‘ডাঙ্কি’ ছবিতে শাহরুখ খান এবং তাপসী পন্নু। ছবি: সংগৃহীত।
এ বছর জানুয়ারিতে ‘পাঠান’ নিয়ে বড় পর্দায় ফিরেছিলেন শাহরুখ খান। পাঁচ বছর ধরে বাদশাকে দেখার জন্য চাতকপাখির মতো বসে থাকা দর্শকের উচ্ছ্বাস তখন আর দেখে কে! তবে সেপ্টেম্বরে ‘জওয়ান’ দেখে শাহরুখ-ভক্তদের উন্মাদনা আরও বাড়ে। অ্যাকশন অবতারের পাশাপাশি এ বার ছবির গল্পও বেশ টান টান। চিত্রনাট্যে অ্যাকশন ছাড়াও রোম্যান্স, নাচ-গান, সামাজিক বার্তা, একাধিক সাব প্লট, ডব্ল রোল, টুইস্ট— সব রয়েছে। ঠিক বলিউড ছবির মতো নয়, দক্ষিণী কায়দায় তৈরি ছবি। সে যা-ই হোক, দর্শক তো খুশি। বক্স অফিস আরও খুশি। তার পর বাদশা ফিরলেন ভাইজানের হাত ধরে। কয়েক মুহূর্তের জন্য সমলন খানের ‘টাইগার ৩’-এ ক্যামিয়ো ছিল তাঁর। বড় বড় সলমন-ভক্তও মেনে নেবেন, গোটা ছবিতে যত ক্ষণ শাহরুখ ছিলেন, তত ক্ষণই সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা ছিল। এত কিছুর পর বছর শেষে যখন তৃতীয় ছবি (‘টাইগার ৩’-কে বাদ রাখাই ভাল) নিয়ে বড় পর্দায় ফিরছেন শাহরুখ, তখন প্রত্যাশা গগনচুম্বী হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে সেটা যখন রাজকুমার হিরানির ছবি। যিনি নিজেও ‘সঞ্জু’-র পাঁচ বছর পর ফিরছেন।
রাজু হিরানির ছবি বলতেই দর্শকের মনে কিছু ছবি ভেসে ওঠে। চিত্রনাট্য একাধিক চরিত্র ধরে এঁকে-বেঁকে এগোবে। কমেডির ছলে সামাজিক বার্তা থাকবে। ফুরফুরে রোম্যান্স, নাচ-গান থাকবে। চড়া দাগের নয়, খুব সূক্ষ্ম দেশপ্রেম থাকবে। সব মিলিয়ে ‘মসালা বলিউড মুভি’ যাকে বলে, তাই পাওয়া যায় এই পরিচালকের জাদু-ছোঁয়ায়। খুব বেশি ছবি পরিচালনা করেননি তিনি। কিন্তু যে ক’টা করেছেন, সবই সুপারহিট। ফলে বলিউডের প্রথম সারির সব অভিনেতা-অভিনেত্রীই তাঁদের ফিল্মোগ্রাফিতে রাজু হিরানির ছবি রাখতে চান। সঞ্জয় দত্ত, রণবীর কপূর ছাড়া তিনি এত দিন শুধু এক জন খানের সঙ্গেই কাজ করেছেন— আমির খান। আমিরের ঝুলিতে ইতিমধ্যেই দু’টো রাজু হিরানির হিট ছবি। তাই দ্বিতীয় খানের সঙ্গে ছবি করার খবর ছড়াতেই নড়েচড়ে বসে বলিউড। সবুরে যে মেওয়া ফলে তা অনেকেরই জানা। এ ক্ষেত্রেও তাই হল। ছবি তৈরি হতে অনেকটা সময় লাগলেও শেষমেশ এমন সময় মুক্তি পেল, যখন বাদশাকে নিয়ে উন্মাদনা তুঙ্গে। ফলে ছবির প্রচার নিয়ে খুব বেশ শোরগাল না থাকলেও ছবির অগ্রিম বুকিংয়ে কোনও রকম অসুবিধা হল না। ‘ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো’ রীতি অনুযায়ী হাউজ়ফুল। তবে এ বছর যে অ্যাকশন সর্বস্ব শাহুরুখকে দেখে মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন দর্শক, তাঁদেরকে পুরনো বাদশা ফিরিয়ে দিলেন রাজু হিরানি। বড় পর্দায় শাহরুখ এ বার স্বমহিমায় ‘কিং অফ রোম্যান্স’।
