TMC Jana Garjana

তৃণমূলের প্রার্থিতালিকায় ১১টি নতুন মুখ, ১১ বিধায়ক, দুই মন্ত্রী, রাজ্যসভার এক সাংসদও লোকসভার যুদ্ধে

লোকসভা ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার আগেই রাজ্যের ৪২ আসনের প্রার্থী ঘোষণা করে দিল তৃণমূল। তাতে নতুন মুখের বেশ কিছু ‘চমক’ রয়েছে। বেশ কয়েক জন বিধায়ক এবং দুই মন্ত্রীকেও ভোট লড়তে পাঠাল তৃণমূল।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৪ ২০:৫১
TMC

ব্রিগেডে তৃণমূলের ‘জনগর্জন সভা’ থেকে প্রার্থিতালিকা ঘোষণা হয়েছে। —নিজস্ব চিত্র।

আসন্ন লোকসভা ভোটে মোট ২৬টি নতুন মুখ আনল তৃণমূল! প্রার্থিতালিকায় অভিনেত্রী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান বা কীর্তি আজাদের মতো নাম চমক দিয়েছে। তবে নতুন মুখেদের একটা বড় অংশ লোকসভার বাইরের জনপ্রতিনিধি। এমনকি, মন্ত্রীও! মোট ১১ জন বিধায়ককে লোকসভার টিকিট দিয়েছে তৃণমূল। তাঁদের মধ্যে দু’জন আবার রাজ্যের মন্ত্রী। পাশাপাশি, কয়েক মাস আগে রাজ্যসভায় পাঠানো এক সাংসদও লোকসভায় প্রার্থী হচ্ছেন। ১৬ জন বিদায়ী সাংসদকে আবার লোকসভার টিকিট দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

লোকসভা ভোটে ১১টি আসনে তফসিলি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিকে প্রার্থী করা হয়েছে। তফসিলি জনজাতি থেকে দু’জন এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির দু’জনকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা ১২ জন। মোট ১১টি নতুন মুখ। দার্জিলিং থেকে গোপাল লামা, মালদহ উত্তরে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, মালদহ দক্ষিণে শাহনওয়াজ আলি রায়হানকে প্রার্থী করা হয়েছে। ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠানকে বহরমপুর, হুগলিতে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, আরামবাগে মিতালি বাগ, তমলুকে তরুণ নেতা দেবাংশু ভট্টাচার্যকে টিকিট দেওয়া হয়েছে। ঝাড়গ্রাম আসন থেকে প্রার্থী করা হয়েছে কালীপদ সরেন, বিষ্ণুপুরে সুজাতা মণ্ডল, বর্ধমান পূর্বে শর্মিলা সরকার এবং বর্ধমান-দুর্গাপুরে কীর্তি আজাদকে। বিজেপি ফেরত সাত জনকে লোকসভায় লড়তে পাঠাচ্ছে তৃণমূল। এঁরা হলেন কৃষ্ণ কল্যাণী, বিশ্বজিৎ দাস, মুকুটমণি অধিকারী, বিপ্লব মিত্র, শত্রুঘ্ন সিন্‌হা এবং কীর্তি আজাদ।

তৃণমূলের প্রার্থিতালিকা নিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কটাক্ষ, ‘‘প্রার্থিতালিকায় তৃণমূলের দৈন্য ধরা পড়েছে। রাজ্যের দুই মন্ত্রী-সহ ১১ জন বিধায়ককে প্রার্থী করতে হয়েছে। তা-ও ধার করা বিধায়ক! উত্তরবঙ্গে কয়েক জন প্রার্থীকে তো তৃণমূল নেতারাও চেনেন না! তবে একটা কথা ঠিক— প্রার্থী যিনিই হোন, তাঁকে লড়তে হবে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে।’’

ব্যারাকপুর আসনে তৃণমূল কাকে প্রার্থী করবে, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছিল মাস কয়েক আগে। ব্রিগেডের মঞ্চে বিজেপির টিকিটে ওই আসনে জেতা এবং তৃণমূলে ফেরা বিদায়ী সাংসদ অর্জুন সিংহ উপস্থিতও ছিলেন। কিন্তু অভিষেক জানালেন, ব্যারাকপুর থেকে এ বার প্রার্থী করা হয়েছে পার্থ ভৌমিককে। পার্থ নৈহাটির তিন বারের বিধায়ক। এখন রাজ্যের সেচমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। পাশাপাশি, রেশন মামলায় জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের গ্রেফতারির পর উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলে আলাদা করে গুরুত্ব পাচ্ছেন পার্থ। বিশেষত, সন্দেশখালিকাণ্ডে শাসকদল যখন অস্বস্তিতে, তখন প্রথম থেকেই সেখানে জট কাটানোর চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছে এই মন্ত্রীকে। বার বার সন্দেশখালি গিয়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ-অনুযোগ শুনেছেন। তৃণমূলের যে নেতারা ‘জমি-দুর্নীতি’তে অভিযুক্ত, তাঁদের ধারদেনা তৃণমূলের তরফে মিটিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়ে সন্দেশখালির আগুনে জল ঢালার দায়িত্বও তাঁকেই দেওয়া হয়েছিল। লোকসভার টিকিট পেয়ে মন্ত্রী জানান, দল যখন যে দায়িত্ব দিয়েছে, তা পালন করেছেন। এ বারও তার অন্যথা হবে না।

