কৌশিক সেন
করোনা থেকে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছি। আজ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার দিনে ঠিকই করেছিলাম সকাল থেকেই টেলিভিশনে চোখ রাখব। ফলাফলের ধারা দেখে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি। আবার মন খারাপও করছে।
গতকাল পর্যন্ত মনটা ভীষণ খারাপ ছিল। শনিবার, মানে নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগের দিন, আমার কাছে একটা ফোন আসে। অচেনা নম্বর। ধরতেই ফোনের ওপার থেকে এক ভদ্রমহিলা আমাকে গালিগালাজ করতে থাকেন। আমরা নাকি তৃণমূলের উচ্ছিষ্টভোজী! এক্সিট পোলের ফল ঘিরেই তাঁর এই আচরণ। আমি তো অবাক!
এই নির্বাচনের ফল আসলে আমার চোখ খুলে দিল। বুঝতে পারলাম, হতাশাগ্রস্ত বামপন্থীরা কী ভয়ঙ্কর হতে পারেন। ওঁরা চিকিৎসার বাইরে। এ রকম ফোন বেশ কয়েক দিন ধরেই আসছিল। নন্দীগ্রামের সময়েও বামপন্থীদের আচরণের এমন প্রমাণ পেয়েছিলাম।
কিন্তু সিপিএমের সদস্যেরা এমন করছেন কেন? আমি বরাবর বলে এসেছি, এখন যা সময়, তাতে ভিতরের সব দ্বন্দ্ব ভুলে বিজেপি-কে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়াতে হবে। আরে আমি কে? অমর্ত্য সেনের মতো মানুষ বলছেন বিজেপি কী ভয়ঙ্কর একটা শক্তি!
এই গালিগালাজ যদি আমাকে বিজেপি-র হয়ে কেউ করত, আমি অবাক হতাম না। কিন্তু বামপন্থীরা এমন করবেন? ওঁদের এ বারের নির্বাচনের ফলাফল দেখুন, আসনসংখ্যা দেখুন। ক্ষমতার থেকে দূরে থাকতে থাকতে কী অবস্থা হয়েছে! ওঁদের উচ্চ নেতাদের মধ্যে,এমনকি ফেসবুকের কমরেডদের মধ্যেও এই সমস্যা দেখছি। একদিকে যেখানে কেরলে বামপন্থীরা জিতছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে এই হাল! আমি আজও বিশ্বাস করি অতি ডানপন্থী দলের বিরুদ্ধে অতি বামপন্থী দলই রুখে দাঁড়াতে পারে।
আমার মনে আছে হান্নান মোল্লাকে নিয়ে বামপন্থীরা ব্যারাকপুরে কৃষক আন্দোলনের সময়ে বড় সাংস্কৃতিক জমায়েত করেছিলে। আমাকে সেখানে বলতে বলা হয়েছিল। ওখানে তৃণমূলের তুমুল নিন্দে করার পরেও বলেছিলাম, আসল শত্রু কিন্তু বিজেপি।
যত দিন গিয়েছে, বিজেপি-র স্বরূপ প্রকাশ হয়েছে। যোগী আদিত্যনাথ আক্ষরিক অর্থেই অপরাধী। তিনি নিজেদের রাজ্যে লোকে অক্সিজেনের অভাবের কথা বললে শাস্তি ঘোষণা করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কোর্ট মুখ খুলছে। তাঁরই দল পশ্চিমবঙ্গে আসতে পারে না। বিশ্বে এখন দুটো ভাইরাস, করোনা আর বিজেপি। একটাকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আটকাতে পেরেছে। আর একটাকে তৃণমূল সরকারেরই কিন্তু আটকাতে হবে। লাফিয়ে পড়তে হবে এ বার। এটাই আমার এই সরকারের কাছে শেষ নিবেদন।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষের চেতনা এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে। আমি নিজে দেখেছি সন্তোষপুরের রাস্তায় বাচ্চা ছেলেমেয়েরা ম্যাটাডর নিয়ে ছোট ছোট লাল রঙের ‘নো ভোট টু বিজেপি’ পোস্টার লাগাচ্ছে। আমরা যে ভিডিয়ো তৈরি করেছিলাম, সকলে নিজেদের পয়সা খরচ করে তৈরি করেছে। এই বাচ্চা ছেলেমেয়েদের পাশে পরমব্রত, অনির্বাণরা ছিলেন। বেণুদা ( সব্যসাচী চক্রবর্তী) ছিলেন। এই যে প্রবণতা— সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে বিজেপি-কে চাই না, তৃণমূল এর ফায়দা লুটেছে। এ বার দেখতে হবে তৃণমূল শুধু একে ফায়দা হিসেবেই দেখবে, না কাজেও লাগাবে!
অথচ আবার বলছি, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী নীতিই কিন্তু বামপন্থী আন্দোলনের ধারা। এটা তো সিপিএমের নেতৃত্বেই হতে পারত। কিন্তু তা হল না। কী অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেমেয়েরা এ বারের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু সিপিএম এঁদের নষ্ট করল। নইলে শতরূপের মতো এমন বুদ্ধিমান ঝলমলে ছেলে জাভেদ খানের কাছে এত ব্যবধানে হারতে পারেন! সিপিএমের হারটা খুব বড় করে ধরা পড়ল এ বার। তার জন্য মন খারাপও হচ্ছে।
তবে এই তারকা প্রার্থী নিয়ে মাতামাতিও কোনও দলের ক্ষেত্রে কাজে লাগল না। তৃণমূল এই ধারাটা লালন করেছে বহু দিন। আর বিজেপি আচমকা করেছে। ফলে ইন্ডাস্ট্রিতে শিল্পী হিসেবে যাঁদের কোনও কৃতিত্ব নেই, সেই সব অভিনেতারা বিজেপি-তে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি বাড়ি, গাড়ি, সোনার নিরিখে কৃতিত্ব বা ছবি জনপ্রিয় হওয়ার নিরিখে সাফল্যের কথা বলছি না। কেউ কেউ আছেন বিজেপি-তে, যেমন রুদ্রনীল। অভিনেতা হিসেবে চমৎকার, কিন্তু তিনি আবার অন্য দিকে সুবিধেবাদী। আর বাকি যাঁরা গিয়েছেন, তাঁদের শিল্পী হিসেবে যে ভবিষ্যৎ নেই, সেটা মানুষ ধরে ফেলেছে।
বিজেপি আশা করি বুঝতে পেরেছে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বোকা নয়!
(লেখক নাট্যপরিচালক এবং অভিনেতা)