শ্যাম বেনেগাল। —ফাইল চিত্র।
মে মাসে কান চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর ‘মন্থন’ দেখানো হল নতুন করে। নিজে যেতে পারেননি, কিন্তু খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। এ মাসের ১৪ তারিখ নব্বই বছরের জন্মদিনে মুম্বইয়ের বাড়িতে যখন জড়ো হলেন নাসিরুদ্দিন শাহ, শাবানা আজমিরা, অসুস্থ শরীরেও শ্যাম বেনেগালকে ভারী খুশি দেখাচ্ছিল। এ বছরটা তাঁর প্রথম কাহিনিচিত্র ‘অঙ্কুর’ মুক্তি পাওয়ারও ৫০ বছর। পূর্ণতার এই রেশটুকু সঙ্গে নিয়েই যেন সোমবার সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ চলে গেলেন শ্যাম। সত্যজিৎ রায়-ঋত্বিক ঘটক-মৃণাল সেনের পরবর্তী চিত্রপরিচালকদের মধ্যে তাঁর নামই এ যাবৎ সবচেয়ে বেশি আলোচিত, হিন্দি সমান্তরাল ছবির প্রধান পুরোহিতের আসনটিও তাঁর জন্য সংরক্ষিত।
হবে না-ই বা কেন? ১৯৬৯ সালে মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ যদি ভারতীয় ছবিতে তথাকথিত নবতরঙ্গের সূচনা করে থাকে, হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিসরে তাকে একটি সুস্পষ্ট ধারায় পরিণত করার কাজটি অনেকাংশে যিনি করেছিলেন, তিনি শ্যাম বেনেগাল। তিনি ‘অঙ্কুর’ করার আগেই যদিও মণি কলের চার-চারটি ছবি করা হয়ে গিয়েছে, কুমার সাহনি ছবি করে ফেলেছেন। মালয়ালমে ছবি করতে শুরু করে দিয়েছেন আদুর গোপালকৃষ্ণণ। কিন্তু হিন্দি ছবি ‘অঙ্কুর’ অনেক বেশি সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছেছিল এবং সেই ঝাঁকুনির প্রভাব ছিল বিস্তৃততর।
১৯৭৪ সালেই সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘ফোর অ্যান্ড আ কোয়ার্টার’ প্রবন্ধে আলোচনা করলেন গরম হাওয়া (এম এস সথ্যু), মায়াদর্পণ (কুমার সাহনি), দুবিধা (মণি কল) এবং অঙ্কুর নিয়ে। সেখানে অঙ্কুরের গল্প নিয়ে বেশ কিছু সমালোচনা থাকলেও পরিচালক হিসেবে শ্যামের দিকে যে নজর রাখতেই হবে, সে কথা পরিষ্কার লিখেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন ছবির ক্যামেরা (গোবিন্দ নিহালনি) এবং অভিনয়ের। ‘অঙ্কুর’-এ অভিনয় করলেন কারা? শাবানা আজমি, অনন্ত নাগ, সাধু মেহের। প্রথম ছবিতেই জাতীয় পুরস্কার জিতলেন শাবানা। এবং শ্যামের ছবিকে কেন্দ্র করেই এর পরে ক্রমশ রুপোলি পর্দা ফুঁড়ে উঠে আসতে লাগলেন স্মিতা পাটিল, নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরী, অমরীশ পুরী, কুলভূষণ খারবান্দারা। পরবর্তী কালে এর সঙ্গেই যোগ হল নীনা গুপ্ত, রাজিত কপূর, রাজেশ্বরী সচদেবদের নাম।
সত্তরের দশক যদি ক্রুদ্ধ নায়কের হিমালয়সম উত্থান দেখে থাকে, তার পাশাপাশি জীবনের ধুলোবালিতে পা গেঁথে থাকা, বাস্তবতার রুক্ষ মাটি কামড়ে থাকা ছবিকেও তার জায়গা করে নিতে দেখেছে। শ্যাম বেনেগাল সেই অন্য ছবির মিছিলে অগ্রপথিক হয়ে থেকেছেন। গোবিন্দ নিহালনি, সইদ মির্জা, সাই পরাঞ্জপে, কেতন মেহতা, গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তরা এই রাস্তা ধরেই এগিয়ে গিয়েছেন। আর শ্যাম নিজে? পঞ্চাশ বছরের কেরিয়ারে নিজেকে বারবার পাল্টে নিয়েছেন, নানা ধরনের কাহিনি, নানা সময়ের, নানা গোত্রের ছবি করে গিয়েছেন নিরলস— পাল্টায়নি একটাই জিনিস। শিল্পী হিসেবে নৈতিক দায়বদ্ধতা, পীড়িতের প্রতি সমানুভূতি। সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে তাঁর যে তথ্যচিত্র, সেখানেও সত্যজিতের প্রতি শ্যামের নানা প্রশ্নে এই দিকগুলো ধরা পড়েছিল স্পষ্ট।
