দেবলীনা দত্ত। —নিজস্ব চিত্র।
অভিনেত্রী দেবলীনা দত্তের কাছে অনুরাগীদের জিজ্ঞাসা অনেক। অভিনয় ছাড়াও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও প্রশ্ন জমে রয়েছে তাঁদের মনে। আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে মন খুলে কথা বললেন তিনি। সবুজ পাড়ের কালো শাড়ি, উঁচু করে বাঁধা খোঁপা, ঘন কাজলে দেবলীনা এক থালা আলুভাজা নিয়ে গল্প করতে বসলেন...
প্রশ্ন: আপনাকে বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে…
দেবলীনা: আমার জীবন সত্যি বদলে গিয়েছে। হতাশা, দুঃখ, অন্য কারও কাছে কোনও কিছু প্রত্যাশা করা— এ সব কিছুই জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছি।
প্রশ্ন: তথাগতকেও দূরে রাখছেন?
দেবলীনা: বিষয়টা এক কথায় বলার নয়। কিছু দিন আগে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা পড়ছিলাম। সেখানে তিনি ‘ভালবাসা’ কথার মানে কিন্তু ‘অন্যের ভালয় বাস করা’, এমনটা বুঝিয়েছেন। মানে, আমি বলতে চাইছি তথাগতর ছবি ‘পারিয়া’ এই যে সাফল্যের মুখ দেখল, আমি খুব খুশি। আমি তো আগেই আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছিলাম, তথাগতকে পরিচালক হিসেবে শীর্ষে দেখতে চাই, এতেই আমার আনন্দ।
প্রশ্ন: আড়াই বছর আপনারা আলাদা থাকছেন। সম্পর্ক ভাঙার আঘাত পেয়েছেন। তার পরেও তথাগতকে নিয়ে…
দেবলীনা: (প্রশ্ন শেষ না করতে দিয়ে) আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। তথাগতকে ভালবাসতে গেলে আমার ওর সঙ্গে থাকার কোনও প্রয়োজন নেই। আমি প্রেমে পড়ে কোনও মানুষকে যদি বলি, ‘তোমায় ছাড়া বাঁচতে পারব না’, তা হলেই সমস্যা। সেই সম্পর্কে আমিই ডুবে মরব। সব সময় আমার মনে হবে, আমার একজনকে প্রয়োজন। তার অস্তিত্বের নিরিখেই আমি বাঁচব। এটা হতে পারে না। ‘যাপন’ শব্দটার মানেই বদলে গিয়েছে আমার কাছে। আমার সঙ্গে আমির ‘যাপন’ই হল আসল কথা। অন্য কেউ কেন সেখানে থাকবে?
প্রশ্ন: কিন্তু তথাগতর জীবনে কি বিবৃতি আছেন?
দেবলীনা: কে? কার নাম বলছেন? বিবৃতি…? চিনি না!
প্রশ্ন: সে কী! আপনি তো এক সময় নিজের হাতে ওকে তৈরি করেছিলেন!
দেবলীনা: সে তো ‘ভটভটি’ ছবির জন্য। দেখুন, আমি শুধু ডিটক্স ওয়াটার খাই না। মনও পরিষ্কার করি। সেটা করতে গিয়ে আমি অনেক নাম ভুলে গিয়েছি। বাদ দিয়ে দিয়েছি। ...আমার প্রয়োজন নেই।
প্রশ্ন: তা হলে আপনি কী বলতে চান? তথাগতর সঙ্গে বিবৃতির সম্পর্কও…
দেবলীনা: (থামিয়ে) মানুষ মুহূর্তে বদলে যেতে পারে। তবে আমি যত দূর তথাগতকে চিনি, তাতে আমি নিশ্চিত যে, তথাগতর সঙ্গে বিবৃতির প্রেমের সম্পর্ক নেই। আনন্দবাজার অনলাইনের সাক্ষাৎকারে তো তথাগত বলেছিল যে, বিবৃতির সঙ্গে ওর সম্পর্ক নেই। ও মিথ্যে বলেনি। আর তথাগত প্রেমে পড়লে অযথা লুকোবেও না। আবার ঢাকও পেটাবে না।
প্রশ্ন: আর আপনি? তথাগতর সঙ্গে থাকবেন আবার?
দেবলীনা: বললাম যে, আমি ওর সঙ্গেই আছি। আমি আগে বলতাম, আমাদের সাত বছরের দাম্পত্য আমার কাছে শ্রেষ্ঠ সময়। এখন তা বদলেছে। ওই উদ্যাপনের স্মৃতি নিয়ে আজ যে ভাবে দিন কাটাই, সেটাই শ্রেষ্ঠ সময়। যেমন ওর সঙ্গে থাকার সময় আমার যে ভাবে জন্মদিন পালন করা হত, এখনও সেই ভাবেই উদ্যাপন করি। এক বার দুবাই গেলাম। আর এক বার পোষ্যদের নিয়ে সময় কাটালাম। ও নেই, কিন্তু ও যে ভাবে আমায় জন্মদিন পালন করতে শিখিয়েছিল, সেটাই করি।
প্রশ্ন: আপনার মা এই ভাঙনকে কী ভাবে দেখেছিলেন?
দেবলীনা: মা দেখেছিল, মেয়ের সংসার ভাঙছে। আমরা আলাদা হচ্ছি। মায়ের বুকের মধ্যে তোলপাড়। অথচ কোনও দিন আমাকে বুঝতে দেয়নি। আমায় বুঝিয়েছিল, তথাগতর সঙ্গে থাকা আর না-থাকার মধ্যে বিশেষ কোনও ফারাক নেই। মায়ের এই মনের জোর আমাকে নিজের জায়গা খুঁজে নিতে সাহায্য করেছে। আসলে, আমি ও আমার মা, দু’জনেই সেই দিনটা ভুলব না, যে দিন আমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে রেখে হবু বর আমায় বিয়ে করতে এল না! সেই দিন তথাগত মা আর আমাকে যে ভাবে সামলেছিল…
প্রশ্ন: ভাল কথা বলেন, দীর্ঘ দিনের অভিনয় যাত্রা, ইন্ডাস্ট্রি কাজ পেতে কতটা সাহায্য করল?
দেবলীনা: আমি যা পেয়েছি, তাতে খুব খুশি।
প্রশ্ন: কিন্তু মনে হয় না, আরও পাওয়ার ছিল, বড় প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে কাজ, বড় চরিত্র…
দেবলীনা: একটা বিষয় বলতে পারি। অনেক সময় কাজের কথা হয়েছে। চিত্রনাট্য পেয়ে গিয়েছি। পোশাকের মাপ নেওয়া হয়ে গিয়েছে। কলটাইমের অপেক্ষা করতে করতে শুনেছি, অমুকে শুট করছে। আসলে আমি ঠিক ‘কাউচ মেম্বার’ হয়ে কোনও কাজ করতে চাইনি। তাই বোধ হয়…
প্রশ্ন: প্রযোজকের সঙ্গে ডেটে যাওয়া…
দেবলীনা: জানেন, কোনও প্রযোজক, নায়িকার বন্ধুও হতে পারেন। ফলে তাঁরা কফি খেতে বা ডেটে যেতেই পারেন। এ নিয়ে কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। আবার কাস্টিং কাউচের বিষয়টাও ইন্ডাস্ট্রিতে আছে। সবই চলতে থাকে। একটা ঘটনা বলি?
প্রশ্ন: নিশ্চয়ই…
দেবলীনা: এই তো কিছু দিন আগে এক সফল পরিচালক আমায় বলছিলেন, তাঁর ছবিতে এমন এক জন অভিনেত্রী কাজ করেছেন, যিনি সংলাপ বিকৃত করে উচ্চারণ করে চলেছিলেন। আমি তো অবাক বললাম, “কেন নিলি?” সে চুপ। যে অভিনেত্রী বিকৃত উচ্চারণ করবে না, তাকে নেওয়া হয় না কেন? সমস্যা এখানেই।
প্রশ্ন: টলিপাড়ায় অভিনেত্রী তৈরি হচ্ছে না। মানেন?
দেবলীনা: কী করে হবে! এখন নতুন মুখের নায়িকা চাই। ফলে অভিনেতারা এসেই নায়ক বা নায়িকা হয়ে যান। আমাদের সময় অনেক বেশি লড়াই করতে হত। আমি যেমন খুব ছোট্ট ছোট্ট চরিত্রে কাজ করেছি। ইন্দ্রাণী হালদার, গার্গী রায়চৌধুরী, জুন মালিয়ার অভিনয় দেখতাম। এখন এ সব হয় না। পুরনোদের অভিনয় দেখার বিষয়টাই নেই। নতুন যারা, তারা এসেই নায়িকা। লড়াই নেই।
প্রশ্ন: নতুন বছরে আপনি পরিচালনায় আসছেন, এটা সত্যি?
দেবলীনা: হ্যাঁ। আমি পরিচালনার কাজ করব। এ বছর আমার নতুন ছবিও আসছে। রাহুলের সঙ্গে ‘নেগেটিভ’ বলে একটা ছবি করলাম। দম্পতিদের এই ছবি দেখতে ভাল লাগবে। আসছে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বায়োপিক ‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’। এই ছবিতে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রে দেখা যাবে আমায়।
উঠে পড়লেন দেবলীনা। সন্ধে ৭টা। আলুভাজা আর চিজ কেক খেয়ে ডিনার সারলেন। সন্ধের পর আর কোনও খাবার মুখে তোলেন না তিনি।