Celebrity Interview

‘মহিলা পরিচালক‍’ তকমা এ বার বাদ দিতে হবে: কানজয়ী পরিচালক পায়েল কাপাডিয়া

কান চলচ্চিত্র উৎসবে ভারতের নাম উজ্জ্বল করেছেন তিনি। ভারতের প্রেক্ষাগৃহে চলছে তাঁর ছবি ‘অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ় লাইট’। কলকাতায় হয়ে গেল ছবির বিশেষ প্রদর্শন। তার মাঝেই আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথা বললেন পায়েল কাপাডিয়া।

Advertisement
স্বরলিপি দাশগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ২০:১৭
Image of Payal Kapadia

পরিচালনা না কি সম্পাদনা করবেন, তা নিয়ে ধন্দে ছিলেন পায়েল কাপাডিয়া। ছবি: সংগৃহীত।

কান চলচ্চিত্র উৎসবে গ্রাঁ প্রি সম্মান পেয়েছে তাঁর ছবি। সম্প্রতি প্রেক্ষাগৃহেও মুক্তি পেয়েছে ‘অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ় লাইট’। ছবির বিশেষ প্রদর্শনে কলকাতায় সোমবার শহরের প্রেক্ষাগৃহে হাজির হয়েছিলেন কান-জয়ী পরিচালক পায়েল কাপাডিয়া। পরনে কুর্তা ও প্যান্ট। গলায় জড়ানো ওড়না। প্রদর্শনে উপস্থিত অতিথিদের বাংলা কথা শুনছেন, বুঝছেন ও উত্তর দিচ্ছেন মুম্বইবাসী পরিচালক। এর মাঝেই আনন্দবাজার অনলাইনের মুখোমুখি তিনি।

Advertisement

প্রশ্ন: আপনি তো বাংলা ভাষা স্পষ্ট বুঝতে পারেন। মুম্বইবাসী হয়েও কী ভাবে এটা সম্ভব?

পায়েল: প্রতিটি কথার অর্থ খুব ভাল বুঝি, তা নয়। তবে কী নিয়ে কথা হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারি। তার একটা কারণ আছে। এফটিআইআই-তে (ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া) পড়ার সময় ৩০ শতাংশ পড়ুয়া বাঙালি ছিল। তাই বাংলা না বুঝে কোনও উপায় ছিল না। বাংলা না বুঝলে, ওদের সব আড্ডা-আলোচনা থেকে পিছিয়ে থাকতে হতো (হাসি)।

প্রশ্ন: বাংলা বলতেও পারেন?

পায়েল: না, বাংলা বলতে এখনও পারি না। তবে বাংলায় কেউ কথা বললে, বুঝতে পারি।

প্রশ্ন: ছবির প্রসঙ্গে আসা যাক। কান চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানিত হল আপনার ছবি। এখন পিছন ফিরে দেখলে কী মনে হয়?

পায়েল: আমরা এই সাফল্য আশাই করিনি। আজই প্রযোজকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ২০২৩-এর ১৭ নভেম্বর আমরা ছবির শুটিং শেষ করেছিলাম। এক বছর পেরিয়ে গেল। ছবিটি শেষ করার পরে স্বস্তির শ্বাস নিয়ে ভেবেছিলাম, আমরা পেরেছি। খুব মন দিয়ে কোনও কাজ করলে, অনেক দূর পর্যন্ত যেতে হয়। কতগুলো ধাপ পেরোতে হয়েছে কাজটা শেষ করতে! কাজটা সম্পূর্ণ হওয়ার পরেই তাই একটা সন্তুষ্টি কাজ করছিল। ছবির যথাযথ অর্থ (ফান্ডিং) জোগাড় করতেই অনেকটা সময় লেগেছিল। কাজটা যে শেষ করতে পেরেছি, এটি নিয়েই আমরা খুব উচ্ছ্বসিত ছিলাম।

প্রশ্ন: আন্তর্জাতিক মঞ্চে সম্মানিত হওয়ার মুহূর্তে অনুভূতি কেমন ছিল?