বালুরঘাট আসনে তৃণমূল প্রার্থী করেছে মন্ত্রী বিপ্লব মিত্রকে। হরিরামপুরের বিধায়ক তিনি। তৃণমূলের পুরনো কর্মী হলেও এক সময় দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করেছিলেন তিনি। তবে তৃণমূলে ফেরার পর কৃষিবিপণন মন্ত্রী হন। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা তৃণমূলের ‘অভিভাবক’ বলে পরিচিত বিপ্লবকে প্রার্থী ঘোষণার পর খুশি দলীয় কর্মীরা। বালুরঘাটে উৎসবের মেজাজও দেখা গিয়েছে। আলিপুরদুয়ার আসনে তৃণমূলের প্রার্থী প্রকাশ চিক বরাইক। চা-শ্রমিক নেতা প্রকাশকে কিছু দিন আগেই রাজ্যসভার সাংসদ করেছিল তৃণমূল। শাসকদলের একাংশ বলছে, সাংগঠনিক কাজে নিজের জাত চিনিয়েছেন প্রকাশ। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে ব্যর্থতা মুছে দিয়ে গত বছর পুরসভা ভোটে ফালাকাটা এবং আলিপুরদুয়ারে তৃণমূলের জয়ের বড় ভূমিকা ছিল প্রকাশের।

তৃণমূলের প্রার্থিতালিকা।

তৃণমূলের প্রার্থিতালিকা।

জলপাইগুড়ি লোকসভা আসনে তৃণমূলের প্রার্থী ধূপগুড়ির বিধায়ক নির্মলচন্দ্র রায়। গত বিধানসভা ভোটে ওই বিধানসভা আসনে জয়ী হয় বিজেপি। পরে বিধায়ক বিষ্ণুপদ রায়ের অকস্মাৎ মৃত্যুর কারণে উপনির্বাচন হয়। তখনই বিজেপির হাত থেকে রাজবংশী অধ্যুষিত আসনটি ছিনিয়ে নেয় তৃণমূল। পেশায় অধ্যাপক নির্মল হন বিধায়ক। এ বার তাঁকে সাংসদ হওয়ার লড়াইতে নামাল দল। অন্য দিকে, খাতায়কলমে বিজেপির তিন বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস, মুকুটমণি অধিকারী এবং কৃষ্ণ কল্যাণীকে যথাক্রমে বনগাঁ, রানাঘাট এবং রায়গঞ্জ থেকে প্রার্থী করেছে রাজ্যের শাসকদল। রবিবার ব্রিগেড সমাবেশ শেষে অভিষেক তাঁদের নাম ঘোষণার পর অন্যদের মতো এই তিন প্রার্থীর সঙ্গে ‘পরিচয়’ করিয়ে দেন তৃণমূল নেত্রী মমতা।

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রায়গঞ্জ থেকে বিজেপির টিকিটে জয়ী হয়েছিলেন কৃষ্ণ। কিন্তু নির্বাচনের কয়েক মাস পর থেকেই বিজেপির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে শুরু করে তাঁর। প্রথম প্রথম বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর আশেপাশেই দেখা যেত কৃষ্ণকে। শেষমেশ ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে তৃণমূলের পতাকা হাতে তুলে নেন তিনি। তবে বিধায়ক পদ ছাড়েননি। বিজেপি ছাড়ার পর পরই কৃষ্ণের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। কৃষ্ণ নিজে দাবি করেন বিধানসভার অন্দরে শুভেন্দু তাঁকে হুমকি দিয়েছিলেন, তাঁর বাড়িতে ‘আইটি রেড’ হবে। ঘটনাক্রমে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে বিধায়কের বিরুদ্ধে। আয়কর অভিযানও হয়। বিজেপিতে থাকাকালীন কৃষ্ণের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সরব হয়েছিলেন জেলার তৃণমূল নেতা কানহাইয়ালাল আগরওয়াল। এ নিয়ে জেলাশাসকেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী কালে কানহাইয়ালালের আপত্তি সত্ত্বেও তৃণমূলে যোগ দেন কৃষ্ণ। এ বার লোকসভা ভোটে কানহাইয়ালাল প্রার্থী হতে পারেন বলে জেলা তৃণমূলের মধ্যে কানাঘুসো চলছিল। শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণকেই লোকসভার প্রার্থী করল তৃণমূল।

