কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শিল্পের স্বাধীনতা নিয়ে মুখ খুললেন অমিতাভ ছবি: পিটিআই।
শিল্পমাধ্যমের উপর নীতিপুলিশি কতটা কাঙ্ক্ষিত? বিষয়টি কি আদৌ অভিপ্রেত? প্রশ্নগুলি উঠছে শাহরুখ খানের ‘পাঠান’ ছবির মুক্তি ঘিরে বিতর্ক দেখা দেওয়ায়। আর সেই আবহেই কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে এসে ‘নাগরিক স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার’ নিয়ে মন্তব্য করেছেন অমিতাভ বচ্চন। যা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে টলিপাড়ায়।
বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোরে ২৮তম কলকাতা চলচিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সব থেকে বেশি সাড়া ফেলেছে অমিতাভের বক্তৃতা। নিজের ভাষণে চলচ্চিত্রের ইতিহাস নিয়ে কথা বলার পরেই এসেছিলেন মত প্রকাশের অধিকার প্রসঙ্গে। বিগ বি বলেছিলেন, ‘‘আশা করি সবাই একমত হবেন, নাগরিক স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে আজও এ দেশে প্রশ্ন ওঠে।’’ স্বাধীন দেশের সিনেমা প্রসঙ্গেও তিনি বলেন, ‘‘আজ বিদ্বেষপূর্ণ উগ্র দেশপ্রেম ভরপুর কল্পনা মেশা ইতিহাস নিয়ে সিনেমা হচ্ছে।’’
‘পাঠান’-বিতর্কের আবহে এ হেন মন্তব্যে অমিতাভ কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা যদিও স্পষ্ট। কারণ, ‘পাঠান’ তো একমাত্র নয়। এ বছরের শুরুটাই তো হয়েছিল ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ দিয়ে। সম্প্রতি ‘আদিপুরুষ’-এর মতো ছবিতেও রাবণের ভূমিকায় সইফ আলি খানের লুক নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছে। ছবি বয়কটের ডাক উঠছে মুহুর্মুহু। তা ছাড়া বলিউডের তিন খান— শাহরুখ, সলমন, আমিরও ইদানীং কুনজরে অনেকের। তাঁদের ছবিকে ‘ফ্লপ’ বানানোর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে প্রেক্ষাগৃহে না যাওয়ার জন্য জনমত তৈরির চেষ্টা করতেও দেখা গিয়েছে নানা সময়ে।
এ রকম একটা সময়ে অমিতাভ কেন কলকাতায় এসে হঠাৎ এমন মন্তব্য করলেন? শুক্রবার নন্দন চত্বরে এসেছিলেন অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। এ বিষয়ে তাঁর সংক্ষিপ্ত জবাব, “আমার মনে হয় উনি সব সময়েই ইতিবাচক কথা বলেন। খুবই সঠিক বার্তা দিয়েছেন। আমার নিজেরও মনে হয় বিনোদন জগৎটা খুবই স্বতন্ত্র। এর সঙ্গে অন্য কোনও কিছুর সম্পর্ক থাকতে পারে না।”
পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ও বিগ বি-র মন্তব্যে ইতিবাচক দিকই খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর কথায়, “আমার তো মনে হয় কলকাতা কেন, উনি যে কোনও জায়গায় এই বার্তা দিতে পারতেন। ”
চলচ্চিত্র উৎসবের চেয়ারম্যান রাজ চক্রবর্তী অবশ্য কোনও রকম রাজনৈতিক মন্তব্য থেকে দূরে থাকতে চান। তিনিও বললেন, “উনি সকলের প্রাণের কথা বলেছেন। মানুষ তো সমানাধিকার ও ঐক্যের কথাই বলে। এটা পশ্চিমবঙ্গের জয়, মানুষের জয়।” বৃহস্পতিবার উদ্বোধনী মঞ্চে অরিজিৎ সিংহ গান শুনিয়েছিলেন। তাঁর কণ্ঠে জনপ্রিয় গান ‘রং দে তু মোহে গেরুয়া…’ প্রসঙ্গ টেনে রাজ বলেন, “আজকে বিজেপি এটা নিয়ে ট্রোল করা শুরু করেছে। আসলে এটাই তো ওরা চায়! সিনেমা তো রঙের ঊর্ধ্বে। আজকে আমি ছবি আঁকলে কি গেরুয়া রং ব্যবহার করব না? নাকি ওরা ছবি আঁকলে সবুজ রং ব্যবহার করবে না?”
পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের মতেও অমিতাভের এই মন্তব্য খুবই প্রশংসনীয়। তাঁর দাবি, “শুধু কলকাতা বলে নয়, খেয়াল রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এসে তিনি এ কথা বলছেন। বর্তমানে ভয়ের বাতাবরণের মধ্যে দাঁড়িয়ে যে কথা বলা খুব বেশি জরুরি। তাঁর মতো মানুষের কাছে এই প্রতিক্রিয়াই আশা করা যায়।’’ একই সঙ্গে তিনি জানান, পরিচালকেরা আজকাল ভয়ে ভয়ে ছবি করছেন। সব সময় আশঙ্কা কাজ করছে, এই বুঝি সেন্সর বোর্ড আটকে দেবে। কিংবা মামলা হয়ে যাবে। এক দল লোক ছবি বয়কট করার হুজুগ নিয়েই মেতে আছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এতে ক্ষতি হচ্ছে খুব। এই প্রবণতা অচিরেই বন্ধ করা দরকার। সকলের সাবধান হওয়া প্রয়োজন। কলকাতায় এমন ঘটনা এখনও ঘটেনি, তবে এই হুজুগ পৌঁছে যেতে কত ক্ষণ! তার আগেই যেন এটাকে আটকানো যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে।” প্রদীপ্ত আরও জানান, প্রোপাগান্ডামূলক ছবিগুলিকেই শুধু প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে, বিনোদনের ভাগে পড়ছে খাঁড়া।
অন্য দিকে, অভিনেতা সোহম চক্রবর্তীর কথায়, “অমিতাভ তো প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। প্রতি বার যখন উনি আসেন, বক্তৃতার মধ্যে দিয়ে যা কিছু তুলে ধরেন তা শিক্ষণীয়। অনেক অজানা তথ্য জানতে পারি। এ বারও যা বললেন সেটুকু আমাদের পাথেয় করে চলা উচিত।”
‘পাঠান’-এর প্রথম গানের ভিডিয়ো মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই দেশ জুড়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বেঁকে বসেছেন মধ্যপ্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। সে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নরোত্তম মিশ্রের দাবি, ‘খারাপ উদ্দেশ্য’ নিয়ে এই গানের ভিডিয়ো শুট করা হয়েছে। তিনি সাফ জানান, দৃশ্যগুলি ‘কুরুচিকর, অশ্লীল’। সেগুলি সংশোধন না করলে মধ্যপ্রদেশে এ ছবির প্রদর্শন হবে না। সেই পরিস্থিতিতে অমিতাভ যেমন কলকাতার বুকে স্বস্তির আভাস ছড়িয়ে গেলেন, তেমনই জবাব দিয়ে গিয়েছেন ‘পাঠান’-এর নায়ক নিজেও। ‘বাদশা’রও চোখেমুখে ছিল দীপ্তি, যেন কলকাতা ঠিক বুঝবে। শাহরুখ বললেন, ‘‘ম্যায়, আপ, অওর সব পজ়িটিভ লোগ অভি জিন্দা হ্যায়।’’