কয়েক লক্ষ ব্যক্তিস্বাধীনতার চিতাকাঠ পুড়িয়ে আজ ৭৫ বছর হল আমরা তথা আমাদের দেশ স্বাধীন।
রোজকার মতো আজও পাথুরে ফুটপাতে উঠল জলোচ্ছ্বাস
শেষের যেখানে শেষ হয়, সেই বিন্দুতে থমকে সময়
তাই আজ আমার আর কিসের ভয়
আমার ডাঁয়ে, বাঁয়ে, উপর-নীচে আমায় বৃত্তাকার ঘিরে ধ'রে
ঘুরে চলেছে কয়েক লক্ষ অন্তঃসারশূন্য হীনমন্য, মৃত, কুঁজো
রোবটিক লাশ।
ওদের হৃদয় আর বোধগুলো সরকার মর্টগেজ রেখেছে
আরও বলেছে , প্রত্যেককে করবে নাসবন্দি
যদি না লিঙ্ক করায় ওরা ওদের আধার কার্ড
রাস্তার ওই ঘেমোটা আজ শেষ বারের জন্য মিলনে লিপ্ত
কারণ সরকার ওকেও পাঠিয়েছে নির্বীর্যকরণের নোটিস
মৃত এক গুচ্ছ গন্ডারের মাথা শহরের কোণে পড়ে থাকা শহিদ বনফুল
ভিক্টোরিয়ায় খোবলানো দেওয়াল নোংরা গড়ের মাঠ আর
ধুলোয় ধূসরিত নেতাজির জিততে চাওয়া হাত
আজ আমার এই শহরটাকে দেখে কাঁদছে
কারণ স্বাধীনতার নামে ঘটে যাওয়া খুনের অপরাধে
ব্যক্তিস্বাধীনতা আজ ফাঁসিকাঠে ঝুলছে।
১৮১৮ (আর্জেন্টিনা), ১৮৭৮ (বুলগেরিয়া), ১৯৪৮ (ইজরায়েল), ১৯৬৩ (কেনিয়া), ১৮২২ (ব্রাজিল), ১৯৭১ (বাংলাদেশ), ১৯৪৭ (ভারত)। হ্যাঁ, এই নির্দিষ্ট সালগুলি হল এই নির্দিষ্ট দেশগুলির স্বাধীনতা অর্জনের বছর।
‘স্বাধীনতা’, এই শব্দটির সঠিক অর্থ আপনারা কেউ বলতে পারেন? না। আমি কোনও দার্শনিক উত্তর চাইছি না। আমি এমনিই আপনাদের জিজ্ঞাসা করছি যে আপনাদের কাছে 'স্বাধীনতা' মানে আসলে ঠিক কী? গোষ্ঠী স্বাধীনতা, কোনও নির্দিষ্ট জাতি কিংবা ধর্মের স্বাধীনতা, নাকি স্রেফ ব্যক্তিস্বাধীনতা? আমার কাছে স্বাধীনতা মানে ব্যক্তিস্বাধীনতা। না না ভুল বুঝবেন না, পররাষ্ট্রের হাত থেকে নিজের রাষ্ট্র তথা জাতিকে উদ্ধার করার জন্য দেশের স্বাধীনতা সর্বাগ্রে প্রয়োজন, নয়তো এত দিনে আমরা মহান আমেরিকার আদি ভূমিপুত্রদের মতো বিলীন হয়ে যেতাম। আরও সব নানা উদ্ভট কাণ্ড ঘটতে পারত। যেমন ধরুন, ভারত যদি ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা না পেত তা হলে আজ হয়তো আমাদের দেশের নাম হতো ইউনাইটেড ইস্ট ইন্ডিয়া কিংবা ইউনাইটেড কিংডম (জুনিয়র) কিংবা হয়তো পার্টির শ্লোগান উঠত, ‘এলিজাবেথজি জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ’। ও, আপনারা ভাবছেন এই কথাগুলো আমি কেন বলছি। আসলে আমি বলতে চাইছি, ব্যক্তিস্বাধীনতাই হল দেশ কিংবা জাতির স্বাধীনতার প্রথম এবং মূল পদক্ষেপ। আসলে দেশ মানে তো মানুষ, ব্যক্তি। আর কোনও দেশের ব্যক্তিরা যদি তাঁদের মত প্রকাশে স্বাধীন হন, তবেই তো সেই দেশ প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হতে পারে।
যখনই বাইরে থেকে এসে কেউ আমাদের উপর তার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা জোর করে চাপিয়ে দেয়, তখনই আমরা প্রতিবাদ করতে চাই। এই প্রতিবাদের কারণ আর এবং ধরনটা যখন পবিত্র হয়, তখন আমাদের অন্তরে জন্ম নেওয়া সেই চেতনা বা বোধকে আমরা বলি 'ব্যক্তিস্বাধীনতা'। এই ‘ব্যক্তি স্বাধীনতা’ শব্দটি এত বেশি বার ব্যবহার করছি বলে আপনারা ভাবতে পারেন, আমি নিজে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে কী বুঝি? আচ্ছা, সংবিধান