গত বিধানসভা নির্বাচনে উত্তর ২৪ পরগনার বাগদা আসন থেকে বিজেপির টিকিটে জিতেছিলেন বিশ্বজিৎ। তাঁর পুরনো দল অবশ্য তৃণমূলই। ঘাসফুলের টিকিটে দু’বার বিধায়ক হয়েছেন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে তিনি বিজেপিতে চলে যান। শেষমেশ অবশ্য বিশ্বজিৎকে ধরে রাখতে পারেনি বিজেপি। তৃণমূলে ফিরে সাংগঠনিক পদও পান বিশ্বজিৎ। মতুয়া অধ্যুষিত বনগাঁয় বিজেপির মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের বিরুদ্ধে তাঁকেই প্রার্থী করল তৃণমূল। মনে করা হচ্ছে, মতুয়া ভোট এবং এলাকায় সাংগঠনিক সক্ষমতার উপর আস্থা রেখে বিশ্বজিতকে তুরুপের তাস করেছে শাসকদল। আনন্দবাজার অনলাইনকে বিশ্বজিৎ বলেছেন, ‘‘এখনও ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা হয়নি। ভোটে লড়াই করার আগেই বিধায়ক পদ ছাড়ব।’’

মাত্র তিন দিন আগে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূল যোগ দিয়েছেন রানাঘাট দক্ষিণের চিকিৎসক-বিধায়ক মুকুটমণি অধিকারী। তাঁকেও লোকসভার টিকিট দিল তৃণমূল। বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকারের বিরুদ্ধে তাঁকে প্রার্থী করা হল। আনন্দবাজার অনলাইনকে মুকুট বলেন, ‘‘আজই রানাঘাট ফিরে যাচ্ছি। বিধায়ক পদ ছাড়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছি।’’

নুসরত জাহানের বদলে বসিরহাটে তৃণমূল প্রার্থী করেছে হাড়োয়ার বিধায়ক হাজি নুরুল ইসলামকে। সন্দেশখালিকাণ্ড নিয়ে নুসরতের ‘নীরবতা’য় স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের অন্দরে ক্ষোভ দেখা গিয়েছিল। সন্দেশখালিকাণ্ড অস্বস্তি বাড়িয়েছে শাসকদলেরও। এই পরিস্থিতিতে বসিরহাটের ‘ভূমিপুত্রের’ উপরই ভরসা করল তৃণমূল। অন্য দিকে, কাঁথি লোকসভা আসন এ বার তৃণমূলের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, বিজেপির জন্যও (বিশেষত অধিকারী পরিবারের) ‘প্রেস্টিজ ফাইট’। ইতিমধ্যে কাঁথি আসনে বিজেপি প্রার্থী করেছে সৌমেন্দু অধিকারীকে। তিনি কাঁথির প্রবীণ সাংসদ শিশির অধিকারীর ছেলে এবং বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর ভাই। সেখানে এ বার পটাশপুরের বিধায়ক উত্তম বারিককে প্রার্থী করল তৃণমূল। বিধানসভা ভোটে ‘অধিকারীদের প্রভাবিত’ বিধানসভা আসন লড়াই করে বার করে এনেছিলেন উত্তম। তাঁর কাঁধে এ বার আরও বড় দায়িত্ব দিল তৃণমূল। মেদিনীপুর আসনেও আরও এক বিধায়ককে টিকিট দিল তৃণমূল। জুন মালিয়া। মেদিনীপুরের তারকা-বিধায়ক জুন জানিয়েছেন, দল তাঁকে যোগ্য মনে করেছে বলে প্রার্থী করেছে। এ জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। চেষ্টা করবেন সেই ভরসা রক্ষা করার।

বাঁকুড়া লোকসভা আসনে তৃণমূল প্রার্থী করেছে তালড্যাংরার বিধায়ক অরূপ চক্রবর্তীকে। এলাকায় ‘প্রভাবশালী’ নেতা হিসাবে পরিচিত অরূপকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে বিজেপির বিদায়ী সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুভাষ সরকারের বিরুদ্ধে।

১৬ আসনে ২০১৯ সালে বা পরবর্তী উপনির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের বদল করেনি তৃণমূল। ডায়মন্ড হারবার থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, মুর্শিদাবাদ থেকে আবু তাহের খান, জঙ্গিপুরে খলিলুর রহমানকে আবার প্রার্থী করেছে তৃণমূল। কৃষ্ণনগর থেকে টিকিট পেয়েছেন বহিষ্কৃত সাংসদ মহুয়া মৈত্র। আবার প্রার্থী হয়েছেন সৌগত রায়, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্রতিমা মণ্ডল, মালা রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সাজদা আহমেদ, দীপক (দেব) অধিকারী, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আসানসোল থেকে আবার টিকিট পেয়েছেন শত্রুঘ্ন সিন‌্হা, বীরভূম থেকে শতাব্দী রায়, বোলপুরে অসিত মাল।

আরও পড়ুন
Advertisement