অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি-সংগৃহীত।
এসভিএফ প্রযোজিত নতুন ধারাবাহিক ‘বসু পরিবার’-এ অভিনয় করছেন অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়। ‘কন্যাদান’ ধারাবাহিকে তিনিই ছিলেন মূল চরিত্রে। এ বারও তাই। ‘দাসানি ২’ স্টুডিয়োতে শুরু হয়ে গিয়েছে ধারাবাহিকের শুটিং। তার মাঝেই কথা বললেন আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে।
প্রশ্ন: ছোট পর্দায় আরও একটি নতুন কাজ!
অরিন্দম: এই ধরনের চরিত্রে অনেক দিন পর। এর মধ্যেই ‘বসু পরিবার’-এর ঝলক এত সাড়া ফেলবে ভাবিনি। আসলে আগেও ‘কন্যাদান’-এ এমনই একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। তবে এ বার এই বিপুল পরিমাণে সাড়া প্রমাণ করে দিল, দর্শক এখনও পর্দায় বাঙালিয়ানা দেখতে পছন্দ করে।
প্রশ্ন: আচ্ছা, ‘কন্যাদান’, ‘বসু পরিবার’ দুই ধারাবাহিকেই আপনার চরিত্রের নাম অঞ্জন বসু?
অরন্দিম: (মৃদু হেসে) হ্যাঁ। চরিত্র দু’টিরও মিল আছে। দু’টিই বাবার চরিত্র। সন্তানদের সঙ্গে বাবার এক ধরনের সম্পর্কের কাহিনি। তবে একটি বিষয় আলাদা। ‘বসু পরিবার’-এর অঞ্জন বসুর নিজের ছেলেমেয়েদের উপর অগাধ আস্থা, কিন্তু শেষে দেখা যাবে, বাবা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ছেলেমেয়েরা বাবার প্রতি দায়িত্ব পালন করছে না। যেটা ‘কন্যাদান’-এ ছিল না।
প্রশ্ন: সাধারণত ছোট পর্দায় প্রধান চরিত্রে মহিলাদেরই দেখা যায়। কিন্তু ‘বসু পরিবার’-এ আপনিই প্রধান চরিত্রে...
অরিন্দম: আমি সব সময় পুরুষ চরিত্রই প্রধান, এমন ধারাবাহিকেই অভিনয় করেছি। এর আগে ‘বামাক্ষ্যাপা’ করেছি এবং সেই নজির কিন্তু কেউ ভাঙতে পারবেন না। দশ বছর ধরে ধারাবাহিকটি চলেছে। এ ছাড়া ‘কন্যাদান’-এও আমি মুখ্যচরিত্রে ছিলাম। এই ধারাবাহিকেও তাই। রেকর্ড বলছে, প্রধান চরিত্রে আমি থাকলে ধারাবাহিক সফল হয়। আমার এই বয়সেও কিন্তু তা হচ্ছে। বয়সের দিক থেকে অনেকে আছেন, আমার থেকে বড়। কিন্তু ছোট পর্দায় পুরুষ অভিনেতাদের মধ্যে আমি সবচেয়ে সিনিয়র। ৫৮ বছর ধরে রয়েছি ইন্ডাস্ট্রিতে এবং আমি কিন্তু থেমে যাইনি। অভিনয় করেই বেঁচে আছি।
প্রশ্ন: বাস্তবে ‘অঞ্জন বসু’র মতোই কি আপনি?
অরিন্দম: (হাসতে হাসতে) হ্যাঁ, অনেকটাই তেমন। মনে-প্রাণে আমি বাঙালি। বাংলা সংস্কৃতির অবক্ষয় হলে আমি খুব আঘাত পাই। চাই, বাংলা আবার আগের জায়গা ফিরে পাক। আমি পুরনো প্রজন্মের কিংবদন্তিদের সঙ্গেও কাজ করেছি। আবার এই প্রজন্মের সঙ্গেও কাজ করছি। ফারাক অবশ্য আছে...
প্রশ্ন: ফারাক? যেমন...
