অতিমারি পরিস্থিতি কাটিয়ে এখন কতটা উঠতে পারল টলিউড? আদৌ পারল কি? কী বলছেন ইন্ডাস্ট্রির বিশেষজ্ঞরা? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে সরস্বতীর কোনও অভাব ছিল না। কিন্তু বিগত দেড় বছর ধরে করোনা অতিমারির জেরে লক্ষ্মী সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন ইন্ডাস্ট্রি থেকে। এক সময়ে সিনেমা হল ছিল বন্ধ, ছবি মুক্তি বন্ধ, মানুষের হাতে কাজ নেই... এক ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন কেটেছে টলিউডের। এক কথায় বলতে গেলে, সম্পূর্ণ ধসে গিয়েছিল ইন্ডাস্ট্রি।
স্বাভাবিক সময়ে একটা ছবি তৈরি হলে সেটার একটা প্রক্রিয়া থাকে। সেটি মুক্তি পায়। মানুষ আসেন ছবি দেখতে। পরিচালক তার পরে তাঁর পরের ছবির পরিকল্পনা শুরু করেন। কিন্তু একটি ছবি সময় মতো মুক্তি না পেলে পরের বছর সেই ছবির মূল্য থাকে না। পরিচালকের ভাবনাটাই মার খায়। পরিচালক থেকে শুরু করে এমনকি, যে মানুষটি হলের বাইরে চা বেচেন, তাঁরও তো পেটের ভাত জোটে না ছবি হলে মুক্তি না পেলে।
সেই পরিস্থতি থেকে এখন কতটা উঠতে পারল টলিউড? আদৌ পারল কি? কী বলছেন ইন্ডাস্ট্রির বিশেষজ্ঞরা?
তাঁদের অনেকেরই মতে, অনেকটাই উঠে দাঁড়াতে পেরেছে টলিউড। সিনেমা হল খুলে যাওয়া এবং তার সঙ্গে ছবির মুক্তি — এই দুই মিলিয়ে অনেকটাই পরিস্থিতিকে সামাল দিয়েছে। এই সাফল্যর দৌড় শুরু হয়েছিল গত বছর পুজোয় মুক্তি পাওয়া ‘গোলন্দাজ’ থেকে। দারুণ চলেছিল ছবিটি। তার পর শীতে মুক্তি পাওয়া একে একে সাংসদ-সুপারস্টার দেব-এর ‘কিশমিশ’, ‘টনিক’ও খুব ভাল চলে। সুপারস্টার জিতের ‘রাবণ’ও মোটামুটি চলেছিল।
তার পর, এ বছর অন্যান্য ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে আসে অনীক দত্তর ‘অপরাজিত’, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘বেলাশুরু’ এবং পুজোয় ধ্রুব বন্দোপাধ্যায়ের ‘কর্ণসুবর্ণর গুপ্তধন’, পথিকৃৎ বসুর ‘কাছের মানুষ’, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মী ছেলে’। এর মধ্যে ‘অপরাজিত’, ‘বেলাশুরু’ এবং ‘কর্ণসুবর্ণর গুপ্তধন’— তিনটি ছবিই ব্লকবাস্টার। ‘কর্ণসুবর্ণর গুপ্তধন’-এর সাফল্যর কারণ হিসেবে প্রযোজক সংস্থা এসভিএফ-এর অধিকর্তা এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকান্ত মোহতা বললেন, ‘‘নতুন ছবির ব্যাপারে এবং বিশেষ করে যে সব ছবির একটা ঐতিহ্য আছে, সে সব ছবি নিয়ে দর্শক অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ‘কর্ণসুবর্ণ’ তেমনই একটা ছবি। আমি দ্বিধাহীন ভাবে বলতে পারি, এই ছবি বাংলা সিনেমার একটা নতুন অধ্যায় পার করল। এই ছবিই প্রমাণ করে দিয়েছে যে ছবির বিষয়বস্তুই আসল রাজা। সেখানে যদি ঠিকঠাক জিনিস তৈরি করে দর্শককে দেওয়া যায়, তা হলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবেই। শুধু এই শহরেই নয়, জাতীয় স্তরে, এমন কী আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ছবিটি দারুণ ব্যবসা করেছে। প্রায় এক মাসে আট কোটি টাকা রোজগার করেছে ছবিটি। এখনও বক্স অফিসের নিরিখে এটিই সবচেয়ে বড় বাংলা ছবি এ বছরে।’’
তুলনায় বলিউডের চিত্রটা কেমন? আমির খান অভিনীত তাঁর বহু বছরের পরিশ্রমের ফসল ‘লাল সিং চড্ডা’ সুপারফ্লপ। কিন্তু অপেক্ষাকৃত নতুন নায়ক কার্তিক আরিয়ান অভিনীত ‘ভুলভুলাইয়া ২’-এর সাফল্য তাঁকে সুপারস্টার বানিয়ে দেয়। এ ছাড়া ‘গঙ্গুবাঈ কাঠিয়াওয়াড়ি’ ও ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ ছাড়া তেমন কোনও ছবি চলেনি। যদিও টলিউডে এ রকম ভরাডুবির চিত্র তেমন একটা দেখা যায়নি। টলিউডে অতিমারির মধ্যে ক্ষেপে ক্ষেপে যে সব বাংলা ছবি মুক্তি পেয়েছে তাতে সব ছবিতেই কম-বেশি দর্শক হলে গিয়েছেন।
তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? অতিমারি চলাকালীনও দর্শক ছবি দেখতে গিয়েছেন।
শ্রীকান্ত মোহতার পাশাপাশি নবীনা সিনেমা হলের মালিক নবীন চৌখানি জানাচ্ছেন যে, অতিমারির দিন থেকে এখন অনেক স্বাভাবিকে ফিরে এসেছে পরিস্থিতি। যদিও তাঁর মতে, অতিমারি ছবি সফল হওয়া বা ব্যর্থ হওয়ার পিছনে আসল কারণ নয়। ছবির বিষয়বস্তুই ঠিক করে দেয়, ছবি চলবে কি না। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের যখন ৫০ শতাং বা ৭৫ শতাংশ সিটের অনুমোদন ছিল, তখনও হলে দর্শক এসেছিলেন। তার পর যখন সেটা ১০০ শতাংশ হল, তখন তো হাউসফুল ছিল। তার মানে এটাই স্পষ্ট হচ্ছে যে, অতিমারি কোনও কারণ নয় হলে দর্শক আসার জন্য। ছবি ভাল হলে দর্শক আসবেনই। ছবি মুক্তি পাওয়া নিয়ে কথা।’’
টেকনিশিয়ানদের মধ্যেও খুশির হাওয়া। সোমনাথ কুণ্ডু, যিনি ‘অপরাজিত’র রূপটানশিল্পী, তিনি বলছেন ‘‘এখন আমার হাতে অনেক কাজ। ছবি তৈরি হচ্ছে, হল খুলে গিয়েছে, তাই আমাদের হাতে কাজও আসছে। অতিমারির পর পরিস্থিতি অনেক ভাল হয়েছে।’’ শুধু টলিউড নয়, বলিউডেও চুটিয়ে কাজ করছেন সোমনাথ। শেষ করেছেন সুজয় ঘোষ পরিচালিত করিনা কপূর অভিনীত ছবি ‘ডিভোশন অফ ম্যালকম এক্স’-এর কাজ। এই সোমনাথই দেড় বছর আগে হা-হুতাশ করছিলেন অতিমারির জেরে কাজ নেই বলে।
এর মধ্যে অবশ্য প্রিয়া সিনেমার কর্ণধার অরিজিৎ দত্ত বলছেন, ‘‘অতিমারির আগে এবং পরের পরিস্থিতির মধ্যে বিস্তর ফারাক। তাঁর মতে শুধু টলিউড কেন, বলিউড বা হলিউডেরও কোনও ছবি তেমন চলছে না। দু’-একটা ছবি বাদে অতিমারির পর কোনও ছবিই তেমন চলেনি। মানুষের মধ্যে এখনও হলে যাওয়া নিয়ে একটা আলস্য কাজ করছে। আরও একটা বিষয়, দর্শক এখন স্বাভাবিক বা ছিমছাম ছবি দেখতে আগ্রহী নন। তাঁরা বড় পর্দায় ছবি দেখতে আসছেন মানে বড় কিছু দেখতে চান। এক কথায়, সাধারণ বিনোদন নয়, আরও বেশি কিছু দেখতে চান তাঁরা।’’
যদিও ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত বেশির ভাগ পেশাদাররাই বলছেন, যে টলিউড উঠে দাঁড়িয়েছে। ছবির ডিস্ট্রিবিউটর বাবলু দামানি জানাচ্ছেন যে, ‘পাবলিক’ এখন অনেক সচেতন এবং স্মার্ট। তিনি বললেন, ‘‘তাঁরা আমাদের চেয়ে বেশি জানেন এবং খবর রাখেন। কারণ তাঁরা এখন বাড়িতে বসে ওয়েব সিরিজ দেখেন। তাই বড় পর্দায় কোন ছবি ভাল আর কোন ছবি খারাপ, তাঁর খবর তাঁরা খুব ভালই রাখেন। সে হিসাবে বলতে পারি যে, অতিমারির পর বাংলা সিনেমা ভালই ব্যবসা করেছে। ‘বেলাশুরু’র সময় আমরা দেখেছি যে, যাঁরা হলে আসতেন না— সেই সত্তরোর্ধ্ব মানুষ হলে এসে ছবি দেখেছেন।’’
আইনক্স মাল্টিপ্লেক্স চেনের আঞ্চলিক অধিকর্তা অমিতাভ গুহ ঠাকুরতা জানাচ্ছেন, ২০২০ সালের মার্চে যখন প্রথম বার লকডাউন হয়, তখন সিনেমা হল বন্ধ করে দেওয়া হয়। যখন ২০২০ সালের অক্টোবরে সিনেমা হল খোলে, তখনও মানুষ আসেননি যে, তা নয়। তিনি বলেন, ‘‘কলকাতায় আমি দেখেছি কোভিড নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা খুবই কম ছিল। তাই যে মুহূর্তে হল খুলেছে সেই মুহূর্তেই মানুষ এসেছেন ছবি দেখতে। এখন তো সবটাই স্বাভাবিক। কোনও দিন কোভিডের ভয়ে দর্শক আসেননি এমনটা হয়নি।’’
শেষ কথা বলছেন পরিচালক-প্রযোজক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে বলিউডের ছবি সারা দেশেই তেমন একটা চলছে না। সেই জায়গায় চলছে আঞ্চলিক ছবি। সেই আঞ্চলিক ছবিরও নানা স্তরে দর্শক তৈরি হয়েছে। শিবপ্রসাদের কথায়, ‘‘১৫ ই আগস্ট তিনটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। ‘রক্ষা বন্ধন’, ‘লাল সিংহ চড্ডা’ এবং ‘ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ’। মানুষ কিন্তু হিন্দি ছবি ছেড়ে ব্যোমকেশ দেখেছেন।’’ তাঁর মতে, ‘‘বিগত কয়েক বছরের দিকে তাকালে এই বছরটা বাংলা ছবির ক্ষেত্রে সেরা বছর। কোনও ইন্ডাস্ট্রিতে বছরে যদি চারটে ব্লকবাস্টার হয় তা হলেই যথেষ্ট। সেই প্রেক্ষিতে এ বছরে ইতিমধ্যেই বাংলায় তিনটে ব্লকবাস্টার হয়ে গিয়েছে— ‘অপরাজিত’, ‘বেলাশুরু’ এবং ‘কর্ণসুবর্ণর গুপ্তধন’। উল্টো দিকে হিন্দিতেও তিনটি ব্লকবাস্টার— ‘ভুলভুলাইয়া টু’, ‘গঙ্গুবাঈ কাঠিয়াওয়াড়ি’ এবং ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। তা হলে তো আমরা সমান-সমান হলাম, তাই না? আর কী চাই? এই মুহূর্তে আমি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলছি, তখনও ‘লক্ষ্মী ছেলে’ নন্দনে ৫০ দিন পার করেও হাউসফুল চলছে,’’ বলছেন শিবপ্রসাদ।
সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে যে অতিমারি পেরিয়ে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে আলোর রেখা দেখা দিয়েছে। সিনেমা হল খুলেছে। নতুন নতুন ছবির ঘোষণাও হচ্ছে নিয়মিত। পরিচালক-প্রযোজকরা পুরো দমে কাজে বসেছেন। মানুষের মুখে মাস্ক এখন প্রায় নেই বললেই চলে। তাঁরাও আনন্দিত মনে ফিরছেন তাঁদের প্রিয় সিনেমা হলে। আর সেই সিনেমা হলের বাইরের চা বিক্রেতাটি? তিনি নিশ্চয়ই তাঁর সন্তানের জন্য নতুন খেলনা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।