পাঁচ বন্ধু পঞ্জাব থেকে লন্ডন পৌঁছতে চায়। ভিটে ছাড়ার কারণ পাঁচ জনের পাঁচ রকম। অবশ্যই শাহরুখ ওরফে হার্ডি তাদের লিডার। সোজা পথে ভিসা নিয়ে যেতে পারছে না তারা। তাই হার্ডি ঠিক করে, ডাঙ্কি মেরেই লন্ডন পৌঁছবে তারা। ছবির নাম ‘ডাঙ্কি’ হওয়ায় বিভ্রান্তি ছিল অনেকের। তবে বিরতি কয়েক মিনিট আগে বোঝা যায়, বেআইনি পথে নিরাপত্তারক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে যে পথে হাজার হাজার মানুষ ভারত থেকে ইংল্যান্ডে ঢোকে, তাকেই বলে ‘ডাঙ্কি রুট’। রাজকুমারের যে কোনও ছবির মতোই এই ছবির গল্পও ঘটনাবহুল। তবে গল্পের নায়ক যে শাহরুখ খান, তা মাথায় রেখেই চিত্রনাট্য সাজানো হয়েছে। তাই শাহরুখের ‘ওপেনিং’ দৃশ্যেই বোমান ইরানির কণ্ঠে ভেসে আসে, ‘হার্ডি এ বার হ্যাট্রিক করতে পারে কি না দেখা যাক’। না, দুই বাহু প্রসারিত শাহরুখের সিগনেচার পোজ় এ ছবিতে নেই। কিন্তু তাঁকে ট্রেন থেকে নামতে দেখে অবশ্যই ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’-র কথা মনে পড়বে। তাঁর চরিত্র এবং পোশাক ‘যব তক হ্যায় জান’-এর স্মৃতি উস্কে দেবে। বছরের পর বছর বিয়ে না করে নায়িকার জন্য অপেক্ষা করার প্লটলাইন দেখে দর্শকের চোখের সামনে ভেসে উঠবে ‘বীর জ়ারা’। নাচ-গানের দৃশ্যে সাবলীল শাহরুখকে দেখে তাঁর বিভিন্ন রোম্যান্টিক ছবির কথা মনে পড়তে বাধ্য। এই ছবিতে শাহরুখের নায়িকা তাপসী পন্নু। তাপসী বলিউডের শক্তিশালী অভিনেত্রীদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এখানে তাঁর আর শাহরুখের রসায়ন যেন ঠিক জমেনি। মাঝে মাঝে মনে হতে পারে, তার বদলে অনুষ্কা শর্মার মতো কোনও অভিনেত্রী থাকলে কেমন হত। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না বাদশার। কারণ, তিনি তো ‘কিং অফ রোম্যান্স’। রোম্যান্টিক শাহরুখের কাউকে প্রয়োজন পড়ে না। তিনি এখনও একাই আড়াই ঘণ্টা ধরে পর্দায় জাদু তৈরি করতে পারেন। এখানেও তাই করলেন।
