সায়ন্তন ঘোষালের ‘স্বস্তিক সংকেত’ ছবিতে তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।
ওজন ঝরিয়ে ছিপছিপে। নীল ডেনিম আর সোয়েট শার্টেই ঘরের পারদ চড়িয়ে দিয়েছেন। কে বলবে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন! সায়ন্তন ঘোষালের ‘স্বস্তিক সংকেত’ ছবিতে তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় না রাজকুমার রাও, কাকে টক্কর দিতে চলেছেন?
প্রশ্ন: ১৯ ডিসেম্বর মেয়ে হিয়া খুব মিস করেছে তার বাবাকে, খোলা চিঠিও লিখেছে...
শাশ্বত: (মৃদু হেসে) হ্যাঁ, বাইরে ছিলাম। আনন্দবাজার অনলাইনে ওর লেখা পড়েছি। হিয়ার চিঠি বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে। আমায় মোবাইল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে মেয়ে। ইদানীং মোবাইল ব্যবহার করছি। তবে শহরের বাইরে থাকলে। শ্যুট সেরে দিনের শেষে বাড়ির খবর নিই। নিজের খবর দিই। ব্যস, ফুরিয়ে গেল। মোবাইলে উপুড় হয়ে থাকতে পারছি না! চাইছিও না। মনে হয়, যেন চোখে ঠুলি গোঁজা। বিনোদনকে মুঠোয় বন্দি করতে রাজি নই আমি। মোবাইল আমার কাছে খেলনাও নয় যে, সারাক্ষণ ওকে নিয়ে খেলব।
প্রশ্ন: ফিরে এসে জন্মদিন উদযাপন হল?
শাশ্বত: হল। কেক কেটে, ভাল-মন্দ খেয়ে। উপহারটাই কেবল ফাঁকি হয়ে গেল!
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু গুছিয়ে উপহার দিয়েছে। ড্যানিশ, নাগ অশ্বিন, স্বস্তিক সংকেত.... নানা ভাষায় নানা স্বাদের ছবি!
শাশ্বত: সত্যিই ভাগ্যবান আমি। সবাই এটা পান না। তবে মজার কথা, যখন কাজ আসে, তখন হুড়মুড়িয়ে আসে। আবার এমনও সময় আসে, যখন হাতে একটাও কাজ থাকে না। সেই দিক থেকে আপাতত আমার ভাল সময় যাচ্ছে।
প্রশ্ন: বলিউড, তামিল ছবি করতে করতে হঠাৎ সায়ন্তন ঘোষালের ‘স্বস্তিক সংকেত’-এ সাড়া? নেতাজি, বাঙালি আবেগ...?
শাশ্বত: আমি প্রথমে গল্প শুনেছি। সেই অনুযায়ী ছবিতে নেতাজি আর হিটলার যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।। দ্বিতীয় কারণ, অবশ্যই নেতাজি। আমার খুব ইচ্ছে ছিল সুভাষচন্দ্র বসুর চরিত্রে অভিনয় করার। উদ্বেগও ছিল। আমায় নেতাজি হিসেবে মানাবে তো! সেই সময়ে লন্ডনে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘অনুসন্ধান’ ছবির শ্যুট করছিলাম। ফলে, সব মিলিয়ে ডাক পেতে রাজি হয়ে গেলাম।
প্রশ্ন: রূপটানের পরে উদ্বেগ কমল?
শাশ্বত: সত্যিই কমল। সোমনাথ কুণ্ডুর প্রস্থেটিক রূপটান। আর ওঁর তৈরি বিশেষ নাক। দুইয়ের যোগ ঘটার পরে আয়নায় নিজেকে দেখে অবাক হয়েছিলাম। ওই নাকটা বসানোর পরেই নিজের মধ্যে একটা ‘নেতাজি নেতাজি’ ভাব হল।
প্রশ্ন: লুক দেখে অনুরাগীরা বলছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, রাজকুমার রাওকে নাকি টক্কর দিতে চলেছেন!
শাশ্বত: বাজে কথা! কোনও টক্করের ব্যাপার নেই। জেমস বন্ড চরিত্রটিকে বহু হলিউড তারকা তাঁদের নিজেদের মতো করে ফুটিয়েছেন। তা বলে কোনওটাও কি কম গ্রহণযোগ্য হয়েছে? রাজকুমার রাও ‘বোস, ডেড অউর অ্যালাইভ’-এ বা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ‘গুমনামী’তে নিজের মতো করে অভিনয় করেছেন। এই ছবিতে আমি আমার মতো করে করব।
প্রশ্ন: নিজের কোনও প্রস্তুতি ছিল?
