মন্টু পাইলটে রাফিয়াত রশিদ মিথিলা। ছবি: টুইটার।
রাফিয়াত রশিদ মিথিলা। দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ঘরনি। বেশ কিছু দিন কাটিয়ে এলেন নিষিদ্ধ পল্লি নীল কুঠিতে! খুব কাছে থেকে দেখলেন ‘বহ্নি’কে। কেমন লাগল? বাংলাদেশ থেকে ফোনে প্রথম আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন যৌনপল্লীতে বসবাসের অভিজ্ঞতা...
প্রশ্ন: এই প্রথম ভারতীয় বাংলা সিরিজে। এই প্রথম সাহসী সিরিজে। শুরুতে অনেক দ্বিধা?
মিথিলা: ‘মন্টু পাইলট ২’-এ ‘বহ্নি’ চরিত্রে ডাক পাওয়ার পরে বা গল্প শোনার পরে এক মুহূর্তের জন্য কোনও দ্বিধা, জড়তা কাজ করেনি। কারণ, এটা সমাজের এমন একটা অবহেলিত গোষ্ঠীর গল্প যাঁদের প্রতি মুহূর্তে আমরা সমাজচ্যুত করার চেষ্টা করি। এবং অস্বীকার করি। আমরা মানি বা না মানি যৌনকর্মীরা এই সমাজেরই অংশ। প্রতিটি পেশার মানুষের মতোও এঁদেরও অবদান আছে সমাজে। ওঁরা না থাকলে সমাজের নারীরা এত নিরাপদে থাকতে পারতেন না। কিন্তু ক’জন এঁদের কথা বলেন? দেবালয় বলছেন। এক জন উন্নয়নকর্মী হিসেবে, এক জন অভিনেত্রী হয়ে এমন চরিত্র করতে রাজি হব না! যদিও অভিনয়ের আগে সবার মুখে শুনছিলাম, ‘মন্টু পাইলট’ নাকি প্রচণ্ড বিতর্কিত একটা সিরিজ।
প্রশ্ন: আপনি নিজেও প্রথম সিজন দেখেছেন, খুব বিতর্কিত মনে হয়েছে?
মিথিলা: আমি অন্তত এমন বলার কারণ খুঁজে পাইনি। সিরিজটি আলোচিত হতে পারে। কিন্তু সমালোচিত বা বিতর্কিত হওয়ার মতো কিছু আমার চোখে পড়েনি। যৌনকর্মীদের জীবন, যন্ত্রণা, লড়াই সিরিজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। যা দেখানো উচিত। জানানোও দরকার। ওঁরাও তো এই সমাজেরই বাসিন্দা। তা হলে অকারণে বিতর্ক ছড়াবে কেন? আমি ‘মন্টু পাইলট’ করছি শুনে দুই দেশের বিনোদন দুনিয়ার মানুষদের সে কী প্রতিক্রিয়া! বলেছেন, তুমি এই সিরিজে অভিনয় করবে! মনে হয় ঠিক হবে না। শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম।
প্রশ্ন: সৃজিত মুখোপাধ্যায় নিষেধ করেছিলেন?
মিথিলা: (হেসে ফেলে) আমার পেশাগত কোনও ব্যাপারে সৃজিত মুখোপাধ্যায় কখনও মাথা ঘামান না। মন্তব্যও করেন না। আমি কোন চরিত্রে, কোন পরিচালকের কী ছবিতে বা কোন দেশের ছবিতে বা সিরিজে অভিনয় করব, সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
প্রশ্ন: ‘গঙ্গুবাই’ বোধহয় কিছুটা হলেও ‘মন্টু পাইলট’-এর কাঁধ থেকে বিতর্কের বোঝা কমিয়ে দিয়ে গেল?
মিথিলা: আগেও বলেছি আবারও বলছি, সিরিজ নিয়ে বিতর্ক আমাদের অজ্ঞানতার উদাহরণ। সেটা ‘গঙ্গুবাই’ মুক্তির আগে হোক বা পরে। কেন যৌনকর্মীর জীবন সাধারণ মানুষ দেখবে না? কেন তাঁদের কষ্ট আমরা বুঝব না? কেন ওঁরা আমাদের পাশে জায়গা পাবেন না! কেউ সেটা দেখাতে বা বলতে চাইলে কেন সেই বিষয়কে বিতর্কিত তকমা দেব! সিরিজের বিষয়টি নিয়ে প্রশংসাসূচক আলোচনা হতেই পারে। সবার অভিনয় নিয়ে আলোচনাও হতে পারে। কিন্তু সমালোচনা কোনও মতেই নয়। তবে ‘গঙ্গুবাই’-তে যে ভাবে যৌনপল্লিকে দেখানো হয়েছে সেটা অনেক বেশি জাঁকজমকে ঠাসা। বড় বাজেটের ছবি তো। সিরিজে কিন্তু যৌনপল্লির প্রকৃত চেহারা বা পরিবেশটাই দেবালয় দেখিয়েছেন। এখানে জৌলুসের কোনও জায়গা নেই।
প্রশ্ন: ‘বহ্নি’ কেমন?
