Tarader Katha

তারাদের কথা: দিলীপ ঘোষ

Advertisement
শোভন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১২ মে ২০২৪ ২০:০৩

বিনা যুদ্ধে দিয়া দিব সমগ্র মেদিনী

Advertisement

প্রথম যখন বিজেপির বাতাসে তাঁর কেন্দ্রবদলের কথা উড়তে শুরু করল, ঘাড়-ত্যাড়া বাচ্চাদের মতো মুখ গোঁজ করে বসেছিলেন দিলীপ ঘোষ। হয় মেদিনীপুর, নয়তো আর ভোটে নয়— হিতৈষীদের কাছে এই ছিল তাঁর বচন। অস্যার্থ: বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী! ভুল কিছু ভাবেননি। গত লোকসভা ভোটে মেদিনীপুর থেকে তৃণমূলের মানস ভুঁইঞাকে ৯০ হাজারের কাছাকাছি ভোটে হারিয়েছিলেন দিলীপ। হুট বলতেই কেন্দ্রবদল কেন মেনে নেবেন তিনি? সে যতই শুভেন্দু অধিকারী তাঁর আস্থাভাজন অগ্নিমিত্রা পালকে জেতানোর জন্য দিলীপের মেদিনীপুর বেছে নিন না কেন। তবে গাঁইগুঁই করলেও শেষ পর্যন্ত দলের ইচ্ছাই মেনে নিয়েছেন ‘শৃঙ্খলাপরায়ণ সৈনিক’। বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র তো কোন ছার, গোটা মেদিনীপুরই দিয়ে চলে গিয়েছেন বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রে।

তুলল ঝোলা, চলল ভোলা

লেখাপড়ার পাট শেষ করে ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুরের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন দিলীপ। লক্ষ্য: রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের হয়ে কাজ করা। তার পর থেকে যখন যেখানে পাঠানো হয়েছে, ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়েছেন। এ লোকের সংসার-টংসার করা বৃথা। দিলীপ করেনওনি। প্রায় ষাট ছুঁই-ছুঁই বয়সে এ পর্যন্ত ২৬ বার ঠিকানা বদল করেছেন। তবে এত দিনে তাঁর একটি স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে। অবশেষে গত ডিসেম্বরে কলকাতার উপকণ্ঠে নিজের নতুন বাড়িতে বসত শুরু করেছেন তিনি।

যে রাঁধে

আরএসএসের প্রচারক হিসেবে বাংলার বিভিন্ন জেলায় কাজ করেছেন। কাজ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও। দীর্ঘ সময় কেটেছে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। সুনামি পরবর্তী আন্দামানে সঙ্ঘের তরফে যে ত্রাণপ্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন দিলীপই। ভাল রান্না করতে পারেন। আন্দামানের ত্রাণ শিবিরে রান্না করতেন তিনি নিজেই।

সে গল্‌ফও খেলে

এমনিতে ক্রিকেট ব্যাট ভালই ঘোরান। হকিস্টিকেও অরুচি নেই। তবে কোভিডের সময়ে ‘এলিট স্পোর্ট’ গল্‌ফ খেলা শুরু করেছিলেন। ট্রাউজ়ার্স, ডিজ়াইনার টি-শার্ট, মাথায় কখনও-সখনও গল্‌ফ ক্যাপ। পায়ে গল্‌ফ শ্যু। সে পোশাকে দিলীপকে চেনাই দায়! তবে দুঃখ রয়ে গিয়েছে। কী ভাবে স্টিক ধরতে হয়, কী ভাবে রকমারি স্ট্রোক নিতে হয়, সে সব শেখার আগেই নাকি ইকো পার্কের গল্‌ফ কোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল! ক্ষুব্ধ দিলীপ এখনও বলেন, তিনি খেলতে শুরু করেছিলেন বলেই কোর্টে তালা মেরে দেওয়া হয়েছিল।

আপ রুচি পহেননা

তিনি মনে করেন, যা পরেন, তাতেই তাঁকে মানায়। সঙ্ঘের প্রচারক থাকার সময় সাধারণ পোশাকেই অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু সক্রিয় রাজনীতিতে আসার পরে দিলীপের পরিচ্ছদে বদল এসেছে। ডিজ়াইনার টি-শার্ট, দামি স্নিকার্স, ভাল চশমা ইত্যাদি। তবে তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে। মোদীর উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মানুষ তাঁকে এই ভাবেই দেখতে চান। তবে যা পরিধান করেন, সবই পাওয়া। কিচ্ছু কেনা নয়। বছরে এক দিনই খাদির দোকানে গিয়ে সামান্য কেনাকাটা করেন। ২ অক্টোবর গান্ধীজয়ন্তীর দিন। তা-ও নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশে। সঙ্গের ব্যাগে সব সময় গামছা-তেল-সাবান থাকে। পাঁচতারা হোটেল হোক বা তক্তপোশ— সর্বত্র সমান স্বচ্ছন্দ। চাহিদা বলতে বাথরুমে একটা আয়না। দাড়ি কামাতে সুবিধা হয়।