শাশ্বত: ছোটবেলায় নেতাজির উপরে তৈরি বাংলা ছবি দেখেছি। ছয়ের দশকের শেষে তৈরি সাদা-কালো ছবি। তা ছাড়া, নেতাজির আসল কিছু ফুটেজও দেখেছি প্রযুক্তির কল্যাণে। সেখানে ওঁর হাঁটা, কথা বলা, বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গি খুঁটিয়ে নজর করেছি। বাকি বাঙালির মতো নেতাজিকে তো বুকের মধ্যে নিয়েই সারা ক্ষণ কাটাই।
প্রশ্ন: ‘অনুসন্ধান’ দেখে অনেকেই ছোট পর্দার ‘রূপকথা’ বা ‘এক আকাশের নীচে’র শাশ্বতর ঝলক দেখেছেন, তার পরেই ঐতিহাসিক চরিত্র... চমকের পর চমক!
শাশ্বত: (হেসে ফেলে) আমি আসলে দর্শকদের ঘেঁটে গুলিয়ে দিতে ভালবাসি। অথচ আমার কিন্তু কোনও নিজস্ব ইমেজ নেই! এটাই আমার লক্ষ্য ছিল। দর্শক আমায় নানা রূপে দেখবেন। আমি কোনও বিশেষ রূপ বা ইমেজে বন্দি হব না। বলিউড, টলিউড বা দক্ষিণী ছবি কোথাওই না। এখন মনে হচ্ছে কিছুটা হলেও সেটা করতে পেরেছি।
প্রশ্ন: এটা অভিনেতা শাশ্বত হলে জীবনের অর্ধশতক পেরিয়ে আসা শাশ্বত কেমন?
শাশ্বত: যেমন ছিলাম, তেমনিই আছি (হাসি)। ব্যক্তি শাশ্বতর কোনও পরিবর্তন হয়নি। মনে-শরীরে ২৬ পেরোতে পারলাম না! সুযোগ পেলেই রসিকতা করি। ২৫ বছরেরও বেশি সময় অভিনয় করতে করতেই কেটে গেল, এক বারও মনে হয় না! এই তো সে দিন চার্বাক গোষ্ঠীর সঙ্গে যেন মঞ্চাভিনয়ের শুরু।
প্রশ্ন: ছোট-বড় পর্দায় অভিনয় করে প্রমাণ করেছেন ছোট পর্দার অভিনেতা বড় পর্দাতেও মানানসই...
শাশ্বত: সেটা হয়তো করেছি। একদম শুরুতে বড় পর্দায় ছোট ছোট বহু চরিত্র করেছি। প্রভাত রায় ডাকতেন। অঞ্জন দত্ত পরপর কয়েকটি ছবিতে আমায় নিয়েছিলেন। ‘বং কানেকশন’, ‘চলো লেটস গো’, ‘চৌরাস্তা: ক্রশ রোডস অফ লাভ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। তখনও চরিত্র বেছে করতাম। এখন সেটাই আরও বেশি করি। একেবারে শুরুতে যেটা করতে পারতাম না। পাশাপাশি, গল্প, চিত্রনাট্য নিয়েও আমি যথেষ্ট সজাগ।
প্রশ্ন: ২৫ বছরে বাংলা ছবির দুনিয়া সাবালক হয়েছে?