অরিন্দম: আগের প্রজন্মের মানুষগুলির পা সব সময় মাটিতে থাকত। কিন্তু এখন কেউ সামান্য কিছু পেলেই তাঁদের অহঙ্কার গগনচুম্বী হয়ে যায়। উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়দের সান্নিধ্যে এসেছি, তাঁদের স্নেহ পেয়েছি। দেখেছি তাঁদের বিনয়। আমি আর খেয়ালী (দস্তিদার) চেষ্টা করি, আমাদের ছাত্রেরা যেন এমন ভাবেই তৈরি হয়।
প্রশ্ন: মধ্যবিত্ত বাঙালির মূল্যবোধ, বিনয়ী স্বভাবকে তো দুর্বলতা মনে করা হয় আজকাল...
অরিন্দম: একদমই তাই। আসলে যত দিন যাচ্ছে, আমরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমাদের এখন ভান অনেক বেশি। কিন্তু আমার বিশ্বাস, সহজ-সরল ভাবে মানুষকে যদি কিছু বোঝানো হয়, তারা তা গ্রহণ করে। এই যেমন আমাদের প্রোমোটাই কত দ্রুত সাড়া ফেলল, একটা বুড়ো নায়ক থাকা সত্ত্বেও (হাসি)।
প্রশ্ন: বড় পর্দায় কাজ করছেন না?
অরিন্দম: বড় পর্দায় পর পর বেশ কিছু ছবি করেছি। কিন্তু একটা জিনিস আমি উপলব্ধি করেছি।
প্রশ্ন: কী?
অরিন্দম: (একটু থেমে) আসলে আমার তো নতুন করে কিছু পাওয়ার নেই। তাই ঠিক করেছি, তেমন চরিত্রেই অভিনয় করব, যার কিছু সারবত্তা আছে। আমি বাবা-কাকার ভূমিকায় দু’তিন দিনের জন্য অভিনয় করব না। তাই বহু ছবির প্রস্তাব পাই, কিন্তু ফিরিয়ে দিই। ‘হংসরাজ’ই বলুন, বা ‘বামাক্ষ্যাপা’, এগুলি থেকে আমি যা পাওয়ার পেয়ে গিয়েছি। নতুন করে আমার প্রমাণ করারও কিছু নেই। আগামী দিনে যদি আমায় নিয়ে কেউ কখনও কিছু ভাবেন, তা হলে ছবি করব। নইলে নয়।
প্রশ্ন: একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। আর্টিস্ট ফোরাম থেকে সরে গিয়েছিলেন কেন?
অরিন্দম: আমি আর্টিস্ট ফোরামে সবচেয়ে বেশি দিন ধরে সচিব (সেক্রেটারি) পদে ছিলাম। কিন্তু সেখানে এত ঝড়ঝাপটা আমার উপর দিয়ে গিয়েছে, কী বলি! অমন ঝড় গোটা বাংলা ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসে কোনও দিন এসেছে বলে জানি না। অতিমারির সময়েও বেশ সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, তা-ও বোধ হয় তুলনীয় নয়। আসলে কী জানেন, থামতে জানতে হয়। তবে এ ছাড়াও কিছু কারণ আছে, যেগুলি আমি বলতে চাই না। আমি তো একজন সিনিয়র শিল্পী। অনেকেই আছেন, আমার ছোট ভাইয়ের মতো। আমায় কারণগুলি বলতে হলে তাঁদের বিরুদ্ধে নানা কথা বলতে হয়, যেটা আমি চাই না। অসুস্থতার দোহাই দিয়ে নীরবেই সরে গিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: কারও সঙ্গে বিষয়টা আলোচনা করেননি?
অরিন্দম: একমাত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সবটা বলেছিলাম। আমার সবচেয়ে বড় পাওনা, পদত্যাগপত্র পেয়ে নিজের হাতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, খুব দুঃখের সঙ্গে তোমার পদত্যাগের আবেদন গ্রহণ করছি। তোমার অবদান আর্টিস্ট ফোরাম মনে রাখবে। আমি যত্ন সহকারে রেখে দিয়েছি সেই চিঠি। একটা কথা বলি, ওই সময় বুম্বাও (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) অনেকটা সময় আমার পাশে ছিল।
প্রশ্ন: আপনি তো ইন্ডাস্ট্রির পার্টিতে যান না, অনুষ্ঠানেও তেমন যান না। তাও কী ভাবে এত কাজ করলেন?
অরিন্দম: জনসংযোগ কী ভাবে করতে হয় জানি না। আমি খুব ঘরকুনো, আর পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালবাসি। কাজটুকু করে পরিবার, আত্মীয়, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেই থাকতে আনন্দ পাই। আগে যা-ও বা যেতাম, এখন যাই না। ইচ্ছে করে না। চারপাশের ওই কৃত্রিম আবহাওয়া আমার ভাল লাগে না। আমি মদ্যপান করি না। ধূমপানও করি না। (হেসে) তো, পার্টিতে গিয়ে করবই বা কী?
