(বাঁ দিকে) মনোজ কুমার। বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।
সকালবেলায় খবরটা জেনেই মনখারাপ হয়ে গিয়েছে। আমি আর মনোজ তো দীর্ঘ দিনের বন্ধু। আমরা প্রায় একই সময়ে ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছিলাম। দু’জনেই জুহুর বাসিন্দা। আমার বাড়ির খুব কাছেই ওর বাড়ি।
মনোজের সঙ্গে আমি কোনও ছবিতে অভিনয় করিনি। কিন্তু একে অপরের কাজ নিয়ে খোঁজখবর রাখতাম। মতামত আদানপ্রদান করতাম। আমি ওকে ‘এমকে’ বলে সম্বোধন করতাম। আর ও আমাকে ‘বিশু’ বলে ডাকত। আমি ওকে বলেছিলাম যে, ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে মনোজ কুমারের নাম প্রথম দিকে থাকবে। কারণ দেশাত্মবোধক ছবিতে ওর যা অবদান রয়েছে, তা কেউ কোনও দিন ছাপিয়ে যেতে পারবে না। আর ও আমাকে বাণিজ্যিক এবং থ্রিলার ছবির এক নম্বর নায়ক বলত।
পুরনো ছবি নিয়ে আমাদের প্রচুর আড্ডা হত। ও হয়তো কখনও বলল, আমার ‘বিশ সাল বাদ’ ছবির ‘কঁহি দীপ জ্বলে কঁহি দিল’ গানটা ওর বেশি পছন্দ। তখন আমি হয়তো বলতাম যে ওর ‘ওহ কওন থি’র ‘নয়না বরসে রিমঝিম’ গানটা বেশি ভাল। আমরা দু’জনেই থ্রিলারের ভক্ত ছিলাম। আমি হয়তো মনোজের ‘গুমনাম’ ছবিটির প্রশংসা করলাম। ও হয়তো আমার ‘ইয়ে রাত ফির না আয়েগি’ বা ‘কোহরা’ ছবিটার প্রশংসা করল। আসলে আমরা একে অপরকে খুব অনুপ্রেরণা জোগাতাম।
দিলীপ কুমারের অভিনয় দেখেই মনোজ বলিউডে চলে আসে। দেশাত্মবোধক ছবির ক্ষেত্রে দিলীপসাহাব ছিলেন ওর অন্যতম অনুপ্রেরণা। সেই ভাবনা থেকেই দিলীপসাহাবের ছবির নামেই ও একটা ছবিতে অভিনয় করেছিল। ছবিটা হল ‘শহিদ’। সেখানে ভগত সিংহের চরিত্রে কী অসাধারণ অভিনয় করেছিল মনোজ! আবার, পরবর্তী সময়ে ‘শিরডি কে সাঁইবাবা’ ছবিটা করল। অভিনয়ের পাশাপাশি চিত্রনাট্যও ও নিজেই গবেষণা করে লিখেছিল। ছবিটা দর্শকমনে এতটাই নাড়া দেয় যে পরবর্তী সময়ে শিরডিতে সকলেই মনোজকে খুবই সম্মান করতেন। সবাই ওকে পছন্দ করতেন। পরবর্তী সময়ে মন্দির ট্রাস্টের তরফে ওকে সম্মানিত করা হয়েছে। বহু বার হয়েছে, আমি পরিবার নিয়ে শিরডি দর্শনে যাব ঠিক করেছি। মনোজের ফোন এল— ‘‘আমি সব বলে দিয়েছি। চিন্তা করিস না।’’
একটা জিনিস হয়তো অনেকেই জানেন না। মনোজ চিরকাল বিমানযাত্রায় ভয় পেত! তাই সব জায়গায় ট্রেনে যেতে পছন্দ করত। শুধু ওর প্রযোজিত ও পরিচালিত ‘পুরব অউর পশ্চিম’ ছবিটার শুটিং করতে লন্ডনে যেতে হবে। নিজের ছবি। আর তো কোনও উপায় নেই। সেই এক বারই কোনও রকমে চোখ বন্ধ করে বিমানে উঠেছিল মনোজ। জীবনে সেই এক বার।
মনে পড়ছে, একবার দিল্লিতে সংসদের সদস্যদের সঙ্গে বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ক্রিকেট ম্যাচ হবে। তাবড় তাবড় সব তারকা সেখানে খেলবেন। সংসদের তরফে যত দূর মনে পড়ছে, মাধব রাও সিন্ধিয়া এবং বলরাম জাখড় খেলেছিলেন। এ দিকে আমাদের দলে ছিলেন শশী কপূর, সঞ্জয় খান, ফিরোজ় খান প্রমুখ। মনোজকে আমাদের দলের ক্যাপ্টেন করা হল। হেসে বলেছিল, ‘‘বিশু, আমি তো ভাল ক্রিকেটই খেলতে পারি না। আমাকেই তোরা ক্যাপ্টেন করলি!’’ আমি তখন ওকে আশ্বস্ত করেছিলাম যে চিন্তার কোনও কারণ নেই। ভালই হবে ম্যাচ।
মনে পড়ছে, দিল্লিতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জ়ৈল সিংহের হাত থেকে আমরা দুই বন্ধুই পুরস্কার নিয়েছি। সেই ছবি আজও আমার অ্যালবামে রয়েছে। তখন দিল্লির হোটেলে আমাদের কত গল্প হয়েছে।
আমাদের হোয়াটস্অ্যাপে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ও হয়তো কোনও ছবি পাঠাল। তার পর আমি কিছু ছবি পাঠাতাম। পুরনো দিনের সিনেমা নিয়ে আমাদের প্রচুর গল্প হত। বছর দুয়েক আগে হঠাৎ খবর পেলাম, মনোজ অসুস্থ। সোজা ওর বাড়ি ‘গোস্বামী টাওয়ার’-এ পৌঁছে গিয়েছিলাম। বাড়ির নীচে ওর ছেলে কুণাল দাঁড়িয়েছিল। মনোজের নির্দেশে আমাকে সোজা ওর ঘরে নিয়ে গেল। দেখলাম, চেয়ারে বসে ধারাবাহিক দেখছে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, কেন আর ও অভিনয় করছে না। তখন বলল, ‘‘শরীর আর চলছে না। আর তুমি তো জানোই, ছবি করতে গেলে কতটা পরিশ্রম করতে হয়।’’ তার পর জুহুতে আমার দুর্গাপুজোতেও ওকে আমন্ত্রণ করি। আসার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু বলল, ‘‘বিশু, একদম হুইলচেয়ারে বন্দি আমার জীবন। ইচ্ছে করলেও যেতে পারব না।’’ কিন্তু মনোজ এলে ওকে আমাদের সংগঠনের তরফ থেকে বিশেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করার ইচ্ছা ছিল।
প্রায় আড়াই মাস আগে ওর সঙ্গে ফোনে আমার শেষ যোগাযোগ হয়েছিল। তার পর ওর মৃত্যুসংবাদ পেলাম! খারাপ লাগছে, আমি জ্বরে ভুগছি। চিকিৎসকের কাছে অনুমতি চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। তাই ইচ্ছে থাকলেও বন্ধু মনোজের শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকতে পারব না।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।)