কৌশানী, রাজ, পার্নো, যশ এবং সায়নী
রাজনীতিতে সদ্য পা রেখেছেন এঁরা। তার প্যাঁচপয়জার বুঝে ওঠার আগেই শামিল ভোটযুদ্ধে! তার উপরে ‘তারকা প্রার্থী’ হওয়ার বাড়তি চাপ তো রয়েছেই। তারকা প্রার্থীদের ভোটের পরে আর এলাকায় খুঁজে পাওয়া যায় না— এমন ধারণা মানুষের মনে গেঁথে রয়েছে অনেক দিনই। ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। তবে রুপোলি পর্দায় দেখা মুখেরা যখন দরজায় এসে জোড়হাত করে দাঁড়ান, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার পারদ চড়ে বইকি। বিনোদন দুনিয়ার মানুষেরা বাস্তবে কী কী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন নিজেদের কেন্দ্রে?
ভবানীপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রের প্রার্থী রুদ্রনীল ঘোষ অবশ্য রাজনীতিতে নতুন নন। কিন্তু ’২১-এর নির্বাচন তাঁর জন্যও প্রথম। বিজেপির হয়ে লড়াইয়ে নামা অভিনেতা বললেন, ‘‘কাটমানি-তোলাবাজি নিয়ে ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছেন এখানকার মানুষ। এটা দূর করতেই হবে। ভবানীপুর আমার কাছে একটা মিনি ভারত। সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে একটা কমিউনিটি সেন্টার খোলার ইচ্ছে আছে।’’ সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের পথে হাঁটতে চাইছেন যে রুদ্রনীল, বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদকে তিনি অস্বীকার করবেন কী ভাবে? ‘‘কোনও ধর্মকে অস্বীকার করার কথা বলে না বিজেপি। অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে। দলে অনেক সংখ্যালঘু কর্মী-সমর্থক রয়েছেন। বিজেপি ‘মুসলিম-বিরোধী’ বলে যে অপপ্রচার চলছে, তা বন্ধ হওয়া দরকার। ধর্মীয় ভেদাভেদ তৃণমূলের অস্ত্র। সেটা ইমাম ভাতা আর পুরোহিত ভাতার অঙ্ক দেখলেই বোঝা যায়,’’ জবাব তাঁর।
ভবানীপুরে রুদ্রনীলের বিপক্ষে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। যদি তাঁর কাছে হেরে যান? ‘‘জেতা-হারা দুটোই খুব স্বাভাবিক ভাবে নেব,’’ বললেন রুদ্রনীল। হারের কথা ভাবছেন না রাজ চক্রবর্তীও। তাঁর ছবির নায়কদের মতোই রাজও পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তৃণমূলের হয়ে ময়দানে নেমেছেন, অর্জুন সিংহের খাসতালুক ব্যারাকপুরে। তাঁকে বিরোধীরা ‘বহিরাগত’ বলে দেগে দিলেও সে সব নিয়ে বিশেষ ভাবছেন না পরিচালক। এলাকার যুব সম্প্রদায়ের উপরে বহিরাগতদের প্রভাব দূর করে গুন্ডারাজ দূর করাই হবে তাঁর অন্যতম লক্ষ্য, জানালেন রাজ। ‘‘এ ছাড়া যেখানে সম্ভব সিসিটিভি মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মহিলাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা, জলের সমস্যা নিয়েও কাজ করব,’’ বয়ান তাঁর।
নিজের কেন্দ্র বরাহনগরকে পুরোপুরি চিনে ওঠার কাজটা এখনও সে ভাবে শুরু করতে পারেননি বিজেপির আর এক তারকা প্রার্থী পার্নো মিত্র। ‘‘আমি এখনও মনোনয়ন জমা দিইনি, তাই জোরকদমে প্রচার শুরু করিনি। তবে কেন্দ্রে গিয়ে অভাব-অভিযোগ শুনেছি। এখানে জল জমা, পানীয় জলের সমস্যা আছে। মনে হচ্ছে, গত দশ বছরে এই এলাকায় কোনও কাজই হয়নি,’’ কটাক্ষ অভিনেত্রীর।
নায়িকার মতে, কেন্দ্র আর রাজ্যে এক সরকার না থাকলে উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর উন্নয়নের ক্ষেত্রে ধর্মীয় ভেদাভেদের প্রশ্নও উড়িয়ে দিলেন, ‘‘উন্নয়ন হলে কি কোনও এক ধর্মের মানুষ উপকৃত হবেন? বিজেপি-র প্রার্থী তালিকাতে কিন্তু মুসলিম নামও রয়েছে। তা হলে এই প্রশ্ন আসছে কেন?’’