অনুসারে ভারতবর্ষ মানে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। সুতরাং সেই স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়ে দেশের আইন শৃঙ্খলা অমান্য না করে যা খুশি খাওয়ার, পরার, ধর্ম গ্রহণ করার, বক্তব্য রাখার, প্রতিবাদ করার, কবিতা লেখার, থিয়েটার করার অধিকার আমার থাকা উচিত। তবেই তো আমি ব্যক্তি হিসেবে আমার মত প্রকাশে স্বাধীন হব, যা আমার ন্যায্য অধিকার। কিন্তু তবু যেন কাদের অদৃশ্য নির্দেশে কিছু নির্দিষ্ট প্রাণীর মাংস খাওয়া কিছু নির্দিষ্ট রাজ্যে নিষিদ্ধ, কারওর মৃত্যুর কারণ। পুরীর মহান জগন্নাথ মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশকে কে নিষিদ্ধ করল বলতে পারেন? আজও কয়েক লক্ষ মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ভ্রূণ হত্যা হয়, বধূ হত্যা হয়। খুব সামান্য কারণে হয়তো মার খেতে হয় প্রতিবাদ করায়। সব থেকে মজার ঘটনা কী জানেন? আমরা যারা তথাকথিত ভাবে শিক্ষিত, শহুরে, তারা কেবল প্রয়োজনে মাঝেমাঝে দেখনদারির নেশায় ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে নানা গরম বুলি আওড়াই। এই এখন যেমন বলছি। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে রাস্তার যৌনকর্মী মা কিংবা মাতাল ঠেলাওয়ালা বা হয়তো একটা আস্তাকুড়ের পাগল, 'ব্যক্তিস্বাধীনতা' শব্দটি কোনও দিন না শুনেই ওই 'ব্যক্তিস্বাধীনতা'য় পুড়ে মরেন। কদাচিৎ জ্বলে ওঠেন, তাই ওঁদের নিজের অজান্তেই ওঁদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অন্যায় ভাবে জোর করে কেউ কাজ করাতে চাইলেই ওঁরা প্রতিবাদ করেন। এই প্রতিবাদের ব্যাকরণ ওঁদের কেউ শিখিয়ে দেয় না। আসলে এই প্রতিবাদের কোনও ভাষা, দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ হয় না। এই আদি-অনন্ত-অকৃত্রিম এই প্রতিবাদী সত্তাই ব্যক্তিস্বাধীনতা। আর এটাই আজকের গল্পে বার বার ফিরে আসবে। কয়েক লক্ষ ব্যক্তিস্বাধীনতার চিতাকাঠ পুড়িয়ে আজ ৭৫ বছর হল আমরা তথা আমাদের দেশ স্বাধীন। ‘স্বাধীনতা’ তাই এখন আমাদের কাছে সহজলভ্য। ঘরের আলমারিতে রাখা পুরনো রুমাল। এমনই, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া স্বাধীনতার মেডেল ঝুলিয়ে আমরা উচ্ছ্বাস করেছি। জ্ঞানত কিংবা অজ্ঞানত ভুলে গিয়েছি বহু কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতার মূল্য। তাই আবার চাকা ঘুরেছে। মৃত্যুর ঘুম ভেঙেছে। এই শহরে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ভারতে ব্যক্তি স্বাধীনতার মুখে কুলুপ আছে কি নেই, আমি বলিনি। আমি শুধু রিজওয়ানুর, নির্ভয়া, গৌরী লঙ্কেশ, রোহিত ভেমুলাদের চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবছি ‘মেরা ভারত মহান’।
