খেতে খেতেই কথা হল।
গিয়েছিলেন ‘মোদীর দূত’ হিসেবে। বেরোলেন ‘শান্তিকুঞ্জের মেয়ে’ হয়ে। আতিথেয়তায় হুগলির সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়কে কাছে টেনে নিলেন প্রবীণ তৃণমূল সাংসদ শিশির অধিকারী। খাওয়ালেন নিজে সামনে বসে থেকে। শেষে বললেন, ‘‘আবার এসো মা। নিজের বাড়ি মনে করে যখন খুশি চলে আসবে।’’ শান্তিকুঞ্জের গৃহকর্তাকে সে কথাও দিয়ে দিলেন আপ্লুত লকেট। সূত্রের খবর, পাশাপাশিই লকেটকে ‘পাশে থাকা’র বার্তাও দিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারীর জনক।
শান্তিকুঞ্জের গৃহকর্তা শিশিরের অনেক পরিচয়। তিনি প্রাক্তন বিধায়ক। সেটা পর্যায়ক্রমে কংগ্রেস এবং তৃণমূল দু’দলের টিকিটেই। তিনি কাঁথি পুরসভার প্রাক্তন প্রধান। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। প্রথম মনমোহন সিংহ সরকারে শিশির প্রতিমন্ত্রী ছিলেন গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকে। তবে লকেট তাঁর বাড়িতে যাওয়ার পর শনিবার শিশিরের পরিচয় যেন শুধুই ‘গৃহকর্তা’। এক যৌথ পরিবারের গৃহকর্তা। যে গৃহকর্তা নিজে সাংসদ শুধু নন, তাঁর এক পুত্রও তৃণমূলের সাংসদ। আরও এক পুত্র সম্প্রতি-প্রাক্তন কাঁথি পুরসভার প্রধান। আর মেজ পুত্র শুভেন্দু তো নীলবাড়ির লড়াইয়ে বিজেপি-র ‘ভিআইপি প্রার্থী’। নন্দীগ্রামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী।
শনিবার শুভেন্দু ছিলেন দিল্লিতে দলের বৈঠকে। তবে বাড়িতে ছিলেন শিশিরের তিন পুত্র এবং পুত্রবধূরা। লকেট শান্তিকুঞ্জে ছিলেন মিনিট তিরিশ। ওইটুকু সময়ের মধ্যে কিছুটা গালগল্প বাদ দিলে বাকিটাই নাকি খাওয়াদাওয়ায় চলে গিয়েছে বলে দাবি লকেটের। রাজ্য বিজেপি-র ‘তারকা’ সাধারণ সম্পাদকের কথায়, ‘‘এলাহি আয়োজন ছিল খাওয়া দাওয়ার।’’ ভাতের সঙ্গে উচ্ছে ভাজা আর বড়ি দিয়ে লাউ ঘণ্ট। এর পরে সজনে ডাঁটা দিয়ে শুক্তো। এর পরে আমিষ। তাতে গলদা চিংড়ির সঙ্গে চিকেন এবং মটন। আর ছিল স্যালাড। আলাদা আলাদা বাটিতে সাজানো। সেই সঙ্গে শেষ পাতে চাটনি, মিষ্টি তো ছিলই। দেখেই চমকে যান লকেট। শান্তিকুঞ্জের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বললেন, ‘‘এত কিছু আমি খাই না। কিন্তু কিছুতেই সে কথা শুনতে চাইলেন না শিশিরবাবু। নিজে হাতে এটা-ওটা থালায় ঢেলে দিলেন। আমি মাছ খেতে খুব ভালবাসি। সেটাই খেয়েছি।!’’
খাওয়াদাওয়ার মধ্যেই নানা কথা হয়েছে। তবে বেশি কিছু বলার সুযোগই নাকি পাননি লকেট। শিশিরবাবুই বলতে থাকেন। লকেটের কথায়, ‘‘অভিভাবকের মতো আমায় নানা উপদেশ দিলেন। বললেন, তুমি একা লড়াই করে এত উপরে উঠেছ। সারাদিন পরিশ্রম করো দেখি। সময় মতো খাবে। শরীরের যত্ন নেবে।’’ রাজনীতির কথা হল না? লকেটের জবাব, ‘‘রাজনীতির কথা তো বলতে যাইনি। কোনও দিন শান্তিকুঞ্জে যাইনি। প্রথমবার গেলাম। আমার খুব ভাল লেগেছে। বাড়ির সবাই খুবই আন্তরিক। শুভেন্দু’দা ছাড়া সবাই ছিলেন। ছোটরাও সবাই ছিল। আমার সঙ্গে সবাই মিলে গ্রুপ ছবিও তুলেছে।’’ লকেট থাকাকালীন সেখানে ছিলেন সাংসদ দিব্যেন্দু এবং কাঁথির প্রাক্তন পুরপ্রধান সৌম্যেন্দুও।
পরিবারের সবার সঙ্গে আলাপ পর্ব মিটে যেতে লকেটকে স্ত্রী-র ঘরে নিয়ে যান শিশির। সেখানেও আয়োজন ছিল। যেতে না যেতেই গায়ত্রীদেবী এক গ্লাস ডাবের জল দেন। মুখোমুখি বসিয়ে লকেটের কুশল জিজ্ঞাসা করেন। তারপরে নিজে হাতে লকেটকে পান সেজে দেন শিশির-জায়া। ততক্ষণে শান্তিকুঞ্জের সামনে সংবাদমাধ্যমের ভিড়। পান চিবোতে চিবোতে লকেট বলেন, ‘‘মেদিনীপুরে এসে শান্তিকুঞ্জে না এলে এই জেলায় আসাটাই তো বৃথা।’’
আগামী ২৪ মার্চ কাঁথিতে সভা করতে আসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নীলবাড়ির লড়াইয়ে সেই সভা ‘ঐতিহাসিক’ হয়ে উঠতে পারে। কারণ, সেখানে স্থানীয় সাংসদ হিসেবে শিশির হাজির থাকতে পারেন বলে বিজেপি সূত্রে খবর। সেই জল্পনাকে আরও উস্কে দেয় শনিবার লকেটের শান্তিকুঞ্জ সফর। রাজ্য বিজেপি নেতাদের দাবি, শিশিরকে আমন্ত্রণ জানানোর ইচ্ছা নাকি প্রকাশ করেছেন স্বয়ং মোদী। সেই ইচ্ছা মেনেই লকেট যান প্রবীণ রাজনীতিকের বাড়িতে। প্রাথমিক ভাবে রাজ্য বিজেপি শিবির এই বার্তা পেয়েছে যে, অশীতিপর সাংসদ তাদের ‘পাশে’ আছেন।
শিশিরের মন জয়ের দায়িত্ব লকেট কতটা পালন করতে পারলেন, তা জানতে আরও কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু শনি-দুপুরে পেট এবং মন দুই-ই ভরেছে লকেটের। বিজেপি-র কর্মসূচি মেনে ইদানীং প্রায়ই কর্মীদের বাড়ি বাড়ি খেতে হয় লকেটকে। কিন্তু শান্তিকুঞ্জের অভিজ্ঞতা তো শুধু খাওয়ার নয়। চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় মিলিয়ে ‘রাজনীতির মহাভোজ’।