মিথিলা: এক দম শুরুতে বহ্নি বড় লোক বাবার আদুরে মেয়ে। যে ঘটনাচক্রে নীলকুঠিতে চলে আসে। এখানে এসে সে নিজেকে যেন নতুন করে চিনতে পারে। নিজের জীবনের সমস্ত কঠিন সিদ্ধান্ত নিজেই আস্তে আস্তে নিতে শেখে। একটা সময়ের পরে মানবী বহ্নি যেন নারীশক্তিতে বলীয়ান হয়ে অতি মানবীতে পরিণত হয়। আমার চরিত্রের দুটো স্তর। বহ্নি আর পরি। বহ্নি আস্তে আস্তে কী ভাবে নিজের উত্তরণ ঘটিয়ে পরি হয়ে উঠবে সেটাই দেখানো হবে দ্বিতীয় সিজনে। এক জন মেয়ে পরিস্থিতির কারণে কত ভাবে বদলে যায়, ঘা খেতে খেতে পরিণত হয়ে ওঠে সেটাই দেখাবে এই চরিত্র।
প্রশ্ন: সমাজকর্মী হিসেবে ‘বহ্নি’র মতো মেয়েদের কাছ থেকে দেখেছেন কখনও? ওঁদের কোনও আচরণ অভিনয়ে ফুটিয়েছেন?
মিথিলা: আমি বহ্নির মতো মেয়েদের দেখেছি। পরিচিত ওঁদের জীবনযাত্রার সঙ্গে। ওঁদের নিয়ে হওয়া ছবি দেখেছি। লেখা পড়েছি। সে সব আমার অভিনয়ে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন: বাস্তবের বহ্নিরা চাইলেই পরি হয়ে উঠতে পারে?
মিথিলা: পারে না। কারণ, সমাজ অনুমতি দেয় না বলে। আসলে, সমাজ কোনও দিনই তথাকথিত স্বাভাবিকত্বের বাইরে কিছু মেনে নেওয়ার অনুমতি দেয়নি। আজও দেয় না। তবে একটি মেয়ে মন থেকে চাইলে বহ্নি থেকে পরি হয়ে উঠতে পারে। তবে চারপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতিও তার সহায় হতে হবে। তা হলেই সে নতুন জীবন শুরু করতে পারবে।
প্রশ্ন: কালীঘাটের যৌনপল্লীতে শ্যুট করলেন?
মিথিলা: না না! শ্যুটের প্রথম দিন কালীঘাট মন্দিরে সবাই পুজো দিয়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলেন। তো, আমি বলেছিলাম আমিও যাব। সেই সূত্রেই যাওয়া। সেই ছবিই সবাই দেখেছেন। পরে সেটে নীলকুঠি তৈরি করে শ্যুট হয়েছে।
প্রশ্ন: মিথিলাকে চরিত্রের খাতিরে কোনও সাহসী পোশাক পরতে হয়েছে? সাহসী দৃশ্যে দেখা যাবে তাঁকে?
মিথিলা: (একটু থেমে) আমি ঠিক জানি না, তথাকথিত ‘সাহসী’ কাকে বলে? চরিত্রের খাতিরে যেটা আমায় করতে হবে আমি সেটাই করব। এক জন অভিনেতার সেটাই করা উচিত। রাজর্ষি দে-র ‘মায়া’ ছবিতেও আমাকে যে ভাবে দেখা যাবে সেটা যথেষ্ট সাহসী। আমায় এর আগে ওই চরিত্রে, ওই সাজে কেউ দেখেননি। সাহসী মানেই খোলামেলা পোশাক আর চুম্বন দৃশ্যে অভিনয় কিন্তু নয়। আমি অন্তত তেমনটাই মনে করি।
প্রশ্ন: অবশেষে গা থেকে ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’র তকমা সরতে চলেছে?
মিথিলা: (আবার হাসি) সরছে মনে হয়। কারণ, গত দু’বছরে আমি খুব সচেতন ভাবেই এমন চরিত্র বেছেছি যাতে গা থেকে ওই বিশেষ তকমাটি সরে যায়। ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’ হতে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু অনেক লম্বা সময় আমি এই ধরনের মিষ্টি মিষ্টি চরিত্রে অভিনয় করে ফেলেছি। এ বার নিজেকে নিয়ে একটু পরীক্ষা-নীরিক্ষা করার পালা। নইলে অভিনেতার অন্তরের খিদে যে মেটে না! তাই কলকাতায় আমি যা যা করেছি সব ক’টিই একটু ভিন্ন স্বাদের। যাতে আমার অভিনয়ের জীবনের বৃত্ত সম্পূর্ণ হতে পারে।
প্রশ্ন: সৌরভ দাস কিন্তু আপনাকে নিয়ে বেজায় ভয়ে ছিলেন! ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করতে গেলে যদি সৃজিত বকেন?
