রাম-বলরাম
মোদী রাম। তিনি বলরাম। আসলে ‘বলো’ রাম। কারণ, তিনি মোদীর কথাই বলেন। মোদীরই প্রচার করেন। বিজেপিতে অবশ্য যোগ দিয়েছিলেন মোদীর এক বছর আগে। তিনি ১৯৮৭ সালে। মোদী ’৮৮তে। তবে মোদীর সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা ১৯৮২ সালে। আমদাবাদের আরএসএস শাখায়। মোদী তখন প্রচারক। তখন থেকেই তাঁরা ‘রাম-বলরাম’ জুটি। গুজরাতের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরে যে বিশাল নেটওয়ার্ক তাঁরা গড়েছিলেন, তার রিংটোন এখনও মোদীঠাকুরের আপন দেশে অক্ষত। ক্রমে এই জুটি দলের অন্দরেও প্রভাব বিস্তার করেছে। বলরাম হলকর্ষণ করে জমি তৈরি করেছেন। রাম সে জমিতে সাম্রাজ্য গড়েছেন। গুজরাত ছাড়িয়ে সে সাম্রাজ্যের সীমা বিস্তৃত দেশের শাসনক্ষমতায়।
বারো ভুঁইঞা
নরেন্দ্র মোদীর মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে গুজরাত মন্ত্রিসভায় মোট ১২টি দফতরের দায়িত্বে ছিলেন অমিত। স্বরাষ্ট্র, আইন এবং বিচার, কারা, সীমান্ত সুরক্ষা, সিভিল ডিফেন্স, হোম গার্ড, আবগারি, পরিবহণ, গ্রামরক্ষক দল, পুলিশ আবাসন, নিষেধাজ্ঞা (মদ্যপানে) এবং পরিষদীয় দফতরের দায়িত্ব একাধারে সামলাতেন তিনি।
ঠাঁইনাড়া
সোহরাবুদ্দিন এনকাউন্টার মামলায় জেলে যেতে হয়েছিল। তিন মাস কারাবাসের পর জামিন পেলেও গুজরাতে থাকা বারণ হয়ে যায়। ২০১০ সালে আমদাবাদের বসতবাড়ি ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে উঠতে হয়েছিল নয়াদিল্লির গুজরাত ভবনে। শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নিষেধাজ্ঞা ওঠে। তারও দু’বছর পরে ২০১৪ সালে তথ্যপ্রমাণের অভাবে বিশেষ সিবিআই আদালত তাঁকে মুক্তি দেয় সোহরাবুদ্দিন হত্যার অভিযোগ থেকে।
দ্যাখ কেমন লাগে
পি চিদম্বরম কেন্দ্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন অমিত শাহকে সিবিআই গ্রেফতার করে সোহরাবুদ্দিন হত্যার ঘটনায়। ঘটনাচক্রে, তার কয়েক বছর পরে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চিদম্বরমের নয়াদিল্লির অভিজাত এলাকার বসতবাড়ির পাঁচিল টপকে তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল সেই সিবিআই। তখন কেন্দ্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কে? অমিত শাহ।
গান্ধী-বাদ
মা ছিলেন গান্ধীবাদী। তাঁর প্রভাবই নাকি অমিতের জীবনে সবচেয়ে বেশি। অমিত বিশ্বাস করেন, মায়ের থেকে শেখা জীবনবোধের কারণেই মানুষের মতো মানুষ হতে পেরেছেন। কিন্তু গান্ধীবাদী জননীর সন্তান কৈশোরেই জড়িয়ে পড়েছিলেন আরএসএসের সঙ্গে। যে সংগঠনের সদস্য নাথুরাম গডসে গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন। তবে মা তাঁর ছেলের আদর্শ নিয়ে আপত্তি করেননি।
পাইপ-লাইন
জন্ম গুজরাতি বানিয়া পরিবারে। জন্মভূমি মুম্বই। পৈতৃক ব্যবসা ছিল পিভিসি পাইপের। অমিতের জন্মের কয়েক বছর পরে তাঁর পরিবার আমদাবাদে চলে আসে। সেখানেই অমিতের শিক্ষাদীক্ষা। কলেজের পাঠ সেরে বংশগত ব্যবসায় কিছু দিন কাজ করেছিলেন। কিছু দিন শেয়ারের দালালি। কিছু দিন সমবায় ব্যাঙ্কে চাকরি। কিন্তু যিনি এক দিন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন, তাঁকে কি আর এ সব পাইপে ভরে রাখা যায়!
