসিয়েছি। আবার অন্যের রাগ ফলিয়েছি তোমার উপরে। তোমার দু’চোখ জলে ভরতে উঠতেই জাপটে ধরেছি তোমায়। এ সব আজ কোথায় হারিয়ে গেল?

তোমার জন্মদিনে আজ ভাল-বাসা বাড়িতে এসেছি। তোমার সঙ্গে, দিম্মার সঙ্গে দেখা হবে বলে। প্রতিবারের মতো কানাইদা পায়েস বানাবে। তোমার আদর পেত যে ফুল-দোকানি মেয়েটি, সে দিয়ে যাবে তোমার প্রিয় হলুদ চন্দ্রমল্লিকা। তোমার কবিতার অনুবাদ নিয়ে যে বই করেছি, তা নিয়ে আড্ডায় বসব তোমারই বৈঠকখানা থেকে। তুমি শুনবে তো, মা?

আরও পড়ুন
Advertisement