না, খুব বেশি নেতিবাচক হওয়ার বা ভাবার দরকার নেই। ২০১৪ সালে কলকাতার যুব সমাজ একত্রিত হয় যাদবপুর বিশ্ববদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ‘হোক কলরব’ সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারকে শেষ পর্যন্ত তাদের দাবি মানতে হয়। এখনও ভারতে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ রক্তাক্ত পায়ে হেঁটে চলেন কৃষি বিল পরিবর্তনের আশায়। সরকারি গণনা অনুযায়ী ২৪৮ জনকে খুনের পরও থ্রি ফার্ম অ্যাক্টস-এর বিরুদ্ধে শিখ ভাইদের প্রতিবাদ আমাদের গেরুয়া সরকার ভাঙতে পারেনি। কয়েক লক্ষ মানুষ, হ্যাঁ 'মানুষ' শব্দটা ব্যবহার করলাম, কারণ এই প্রতিবাদের মিছিলে শুধু পুরুষ বা যুবকরা ছিলেন না, ছিলেন বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, মা, বোন, এমনকি অন্তঃসত্ত্বা মহিলারাও। কয়েক দিনের ওঁরা প্রমাণ করেছিলেন, সরকার জনগণকে নয়, জনগণ সরকারকে চালায়। ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সরকার শবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার পরেও সেই বছরেই ১৯ অক্টোবর রেহানা ফতিমাকে গ্রেফতার করা হয় 'ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত'-এর নামে। কারণ তিনি নাকি ‘কুরুচিকর’ ভঙ্গিতে ছবি দিয়েছিলেন। ১৮ দিন হাজতবাস হয় তাঁর। দু’জন মহিলা ঋতুমতী অবস্থায় প্রবেশ করতে গিয়েছিলেন বলে তাঁদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ২০১৮ সালের পর থেকে বহু হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া দল বিক্ষোভ করেছে, যাতে মহিলারা কখনও শবরীমালাতে প্রবেশ করতে না পারেন। কিন্তু গোঁড়া পুরোহিতরা আমাদের ‘মায়েদের’ দমিয়ে রাখতে পারে্ননি। ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি বিন্দু আমিনি কনক দুর্গা মন্দিরে প্রবেশ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ধর্ম-লিঙ্গ বৈষম্যের দেওয়াল ভেঙে মুক্ত হয়।
২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের পর থেকে ভারতে সমকামী হওয়া আর অপরাধ নয়। তাই আমরাও নিজেদের মতো করে স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। কিন্তু আবার সেই আগের কথায় ফিরে আসি। তুমি বা আমি অর্থাৎ আমরা নিজেরা যদি সত্যি মানসিক ভাবে স্বাধীন হতে পারি, তবেই কোনও বৃহত্তর স্বাধীনতার যুদ্ধে আমরা অবগাহন করতে পারব। আমার কাছে স্বাধীনতা মানে উচ্ছৃঙ্খলতা নয়, স্বাধীনতা মানে রক্তের জন্য, ঘামের জন্য, মাটির জন্য, দলিতের জন্য, আমার বিশ্বাসের জন্য লড়াই। আর সেই লড়াই আমাদের আমৃত্যু লড়েই যেতে হবে। আর যে স্বাধীনতার জন্য না লড়ে দৈনন্দিন জীবনে নানা সমঝোতা করে, আসলে সে কিন্তু প্রচুর অর্থ উপার্জন করেও পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ। স্বাধীনতা একটা বোধ। আর সেই বোধিবৃক্ষের চারায় তেমনি ফল বা ফুল ফুটবে, যখন মনের মাটিতে সামান্য জল পড়বে। আর মনের জল হল জ্ঞান। আর নেটমাধ্যম থেকে কিন্তু জ্ঞান বাড়ে না। বাড়ে তথ্য। তাই নেটমাধ্যমে ১৫ অগস্টের অনুপ্রেরণামূলক ভিডিয়ো দিয়ে লাভ নেই। বরং প্রত্যেক দিনের জীবনে অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে। মাঠে নামতে হবে। চলুন, তা হলে স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইটা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়া যাক। কারণ ফিলিপ র্যান্ডলফ তো বলে গিয়েছেন, ‘স্বাধীনতা দেওয়া যায় না। অর্জন করতে হয়।’