পায়েল: অবশ্যই, সে এক অসাধারণ অনুভূতি ছিল। আরও ভাল লেগেছিল কারণ, ছবির কলাকুশলীরাও দর্শকাসনে ছিলেন। ২৫ জন কলাকুশলী উপস্থিত। ছবির অভিনেত্রীরা ছিলেন বলে আরও আনন্দ পেয়েছিলাম। সকলে মিলে তৈরি করা একটা কাজ। বেশ কিছু ক্ষেত্রে কিন্তু ওঁরা নিজেরাই তৈরি করে সংলাপ বলেছেন। তাই সেই মুহূর্তে ওঁদের সঙ্গে পেয়ে খুব ভাল লেগেছিল। নিজেদের একটা গোষ্ঠীর মতো মনে হচ্ছিল।

প্রশ্ন: ভারতীয়দের কাছে মুম্বই স্বপ্নের শহর। এই শহরের চাকচিক্যই অধিকাংশ ছবিতে দেখা যায়। সেখানে আপনার ছবিতে মুম্বই অনুজ্জ্বল ও ম্লান...

পায়েল: হ্যাঁ, আসলে বহু আগে থেকেই মুম্বইয়ের কর্মরতা মহিলাদের নিয়ে ছবি তৈরি করতে চেয়েছিলাম। আর নার্সিং পেশাককে বেছে নিয়েছিলাম এই ছবির চরিত্রদের জন্য কারণ এই পেশায় বহু মহিলা অন্য রাজ্য ও শহরতলি থেকে মুম্বই এসে কাজ করেন। তা ছাড়া আমি ছবিতে বন্ধুত্বের সম্পর্কও তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। ভিন্ন প্রজন্মের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব। আসলে এমন বন্ধুত্ব আমারও ছিল। আমি সেখান থেকে অনেক কিছু শিখেছি।

প্রশ্ন: মুম্বইয়ের রাস্তা, ট্ৰ্যাফিক নিয়ে প্রায় সকলেই অবহিত। সেই ভিড়ের মধ্যে শুটিং করলেন কী ভাবে?

পায়েল: মুম্বইয়ের রাস্তায় শুটিং করার বিষয়টি কঠিনই ছিল। আসলে মুম্বইয়ের রাস্তা আটকে শুটিং করা বেশ খরচসাপেক্ষও। খুব বেশি জুনিয়র আর্টিস্টও ছিলেন না। তবে আমি কিন্তু মুম্বইয়ের জনবহুল রাস্তাই দেখাতে চেয়েছিলাম। আমরা ছোট ক্যামেরা নিয়ে তথ্যচিত্রের মতো করে শুট করেছি। পথচলতি মানুষ হয়তো ভাবছিলেন, আমরা রিল তৈরি করছি। তাই আমাদের খুব একটা গুরুত্ব দেননি (হাসি)।

প্রশ্ন: ছবির প্রতি আগ্রহ ও পেশা হিসাবে চলচ্চিত্র নির্মাতা হয়ে ওঠার সিদ্ধান্ত কবে নিলেন?

পায়েল: কৈশোর থেকেই ছবি বানাতে চেয়েছিলাম। তবে সেই সময় ছবি পরিচালনা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। ছবির পরিচালনা করব না কি সম্পাদনা করব, এই নিয়ে যথেষ্ট ধন্দে ছিলাম। তারপরে তো ছবির সম্পাদনা শেখার জন্য এফটিআইআই-তে ভর্তির আবেদন করি। কিন্তু সুযোগ পাইনি। বেশ ভেঙে পড়েছিলাম। ঘুরে বেড়াতাম। বহু বছর ধরে সহ-পরিচালকের কাজ করেছি। আবার সাহস সঞ্চার করে এফটিআইআই-তে আবেদন জমা দিলাম। তবে এ বার ছবি পরিচালনার বিভাগে আবেদন করেছিলাম। আর নিরাশ হইনি। সুযোগ পেলাম। ওই ঘটনাই আরও স্পষ্ট করে দিয়েছিল, ছবি পরিচালনা করাই আমার কাজ।

প্রশ্ন: আমাদের সমাজ এখনও পুরুষতান্ত্রিক। নিজের সফরে কখনও লিঙ্গ বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছেন?