তৃণমূলের হয়ে টিকিট পাওয়ার আগে তাঁকে ঘিরে বিতর্কে সরগরম থেকেছে রাজ্য-রাজনীতি। সেই সায়নী ঘোষ নিজের কেন্দ্র আসানসোল দক্ষিণের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছেন প্রচারে নেমে। দলের জেতার ব্যাপারেও আত্মবিশ্বাসী শোনাল তাঁর কণ্ঠ, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃতীয় বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন, এর বাইরে আর কিছু ভাবছি না। ফলাফল যা-ই হোক, সক্রিয় রাজনীতি চালিয়ে যাব।’’ তাঁর কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকায় পানীয় জলের সরবরাহ অনুমোদন পেয়েও আটকে রয়েছে, প্রচারে গিয়ে শুনেছেন সায়নী। ক্ষমতায় এলে সেই আটকে থাকা কাজগুলি আগে করে ফেলতে চান তিনি।
কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রে বিজেপির মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে কঠিন লড়াইয়ে তৃণমূলের নতুন মুখ কৌশানী মুখোপাধ্যায়। তাঁর স্বপ্ন, আসনটি জিতে ‘দিদি’কে উপহার দেওয়া। ‘‘জিতলে এলাকার মহিলাদের উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করতে চাই,’’ বললেন কৌশানী। হার নিয়ে এখনই ভাবতে রাজি নন তিনি। ছোট পর্দার নায়িকা লাভলি মৈত্রও সোনারপুর দক্ষিণ থেকে শাসকদলের হয়ে জেতার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী।
বিজেপির তারকা প্রার্থী যশ দাশগুপ্তের দায়িত্বে হুগলির চণ্ডীতলা কেন্দ্র। জিতলে প্রথম কাজ কী করবেন? ‘‘এলাকার মানুষদের যে কোনও চিকিৎসার জন্য উত্তরপাড়ায় যেতে হয়। কারণ, এখানকার হাসপাতালের অবস্থা খুবই খারাপ। শহর ছাড়িয়ে একটু এগোলেই ঢালাই রাস্তা নেই। জিতলে অনেক দায়িত্ব আসবে, সেগুলো পালন করতে চাই।’’ বিজেপির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ নিয়ে যশের বক্তব্য, ‘‘সবকা সাথ সবকা বিকাশের কথা বলে বিজেপি। আমিও তাতেই বিশ্বাসী।’’
হেরে গেলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নেবেন, কিন্তু দল ছেড়ে যাবেন না— জানালেন উত্তরপাড়ার তৃণমূল প্রার্থী কাঞ্চন মল্লিক। জিতলে এলাকায় থেকে মানুষের জন্য কাজ করবেন বলে ইতিমধ্যে সেখানে বাড়ি খোঁজাও শুরু করে দিয়েছেন তিনি। ‘‘এখানকার স্টেট জেনারেল হাসপাতালের অবস্থার উন্নতি করতে চাই। এ ছাড়া কাঁচা নর্দমা, পানীয় জলের সমস্যার দিকেও নজর দেব,’’ বয়ান কাঞ্চনের।
টালিগঞ্জের বাম জোটের প্রার্থী দেবদূত ঘোষ ‘পাইয়ে দেওয়া’র রাজনীতি থেকে বার করতে চান মানুষকে। ‘‘ভাতা দেওয়ার প্রয়োজন কেন থাকবে? পরিশ্রম ও যোগ্যতা দিয়ে রোজগার ও রাজ্যের অর্থনীতি ঘোরানোই লক্ষ্য হবে। টেলিভিশনে কী করে বড় বিনিয়োগ আনা যায়, সেই চেষ্টাও থাকবে,’’ বললেন দেবদূত।
প্রতিশ্রুতির পাহাড় জমছে। তা কতটা বাস্তবায়িত হবে, সেটা সময় বলবে। তবে তারকা-প্রার্থীর ‘বদনাম’ ঘোচাতে যে সকলেই বদ্ধপরিকর, তা স্পষ্ট তাঁদের জবানিতেই।