মিথিলা: (হা হা হাসি) তাই? আমাদের কিন্তু তেমনও ঘনিষ্ঠ বা প্রেমের দৃশ্যে অভিনয় নেই। সৌরভ খামোখাই ভয় পেয়েছে। সেটা সিরিজ দেখলেই সবাই বুঝবেন। তবে অভিনয় করতে গিয়ে আমরা পরস্পরের হরিহর আত্মা হয়ে গিয়েছিলাম। যেন যমজ! এক সঙ্গে বসছি। খাচ্ছি, অভিনয় করছি। আবার অবসরে চুটিয়ে আড্ডা মারছি। দুষ্টুমিও করেছি প্রচুর। আমাদের রাতের দিকের অনেক দৃশ্য ছিল। বেশি রাতে তোলা হয়েছিল। রাত জেগে শ্যুট করতে প্রচুর এনার্জি লাগে। সৌরভের সেটা প্রচণ্ড ছিল। ফলে, আমারও অসুবিধে হয়নি। আরও একটা জিনিস খুব ভাল লেগেছে। সৌরভ গান শুনতে শুনতে অভিনয় করে। এই অভিজ্ঞতা আমার প্রথম। দেখলাম, বিষয়টি বেশ ভাল। দ্রুত চরিত্রে ঢুকে যেতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন: একবারও মনে হয়েছে, আয়রা বড় হচ্ছে, মাকে এই ধরনের চরিত্রে দেখে প্রশ্ন করতে পারে?
মিথিলা: আমার তো মনে হয় আমার কাজ দেখে আয়রা প্রশ্ন করবে সেটাই স্বাভাবিক। আমি আরও নানা স্বাদের চরিত্রে অভিনয় করব। এবং পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পরে মেয়ে সে গুলো দেখবে। এবং খুঁটিয়ে জানতে চাইবে। নইলে জানবে কী করে, শিখবে কী করবে? নইলে মানুষের জন্য ওর মনে সহানুভূতি জন্মাবে কী করে?
প্রশ্ন: এখন ঢাকার থেকেও কলকাতা বেশি আপন?
মিথিলা: সেটাই হতে বাধ্য। একে অনেক দিন হয়ে গিয়েছে। তার উপর আমাকেই একা হাতে সব সামলাতে হয়। সৃজিত প্রচণ্ড ব্যস্ত। প্রায় থাকেই না বাড়িতে। আমার ব্যস্ততাও তাই বেড়েছে। দুটো বাড়ি। একটি ঢাকায়। একটি কলকাতায়। দুটো বাড়ির প্রতি সমান নজর। সঙ্গে পেশাগত ব্যস্ততা। আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ। দুই বাংলায় অভিনয়। গবেষণা করা। সব মিলিয়ে একটু চাপ পড়েছে। তবে এই ব্যস্ততা সত্যিই উপভোগ করছি।
প্রশ্ন: কোন বাড়ি মিথিলাকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করল?
মিথিলা: কলকাতা। আমি বরাবর গাছপালা ভালবাসি। কিন্তু এখানে অতিমারির সময় বাড়ির ছাদে নিজের হাতে বাগান করেছি। ১০০ গাছে নানা সবজি, ফুল ফলিয়েছি। তখনই বুঝলাম, আমার মধ্যে এই গুণটা লুকিয়ে ছিল। ঢাকার বাড়িতে কখনও একা থাকিনি। সব সময় মা-বাবা, আত্মীয়, বন্ধু, পরিবারের সঙ্গে থেকেছি। সেখানে এই শহরে আমি আর আমার মেয়ে। একটা বয়সের পরে কোনও মেয়ে এ ভাবেও যে একা একা থাকতে পারে, অনেক কিছু সামলাতে পারে, শিখতে পারে--- এটা কলকাতায় না এলে জানতেই পারতাম না। পাশাপাশি, অভিনয়ের ক্ষেত্রেও এখানকার বিনোদন দুনিয়া আমায় চেনা গণ্ডির বাইরে যেতে সাহায্য করেছে।
প্রশ্ন: সব হচ্ছে কিন্তু সৃজিতের পরিচালনায় অভিনয় হচ্ছে না, একটু কষ্ট, অভিমান?
মিথিলা: কোনও কষ্ট বা অভিমান নেই। এই শহরে এসে একটি বছর আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। বাড়ি থেকে যাবতীয় কাজ করছি। নতুন শহর। আশপাশে কেউ চেনা নেই। অতিমারির কারণে বাড়ি বন্দি। আমার পেশার কী হবে? তখন এ গুলো মনে হত। কিন্তু সৃজিত কেন ওর ছবিতে কাজ দিচ্ছে না, এক বারের জন্যও মনে হয়নি। কারণ, আমি জানি সৃজিত ও রকম নয়। এ ভাবে হয়ও না। স্বামী পরিচালক হলেই স্ত্রী নায়িকা হবে--- দূর থেকে মনে হয়। বাস্তব তেমন নয়।