পায়েল: সরাসরি লিঙ্গ বৈষম্যের মুখে পড়িনি। তবে হ্যাঁ, নানা রকমের মন্তব্য উড়ে আসে। তেমন মন্তব্যে আমিও আঘাত পেয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা বোধহয় সব মহিলারই কখনও না কখনও হয়েছে। কী হয়েছিল, সেগুলি আর মনে করতে চাই না। দুর্ভাগ্যবশত প্রত্যেক মহিলাকেই প্রতিনিয়ত এই লড়াইটি চালিয়ে যেতে হয়। তবে আমি পরিবার থেকে সমর্থন পেয়েছি। আমার মা নিজেও একজন শিল্পী। মাকে বরং তাঁর সময় আরও বেশি লড়াই করতে হয়েছিল। মায়ের জন্য আমার সফর আর একটু সহজ হয়েছে। অন্য অনেক পরিবারেই দেখেছি, পরিবার চায় ছেলেমেয়েরা ইঞ্জিনিয়র বা চিকিৎসক হোক। সেখান থেকে চলচ্চিত্র জগতে আসতে তাঁদের লড়াই করতে হয়। সেই জায়গায় আমার অসুবিধা হয়নি। আমার পরিবার সব সময়ে পাশে থেকেছে। আরও একটা বিষয় রয়েছে। আসলে পরিচালককে 'মহিলা পরিচালক‍' হিসাবে দেখা বন্ধ করতে হবে। কারণ পরিচালক পুরুষ হলে তাঁকে শুধুই পরিচালক হিসাবেই গণ্য করা হয়। গোড়ার এই সমস্যা থেকে বেরনো দরকার।

প্রশ্ন: বিশেষ করে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আসার পরে ছবি দেখার অভ্যাসেও বেশ বদল এসেছে। কী মনে হয়, এখনও বাণিজ্যিক ছবি ও অন্য ধারার ছবিকে আলাদা করে দেখা যায়?

পায়েল: আসলে এখনকার দর্শক খুব বুদ্ধিমান। তাঁরা ভাল গল্প, ভাল চরিত্র খোঁজেন। ছবি ভাল হলে দর্শক দেখবেন। আমার মনে হয়, ভারতীয় দর্শক ভিন্ন স্বাদের ছবি দেখতে ও গ্রহণ করতে পারেন। আমাদের দেশে ছবির বিরাট ইতিহাস রয়েছে। ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে হয়তো কিছু পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু দর্শক যে কোনও ভাল ছবি দেখতে পছন্দ করেন বলেই আশা করি।

প্রশ্ন:‘অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ় লাইট’-এর জন্য বলিউড থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন?

পায়েল: তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া পাইনি। সেই ভাবে আসলে বলা মুশকিল। যদিও, পরিচালক জ়োয়া আখতার ছবির একটি বিশেষ প্রদর্শনের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে তিনি বেশ কয়েকজন পরিচালক-অভিনেতাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যাঁরা ছবিটা দেখেছেন ভালই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

প্রশ্ন: বাংলা ছবি নিয়ে আপনার কী মতামত?

পায়েল: বাংলায় চলচ্চিত্র জগতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বাংলার দর্শকেরও ছবি নিয়ে জ্ঞান রয়েছে বলে মনে হয়। তাই নিজের ছবির প্রদর্শনে এখানে আসতে পেরে খুব ভাল লেগেছে।

প্রশ্ন:বাঙালি কোনও শিল্পীর সঙ্গে কাজ করার কথা ভেবেছেন?

পায়েল: আমি বহু বাঙালি ‘টেকনিশিয়ানের’ সঙ্গে কাজ করেছি। আমার ‘সিনেমাটোগ্রাফার’ রণদীপ, সঙ্গীত আয়োজক তোপসেও কলকাতার। প্রযোজক জ়িকো মৈত্রই তো কলকাতার (হাসি)।

প্রশ্ন: কান-জয়ী অভিনেত্রী অনসূয়া সেনগুপ্ত তো আপনার বন্ধু। একসঙ্গে কাজ করার কথা ভেবেছেন?

পায়েল: হ্যাঁ, আমরা বন্ধু। বহু দিন ধরে পরস্পরকে চিনি। অনসূয়াও অসাধারণ একজন শিল্পী। ‘প্রোডাকশন ডিজ়াইনার’ হিসাবে উনি অসাধারণ। অভিনেত্রী হিসাবেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ওঁর সাফল্যের জন্য আমি খুবই খুশি। তবে এখনও কোনও কাজের পরিকল্পনা হয়নি। অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে চাই কারণ আমি ওঁর ভক্ত।

প্রশ্ন: আগামীতে আর কী কী কাজ করছেন?

পায়েল: মুম্বই শহরের উপর ভিত্তি করে আরও একটি ছবি তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে।

আরও পড়ুন
Advertisement