শাশ্বত: আমি সত্যিই জানি না। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের দৌলতে সিনেমা বানানোর পদ্ধতিটা অনেক বদলে গিয়েছে, এটা বুঝতে পারছি। আগে যাঁরা রিল দিয়ে ছবি বানাতেন তাঁরা অনেক বেশি হোমওয়ার্ক করে আসতেন। কোন শটের পরে কোন শট নেবেন, আগাম ঠিক করা থাকত। কারণ, তাঁদের হাতে রিল বা ফিল্ম নির্দিষ্ট ছিল। এখন অনেক পরিচালক পুরো দৃশ্য পাঁচ দিক থেকে পাঁচ বার নিচ্ছেন। তার পর কেটে বাদ দিয়ে ক্ষীরটুকু তুলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এটারও হয়তো ভাল দিক আছে। পাশাপাশি, এটা কিন্তু অভিনেতার উপর এক ধরনের চাপ তৈরি করে দিচ্ছে। ভুল না হলেও একই দৃশ্য পাঁচ বার পাঁচ দিক থেকে করা! একইসঙ্গে, সহজ সরল গল্পও নেই আগের মতো। মানুষও সহজ ভাবে ভাবতে ভুলে গিয়েছে। ছবিও হচ্ছে তেমনই। কৌতুক ছবি আর তৈরিই হয় না! কারণ, কারও জীবনেই আর আনন্দ নেই। তার মধ্যেই কেউ সেই ধরনের ছবি বানালে সঙ্গে সঙ্গে দর্শক লুফে নিচ্ছে।
প্রশ্ন: যেমন ‘টনিক’? আপনি দেখেছেন?
শাশ্বত: (সায় দিয়ে) যেমন ‘টনিক’। কাজের কারণে এত ঘুরছি বলে ছবিটা দেখে উঠতে পারিনি। তবে রিপোর্ট তো পাচ্ছি! শুনেছি, সবার খুব ভাল লেগেছে দেব-পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জুটি। আমার তো বিশেষ করে পরাণদার জন্য বেশি ভাল লাগছে। যাক, ৮৩ বছর বয়সে এসে প্রকৃত অভিনেতা আবিষ্কৃত হলেন। আফশোসও হচ্ছে, যদি অল্পবয়সে এই পরাণদাকে আমরা আবিষ্কার করতে পারতাম!
প্রশ্ন: ২০১২-য় ‘কহানি’র পরে ২০১৮-য় ‘জগ্গা জাসুস’ হয়ে বলিউডে। মায়ানগরী কেমন? রাজনীতি, স্বজনপোষণে ছয়লাপ?
শাশ্বত: এগুলো থাকলে আমি ওখানে কাজ করছি কী করে? আমার তো সেই অর্থে কেউ চেনা-জানা ছিল না! এগুলো নিন্দকদের রটনা। নিজেরা কিছু করতে না পারলে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়। বলিউডে এ সব কিচ্ছু নেই। ঋষি কপূরের ছেলে বলে রণবীর কপূর অভিনয় করবেন না! তাঁকে কেউ সুযোগ দেবে না? কিংবা আরও এক জন আলিয়া ভট্ট দেখান তো? এত অল্প বয়সে কী জোরালো অভিনয় ক্ষমতা! ওঁদের বিকল্প দেখাতে পারবেন কেউ? আগে দেখান, তার পরে না হয় স্বজনপোষণের দোহাই দেবেন!
প্রশ্ন: নাগ অশ্বিনের ‘প্রোজেক্ট কে’ দিয়ে তামিল ছবিতে অভিনয় করছেন। তেলুগুও শিখছেন অভিনয়ের খাতিরে। তিনটি ইন্ডাস্ট্রির তুল্যমূল্য বিচার তা হলে কী দাঁড়াল?
শাশ্বত: আমাকে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় বানিয়েছে বাংলা বিনোদন দুনিয়া। তাই বাংলাকে আগে রাখব। তার পরে হিন্দি ছবির জগৎ। তামিল-তেলুগুর থেকে পালাতে পারলে বাঁচি। বাপ রে বাপ! কী কষ্ট কী কঠিন। একটা ভাষা না জেনে বলা, সেই ভাষায় অভিনয় করা খুবই শক্ত। অন্যরা দ্রুত শিখে নিতে পারছেন। আমার একটু সময় লাগছে। তবে মনে হয় সামলে নিতে পারব। তবে খুবই চিন্তায় আছি। দু’দিনের শ্যুটেই ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি দশা! ঠিক করেছি, তামিলের কাজ শেষ করে একটু হাঁফ নিয়ে তার পর তেলুগু ছবি শুরু করব।
প্রশ্ন: বাংলার অন্য তারকারাও বলিউডে, দক্ষিণ ভারতে রাজত্ব করছেন, অন্যতম কারণ তুলনায় আপনারা সুলভ?
শাশ্বত: সেটা বলিউড ভাল বলতে পারবে। নতুন মুখ পাচ্ছেন বলে, ভাল কাজ পাচ্ছেন বলে নাকি সুলভে পাচ্ছেন বলে! শুধু চেনাজানা দিয়ে ওখানে টিকে থাকা যায় না। আর যাঁরা অর্থনৈতিক দিক নিয়ে কটাক্ষ করছেন তাঁদের বলছি, ব্যক্তিগত ভাবে যোগাযোগ করুন। আমার পারিশ্রমিক জানিয়ে দেব। হতাশায় ভুগে এত হিংসে করা কি ভাল? এতে আর যাই হোক উন্নতি হয় না। অন্যকে ছোট করে নিজে বড় হওয়া যায় না।
প্রশ্ন: ২০২২-ও ‘বুকড’ তো?
শাশ্বত: (হেসে ফেলে) কিছু কাজ হয়ে পড়ে আছে। যেমন, রাজকুমার সন্তোষীর ‘ব্যাড বয়’। অনুরাগ কাশ্যপের ‘দোবারা’। নেটফ্লিক্সের জন্য হিন্দিতে প্রতীম ডি গুপ্তের সিরিজে অভিনয় করছি। আরও একটি সিরিজের কাজ শুরু হতে চলেছে। ‘নাইট ম্যানেজার’-এর হিন্দি সংস্করণে আমি অনিল কপূরের সঙ্গে কাজ করব জানুয়ারি থেকে। নাগ অশ্বিনের ‘প্রোজেক্ট কে’-র কাজ রয়েছে। হায়দরাবাদে নাগার্জুনের অন্নপূর্ণা স্টুডিয়োয় শ্যুট করলাম।
প্রশ্ন: পেশার খাতিরে সারাক্ষণ বাইরে, চূড়ান্ত ব্যস্ততা... আপনাকে না পেয়ে স্ত্রী, মেয়ে অভিমান করেন না?
শাশ্বত: আমার মতো তাঁরাও চূড়ান্ত ব্যস্ত। মহুয়া স্কুলে পড়ানো নিয়ে। হিয়া ওর পড়াশোনা নিয়ে। ফলে, জীবনে একসঙ্গে আমরা বেরোতে পারি না। ব্যতিক্রম পুজো। পুজোয় আমি আবার কলকাতায় থাকতে চাই না। আর ওরা কলকাতা ছেড়ে বেরোতে চায় না। ফলে, আমি এ বছর নিজেই চলে গিয়েছিলাম মেঘালয়। রেস্তরাঁ আর ছবি দেখা ছাড়া তিন মূর্তির এক হওয়াটাই খুব চাপের।
প্রশ্ন: ওমিক্রন কি এই ব্যস্ততায় ছায়া ফেলতে চলেছে?
শাশ্বত: আমি ভয়, ভাবনা কিছুই করছি না। এতই যদি দেশ জুড়ে অসুস্থতা, তা হলে প্রেক্ষাগৃহের পিছনে হাত ধুয়ে পড়ে না থেকে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, মিছিল বন্ধ করলেই তো হয়! ওতে কিন্তু ভাইরাস ছড়ায় বেশি। এ সব না হলেই বরং দেশের আর দশের উন্নতি। রাজনীতিবিদরা নিজেদের দিকে কম তাকিয়ে জনগণের দিকে একটু নজর দিন। সবার মঙ্গল হবে।
প্রশ্ন: শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় কি রাজনীতিতে আসছেন? ইচ্ছেমতো দল বদলানোরও সুযোগ থাকবে!
শাশ্বত: কোনও ইচ্ছে নেই। চার দিকে যা দেখছি! এক দল অন্য দলকে বাজে ভাষায় আক্রমণ করছে। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাও তার বাইরে নন। কিছু দিন পরে কোনও শিক্ষিত পরিবারের কেউ আর এ দিকে ঘেঁষবেন না। আর দল বদলানো তো খেলায় হয়। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ইত্যাদিতে। আমি কোনও খেলায় নেই। (একটু থেমে) আমিও কিন্তু দল বদলাচ্ছি। কেউ বুঝতে পারছেন না। এই যে এক প্রযোজনা সংস্থা থেকে আর এক প্রযোজনা সংস্থায় অভিনয় করছি! এ-ও তো বদল নাকি?
পর্দার ‘নেতাজি’র কথা ততক্ষণে চাপা পড়ে গিয়েছে অট্টহাসির আড়ালে...