ঘোষে-ঘোষে হয়

২০১৪ সালে দিলীপকে সঙ্ঘ থেকে তুলে নিয়ে এসে সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত করা হয়। পদ: বঙ্গ বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক। দিলীপের সরস ব্যাখ্যা, পর্দার পিছন থেকে ধাক্কা মেরে সামনে এনে ফেলা। তার পর থেকে তিনি মঞ্চে অভিনয় করছেন। রাজনীতিতে আসার এক বছরের মধ্যে দিলীপকে রাজ্য সভাপতির দায়িত্ব দেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে দিলীপ প্রার্থী হন খড়্গপুর সদরে। কংগ্রেসের ‘চাচা’ জ্ঞান সিংহ সোহনপালকে হারিয়ে বিধায়ক হন। এ রাজ্যে বিজেপির ইতিহাসে তিনিই এখনও পর্যন্ত সফলতম সভাপতি। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তাঁর নেতৃত্বে বাংলায় ১৮টি আসন জিতেছিল বিজেপি। ২০২১ সালের ভোটে দিলীপের নেতৃত্বেই বিধানসভা অভিযানে নামে বিজেপি। তবে নবান্ন দখলের অনেক আগে থামতে হয় ৭৭ আসনে। তার কয়েক মাসের মধ্যে তাঁকে সভাপতি পদ থেকে সরানো হয়। তবে দিলীপ দুর্দমনীয়। বর্ধমান-দুর্গাপুরের ‘নতুন মাঠ’ চষে ফেলছেন। রাজ্য সভাপতি, বিধায়ক এবং সাংসদ হয়েছে। কে বলে ঘষে-ঘষে হয় না!

গৌ-গাবৌ-গাবঃ

গোমাতার প্রতি তাঁর ভক্তি প্রবাদপ্রতিম। ২০১৯ সালের সদ্য-সাংসদ দিলীপ একটি ‘গাভীকল্যাণ সমিতি’র সভায় বলেছিলেন, ‘‘গরুর দুধে সোনার ভাগ থাকে। তাই গরুর দুধে হালকা হলুদ আভা থাকে।’’ দাবির ব্যাখ্যায় বলেছিলেন, ‘‘দেশি গরুর কুঁজের মধ্যে স্বর্ণনাড়ি থাকে। সূর্যের আলো পড়লে সেখান থেকে সোনা তৈরি হয়।’’ কোনও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান বা পশুবিজ্ঞান সংস্থা সে দাবিকে মান্যতা দেয়নি। তবে দিলীপ অনড় এবং অটল। তিনি বিশ্বাস করেন, গরুর দুধে সোনার ভাগ রয়েছে। টিকা-ফিকা নয়, কোভিডের সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গোমূত্র পান করার নিদানও দিয়ে দিয়েছিলেন দিলীপ।

গদাধর

আগামী অগস্টে ষাট বছরে পা রাখবেন। কিন্তু শরীর এখনও সজুত। এখনও লাঠি খেলেন, প্রচারে যান হাতে হকিস্টিক নিয়ে। ক্যারাটেও জানেন। ২০ বছর সঙ্ঘের শাখায় ক্যারাটের রীতিমতো প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। কখনও তাঁর হাতে থাকে ডুগডুগি। কখনও গদা।

বচনবাগীশ

কখনও বলেছেন, বিরোধীদের বুকে পা তুলে দেবেন। কখনও বলেছেন, এমন দাওয়াই দেবেন যে, হাসপাতালের আগেই শ্মশানযাত্রা নিশ্চিত হয়ে যাবে। বলেছেন, বুদ্ধিজীবীদের একটু রগড়ে দেওয়া উচিত। মমতাকে নিয়ে বিনা দ্বিধায় যা প্রাণে চায় বলেছেন। সমালোচনা ধেয়ে এসেছে। কিন্তু দিলীপ অদম্য। বিতর্কের ঝড় দেখে কখনও-সখনও পরে মনস্তাপ হয়েছে বটে। কিন্তু পাশাপাশি এ-ও শুনিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি গরম-গরম বাক্যবাণ না ছুড়লে বাংলায় বিজেপি এগোত না।

সুর বেঁধে যে ঘুরে বেড়াই

বঙ্গ রাজনীতিতে ‘চায়ে পে চর্চা’ শুরু করেছিলেন দিলীপই। বিভিন্ন মহল্লায় গিয়ে চায়ের আড্ডা একটা সময়ে রুটিন ছিল তাঁর। ‘মর্নিং ওয়াক রাজনীতি’র স্রষ্টাও তিনি। ইকো পার্ক বা সল্টলেক স্টেডিয়ামে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে সাতসকালে এমন এমন কথা বলতেন দিলীপ, যা সারা দিনের ‘রসদ’ হয়ে থাকত। এখনও থাকে। ঘনিষ্ঠেরা বলেন, অন্য রাজনীতিকেরা ঘুম থেকে ওঠার আগে তিনি দিনের সুরটা বেঁধে দিতে চান। অন্যেরা পিছু-পিছু আসুক। তিনি তত ক্ষণে পরের স্টেশনে পৌঁছে যাবেন।

রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement