রুদ্রনীল ঘোষ। ছবি: সংগৃহীত।
আমি তো হাওড়ার ছেলে। পুজো মানে এখনও শৈশবের স্মৃতি ভিড় করে। মনে পড়ে যায়, সমবয়সিদের মধ্যে প্রতিযোগিতার কথা। কার ক’টা ক্যাপ ফাটানোর বন্দুক হয়েছে, কার ক’টা নতুন জামা হয়েছে— এ রকম প্রশ্নগুলোই পুজোর শুরুর দিকে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেত। তার সঙ্গে থাকত ঠাকুর দেখা এবং পড়াশোনা থেকে দিন কয়েকের ছুটির আনন্দ। আর থাকত পায়ে নতুন জুতোর ফোস্কা!
বয়স বাড়ছে। এখন পুজো মানে আমার কাছে দুটো উদ্দেশ্য। প্রথমত, ধর্মাচরণ। সনাতন হিন্দু ধর্মের মধ্যে অনেক ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে রয়েছে। মা আসছেন। এই চারটে দিন আমার কাছে তাঁর আরাধনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখার সময়।
দ্বিতীয়ত, মানুষ এখন খুবই ব্যস্ত। আমরা যেন বড় বেশি ভার্চুয়ালে নির্ভরশীল! সারা বছর তো কারও সঙ্গে সেই ভাবে দেখা করার সুযোগ হয় না। আমার কাছে পুজো মানে সেই মানুষগুলোর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ। তাঁদের কাঁধে হাত রেখে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ। বড়দের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সুযোগ।
যখন ছোট ছিলাম, চুটিয়ে ঠাকুর দেখতাম। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এবং পেশার কারণেই প্রচুর ইচ্ছাকে ত্যাগ করতে হয়। সেই ভাবে আমার ঠাকুর দেখার সুযোগও কমে গিয়েছে। এখন সমাজমাধ্যমের দৌলতে পাড়ার সাদামাটা মানুষটিও পরিচিত। এই পরিচিতি শব্দটা এখন আর ‘তারকা’ বৃত্তে সীমাবদ্ধ নেই। আমরা যত বেশি পরিচিত হই, তত বেশি নিজের মতো থাকার পরিসর কমতে থাকে। পাশে শিকল পড়ে। হয়তো ভিড়ের মধ্যে তন্ময় হয়ে প্রতিমা দর্শন করছি। কাঁধে টোকা পড়ে এবং শোনা যায়, ‘আমি কি আপনার সঙ্গে একটা সেলফি তুলতে পারি’। আমি রাজি না হলে তিনি হয়তো সমাজমাধ্যমে আমার নামে দু-চারটে বাজে কথা লিখেও দেবেন— রুদ্রনীল ঘোষ খুবই উন্নাসিক! শুরু হবে ট্রোলিং! যিনি ছবি তুলতে চাইছেন, দোষ তাঁর নয়। আসলে, নিজের পেশার তাগিদে বুঝতে পেরেছি, কী করা উচিত আর কোনটা নয়। তবে এটাও সত্য, মানুষের ভালবাসার জন্যই ভিড়ের মধ্যে প্যান্ডেলে প্রবেশ করলে তাঁরাই কিন্তু আবার আলাদা করে জায়গা করে দেন।
তার পরেও সুযোগ পেলে ঠাকুর দেখি। হাওড়ায় আমার পাড়ার বারোয়ারি পুজোতেও একটা দিন যাওয়ার চেষ্টা করি। এক সময় এই পুজোর জন্য বাড়িতে বাড়িতে চাঁদাও তুলেছি। কলকাতার পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা এবং খাওয়াদাওয়া তো থাকবেই। পাশাপাশি সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকেও একাধিক পুজো মণ্ডপে উপস্থিত থাকতে হবে। সেই দায়িত্বগুলোও যথাযথ পালন করার চেষ্টা করব। তবে সব কিছুর মধ্যেই একটা বিষণ্ণতা কাজ করবে। কারণ, এই বছরের পুজোটা অন্য বছরের তুলনায় একেবারে আলাদা। আমরা প্রত্যেকেই আরজি কর-কাণ্ডে ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় রয়েছি।
দুঃখের বিষয়, আমার প্রচুর বন্ধু রয়েছেন, যাঁরা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটির অর্থ বদলে দিয়ে হিন্দু ধর্মের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শনকেই ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার পথ বলে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাঁদের কাছে সনাতন ধর্মের রীতিনীতি কিছুটা ‘ব্যাক ডেটেড’! আমি তা সমর্থন করি না। সনাতন ধর্মের ঔদার্য মানে তাকে অবহেলা করা নয়।
আরজি কর-কাণ্ডের পর উৎসবে অংশ নেওয়া বা যোগদান না করা নিয়ে প্রচুর চর্চা হয়েছে। এমনকি এখনও চারপাশে চর্চা চলছে। আমার মতে, কেউ প্রতিবাদে থাকবেন কি না, তা আলাদা করে জানানোর প্রয়োজন নেই। কারণ সপরিবারে মর্তে আসার মাধ্যমে দেবী দুর্গা যেমন উৎসবের ইঙ্গিত দেন, তেমনই মা কিন্তু প্রতিবাদেরও ইঙ্গিত দেন। তাঁর দশটি হাতে থাকে অস্ত্র। অসুরকে বধ করছেন— সেই প্রতিবাদী রূপ নিয়েই মা আমাদের মাঝে আসেন। তাই দুর্গাপুজো মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমবেত প্রতিবাদ। তাই তো তিনি ‘শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’। তাই উৎসব না কি প্রতিবাদ— মনের মধ্যে কোনও দ্বন্দ্বে ভুগলে বা কখনও বিতর্কে জড়ালে, অনুরোধ করব একবার মায়ের মূর্তির দিকে তাকিয়ে দেখুন। প্রতিবাদের পুঞ্জীভূত ফলাফল কী হতে পারে, সেটাই তো মা দুর্গার মূর্তিতে স্পষ্ট হয়ে রয়েছে। পুজো আসছে। সকলের পুজো ভাল কাটুক।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)