ছবি জুড়ে দর্শককে ধরে রাখার বেশির ভাগ কৃতিত্ব শাহরুখের হলেও ছবির পার্শ্বচরিত্রে ভিকি কৌশল, বিক্রম কোচার এবং বোমান ইরানিকে উপেক্ষা করা যাবে না। কয়েক মিনিটের উপস্থিতিতেই নিজের জাত প্রমাণ করে দিয়েছেন ভিকি। ঠিক যেমন ‘সঞ্জু’ তে ‘কমলি’ করেছিল। বিক্রমের কমিক টাইমিং বাকিদের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে। রাজকুমার বরাবরই বোমানকে বিশেষ চরিত্র দিয়ে থাকেন তাঁর ছবিতে। ফলে তাঁর কথা আলাদা করে মনে থাকবেই। তবে চরিত্রগুলো লেখায় খানিকটা যেন অবহেলা রয়ে গিয়েছে এ বার। কণিকা ধিলোঁ এবং অভিজাত যোশীর সঙ্গে যৌথ ভাবে চিত্রনাট্য লিখেছেন রাজকুমার। বেশ কিছু মজাদার সংলাপ থাকলেও ‘থ্রি ই়ডিয়টস’-এর ‘অল ইজ় ওয়েল’ বা ‘সঞ্জু’-এর ‘ঘাপাঘাপ’-এর মতো কোনও ‘হুক ওয়ার্ড’ এ বার তৈরি হয়নি। তেমনই পরিচালকের বাকি ছবির মতো এই ছবিতে সঙ্গীত জোরের জায়গা নয়। অরিজিৎ সিংহের ‘লুটপুট গয়া’ ছাড়া ছবির বাকি গান সে ভাবে মনে দাগ কাটবে না।
গল্পের যে দিকটার সঙ্গে রাজকুমারের বাকি ছবিগুলোর সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যায়, তা হল পরিচালকের ‘ইডিয়ট’, ‘জোকার’, ‘নমুনা’-র মতো চরিত্রদের প্রতি স্নেহ এবং মমত্ব। রাজকুমার বরাবরই সাধারণ মানুষের গল্প বলতে ভালবাসেন। তাঁর নায়কেরা এখনও আলফা মেল নয়। তাঁর চরিত্ররা সমাজের উপর সারিতে ঘোরাফেরা করে না। এখনও খেটে খাওয়া মানুষদের দেখা যায় তাঁর ছবিতে। এখানেও তার অন্যথা হয়নি। দুনিয়ার সমস্ত কাঁটাতার কি শুধুই গরীবদের জন্য? সেই প্রশ্ন তোলে এই ছবি। দিনের শেষে ‘ডাঙ্কি’ আপাদমস্তক ‘রাজু হিরানি ফিল্ম’ হয়ে উঠতে পেরেছে বটে, তবে ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ বা ‘থ্রি ইডিয়ট্স’-এর জাদু ছুঁতে পারেনি।
এই বছরটা শুরু করেছিলেন শাহরুখ খান। শেষও করবেন তিনি। ঝুলিতে হিটের ঝুলি শূন্য হওয়ায় নিজেকে বদলে ফেলছেন বলে যাঁরা শাহরুখের উপর অভিমান করছিলেন, তাঁদের জন্যই যেন তড়িঘড়ি এ বছর ‘ডাঙ্কি’ নিয়ে এলেন অভিনেতা। দর্শকদের মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, পুরোদস্তুর অ্যাকশন অবতারে শাহরুখকে এ বছর প্রথম দেখলেও তাঁর ছবিতে দেশপ্রেম কিন্তু বরাবরই ছিল। ‘ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’, ‘স্বদেশ’, ‘চক দে ইন্ডিয়া’— তাঁর ফিল্মোগ্রাফিতে উদাহরণ ভূরি ভূরি। ‘পাঠান’-এ শুধু সেই দেশপ্রেমের সুর চড়েছিল। ‘জওয়ান’-এ সেটা যেন লাউডস্পিকারে বেজেছিল। কিন্তু ‘ডাঙ্কি’ দিয়ে নিজস্ব ঘরানার দেশপ্রেমে ফিরলেন বাদশা। শুধু ‘কিং অফ রোম্যান্স’ নয়, রাজকুমার হিরানির হাত ধরে ‘বলিউড’-কেও ফিরিয়ে দিলেন শাহরুখ খান।