২৪টি কাহিনিচিত্র জুড়ে শ্যামের বিস্তৃতি। সঙ্গে তথ্যচিত্র এবং টিভি সিরিজ। শ্যামের নিজস্ব মূল্যবোধ এবং অবস্থান চিনে নেওয়া যায় সব কাজেই। ভিন ধারার ছবির জগতে তাঁর আসনটি বনস্পতিসম। গুজরাতের দুগ্ধ সমবায় যখন ‘মন্থন’ ছবির কথা ভাবল, তারা বেছে নিল শ্যামকে। এই সেদিনও স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলেন শ্যাম— শুটিং হচ্ছে আর দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে গরুর গাড়ি চড়ে শুটিং দেখতে আসছেন গোয়ালারা। তাঁরা প্রত্যেকে জানেন, এ তাঁদের নিজেদের ছবি— ভারতের প্রথম ‘ক্রাউড ফান্ডিং’-এ তৈরি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এল। অপারেশন বর্গা নিয়ে প্রথম ছবির ভার বর্তাল শ্যামের উপরে। তৈরি হল ‘আরোহণ’। শ্যামের শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি? বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষকে স্মরণ করে জীবনীচিত্র তৈরির দায়িত্ব শ্যামকেই দিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। গান্ধী, নেতাজি এবং মুজিব— উপমহাদেশের রাজনীতির তিন প্রধান পুরুষকেই পর্দায় ধরেছেন শ্যাম। এবং ‘নেহরু’। প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ অবলম্বনে ‘ভারত এক খোজ’-কেটিভির মাধ্যমে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন শ্যামই। ‘সংবিধান’ নিয়ে রাজ্যসভা টিভির সিরিজ়? সে-ও তো শ্যাম। সমান্তরাল ছবির ধারা যখন শুকিয়ে আসতে লাগল, উত্তরসূরিরা অনেকেই পা বাড়ালেন মূলধারার ছবির দিকে। শ্যাম কী করলেন? জনপ্রিয় ছবির আঙ্গিকটি নিলেন খানিক— কিন্তু ‘ওয়েলকাম টু সজ্জনপুর’ বা ‘ওয়েল ডান আব্বা’ কোথাও আপস করল না শ্যামের মূল মেজাজ এবংমূল্যবোধের সঙ্গে।
সমান্তরাল ছবির ধারায় তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা শুধু নয়, শ্যামকে পদে পদে স্মরণ করতে হয় তাঁর কাজের নিখাদ বৈচিত্রের জন্যও। এক দিকে অঙ্কুর-নিশান্ত-মন্থন, অন্য দিকে মাম্মো-সরদারি বেগম-জুবেদা... এক দিকে ভূমিকা-মান্ডি-কলযুগ তো অন্য দিকে জুনুন-সুরজ কা সাতওয়া ঘোড়া-চরণদাস চোর...।রাস্কিন বন্ড থেকে বিজয় তেন্ডুলকর, মহাভারত থেকে ধরমবীর ভারতী, বনরাজ ভাটিয়া থেকে এ আর রহমান— শ্যামের বিস্তার বহুগামী। ভারতীয় ছবিতে নারীচরিত্রের আলোচনা? শ্যাম অপরিহার্য। ভারতীয় ছবিতে মুসলিম নারী চরিত্রের উপস্থাপন? শ্যাম অপরিহার্যতর। ছবি-সেন্সরশিপ ইত্যাদি নিয়ে প্রবল ডামাডোলের মধ্যে বর্তমান শাসক শিবিরকেও সর্বজনগ্রাহ্য নাম হিসেবে বেছে নিতে হয়েছিল শ্যাম বেনেগালকেই। ২০১৬ সালে তাঁরই নেতৃত্বে ফিল্ম সার্টিফিকেশন সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি হয় এবং রিপোর্ট জমা দেয়। ছবির ক্যাটিগরি বাড়িয়ে, কাঁচির প্রকোপ কমানোরই সুপারিশ করেছিলেন শ্যাম। তার পরে ২০২১ সালে যখন সরকারের তরফে সিনেমাটোগ্রাফ আইন সংশোধনের প্রস্তাব এল, বিরোধিতা করতে এতটুকু পিছপা হননি তিনি।
কোঙ্কনিভাষী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। জন্মেছেন, বড় হয়েছেন হায়দরাবাদে। ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতির স্নাতক হয়ে চলে এলেন মুম্বইয়ে। যোগ দিলেন বিজ্ঞাপন সংস্থার কাজে। শ্যামের প্রথম তথ্যচিত্র কিন্তু ১৯৬২ সালেই, গুজরাতি ভাষায় তৈরি ‘ঘর বেঠা গঙ্গা’। প্রথম কাহিনিচিত্র তৈরি হতে পেরিয়ে গিয়েছিল আরও এক দশকেরও বেশি।কিন্তু বারো বছর বয়স থেকে ক্যামেরায় হাত পাকাতে শুরু করা শ্যাম নয়ের কোঠা ছুঁয়েও ছবি করার কথাই ভাবতেন অনবরত। দশ দিন আগে শেষ জন্মদিনেও বলছিলেন, ‘‘দু’টো তিনটে বিষয় নিয়ে ভাবছি। কোনটা করবজানি না।’’
সব সময় বলতেন অতীত আঁকড়ে বাঁচতে চান না। শ্যাম বেনেগাল প্রয়াত হয়েছেন, অতীত হননি।