প্রশ্ন: রাজনীতিতে আসার প্রস্তাব পাননি?
অরিন্দম: আর্টিস্ট ফোরামে থেকেই বুঝেছি আমি রাজনীতিতে অচল। ওই পথে চলতে গেলে, যে গুণগুলি থাকা প্রয়োজন, সেগুলি আমার নেই। তবে যদি কোনও দিন রাজনীতি করতাম, সব ছেড়ে ওটাই করতাম। রাজনীতি করতেও শিক্ষার দরকার হয়। রাজনীতিতে তো আর শিক্ষার জায়গা নেই। নিজের কাজ বুঝে নিয়ে মাঝেমাঝে রাজনীতি করব, এটা হয় না। অনেক মানুষের দায়িত্ব নিতে হয়। সুনীল দত্ত যেমন অভিনয় ছেড়ে রাজনীতিটাই করতেন।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে রাজনীতির শিকার হননি?
অরিন্দম: আসলে আমি তো সব জায়গায় যাতায়াত কম করি। যে হেতু অনেক দিন ধরে এই জগতে আছি, এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও আমায় ভালবাসে। যদি কখনও আমার প্রতি অবিচার হয়ে থাকে, সেগুলিকে রাজনীতি হিসাবে ধরিই না। সে ভাবে গায়ে মাখি না বলতে পারেন।
প্রশ্ন: অভিনয়, গান এই সব কিছুর মধ্যে স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে সময় কাটান?
অরিন্দম: লেখালিখি ও নিজের কাজ নিয়ে ছেলে ভালই আছে। ওর নিজের জগৎ আছে একটা। আমার পরামর্শ চাইলে আমি দিই। আমি আর খেয়ালী আমাদের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ভালই আছি।
প্রশ্ন: গান নিয়ে আগামী দিনে কী ভাবছেন?
অরিন্দম: ইউটিউবে আমাদের ‘অরিন্দমের গানগুলি’ নামে একটি চ্যানেল আছে। সেখানে প্রতি সপ্তাহে আমি একটি করে গান গাই। গান নিয়ে নানা কথা বলি। জানি না, আর কতদিন বেঁচে থাকব, তাই জীবনে যা যা গান শিখেছি, সেগুলি শিখিয়ে যেতে চাই। এখন অভিনয়ের পাশাপাশি গানও শেখাচ্ছি, এই প্রথম। এর আগে একমাত্র শতাব্দীকে (অভিনেত্রী শতাব্দী রায়) গান শিখিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: বাংলা ছবির জগৎ নিয়ে আক্ষেপ আছে?
অরিন্দম: আমি তো সেই সুসময় দেখে এসেছি। এখন মনে হয়, সবাই যেন আজ শর্টকাট খোঁজে। সবচেয়ে খারাপ লাগে, আজকের দিনে পরিচালকের কোনও সম্মান নেই। বিশেষ করে ছোট পর্দায়। এখন ছবি না জানা-না বোঝা অনেকের অনেক বক্তব্য থাকে।
প্রশ্ন: বহু অভিনেতার নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা রয়েছে। আজকাল পছন্দ অনুযায়ী চরিত্র নিজেরাই তাঁরা বেছে নিচ্ছেন। কী মনে হয়, ঠিক না ভুল?
অরিন্দম: ঠিক বা ভুল, ও ভাবে না বলে বলি, এ ক্ষেত্রেও আগের সময়ের থেকে এখনকার জমানার পার্থক্য স্পষ্ট। ছোট্ট একটি ঘটনা মনে পড়ছে। ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবির প্রযোজক ছিলেন উত্তম কুমার। তিনি মনে করেছিলেন, তাঁকে ওই ছবির কোনও চরিত্রে মানাবে না। দিলীপ মুখোপাধ্যায় ও বিকাশ রায় অভিনয় করেছিলেন। দ্বৈতচরিত্রে ছিলেন সুচিত্রা সেন। ওঁরা সবাই যেখানে নিজেকে মানানসই মনে করতেন না, সেখানে কখনওই অভিনয় করতেন না। এ রকম অনেক পার্থক্য থেকেই যাবে।