বায়োবীয়
বায়োকেমিস্ট্রির ছাত্র ছিলেন। আমদাবাদের কলেজ থেকে বায়োকেমিস্ট্রি নিয়েই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সে বিদ্যা কি তাঁর পরে কাজে লেগেছে? ‘বায়ো’ জানা নেই। তবে ‘কেমিস্ট্রি’ হয়েছে। রাজনীতির সঙ্গে তাঁর রসায়ন সুপারহিট!
পোস্টারবয়
জীবনের প্রথম ভোটের পোস্টারটি মেরেছিলেন ১৯৭৭ সালের লোকসভা ভোটের সময়। জরুরি অবস্থার পর দেশে প্রথম ভোট। গুজরাতের মেহসেমা কেন্দ্র থেকে তৎকালীন জনসঙ্ঘের প্রার্থী হয়েছিলেন সর্দার বল্লভভাই পটেলের কন্যা মণিবেন। অমিত তখন নেহাতই ত্রয়োদশবর্ষীয় বালক। যাকে বলে ‘বয়’। অথবা ‘পোস্টারবয়’।
লক্ষ্মীর ভান্ডার
একদা বিজেপির যুবমোর্চার হিসাবরক্ষক। তাঁর সময়ে সংগঠনের তহবিল বিপুল কলেবর নিয়েছিল। অলাভজনক এবং ধুঁকতে থাকা ‘গুজরাত ফিন্যান্স কর্পোরেশন বোর্ড’-কে টেনে তুলেছিলেন সংস্থার চেয়ারম্যান হওয়ার পর।
ক্রোনোলজীয়
খোকাবেলা থেকে আরএসএস। পর্যায়ক্রমে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ। তার পরে বিজেপিতে। ১৯৮৪ সালে প্রথম বিজেপির নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে বুথে কাজ করেন। তিন দশক পরে তিনি বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি। তার পরে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ‘ক্রোনোলজি’ বোঝা গেল?
ভোট-চাণক্য
মোদী-শাহ জুটি গুজরাত জুড়ে বুথ স্তর থেকে কাজ শুরু করেছিল। সেখান থেকেই অমিত-উত্থান। ১৯৯৭ সালে মোদীর প্রভাবে টিকিট পান বিধানসভা উপনির্বাচনে। তখন থেকেই বিধায়ক। গত ২৭ বছর ধরে জনপ্রতিনিধি। প্রথমে বিধানসভা। তার পরে রাজ্যসভা এবং অতঃপর লোকসভা। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের সময় তিনি বিজেপির সাধারণ সম্পাদক। সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের বিশেষ দায়িত্ব। সেই ভোটে বিজেপি এবং তার সঙ্গীরা ৮০টি আসনের মধ্যে ৭৩টি দখল করে। প্রান্তিক এলাকার ভোটারদের বুথে আনতে ৪৫০টি জিপিএস-লাগানো মোবাইল ভ্যান নামিয়েছিলেন অমিত। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। লোকসভা ভোটের পর তাঁকে দলের সভাপতি পদে নিয়ে আসে বিজেপি। উপাধি পান ‘চাণক্য’।
শতরঞ্জ কে খিলাড়ি
দাবা খেলতে ভালবাসেন। মন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাতের সরকারি স্কুলে দাবাখেলাকে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু সে তো নেহাতই চৌষট্টি খোপের স্কিল। দলের অন্দরেও রাজনৈতিক দাবাড়ুর ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ। ১৯৯১ সালের লোকসভা ভোটে যে লালকৃষ্ণ আডবাণীর নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন, তাঁকেই বিজেপির অন্দরে নির্বিকল্প ‘মার্গদর্শক’ বানিয়ে রেখেছেন। ‘উচ্চমার্গে’ পাঠিয়ে দিয়েছেন মুরলীমনোহর জোশী, যশোবন্ত সিংহ, সুষমা স্বরাজদের। তাঁরা বিজেপিতে আর প্রাসঙ্গিক নন। এখন শুধু হর হর মোদী! ঘর ঘর মোদী!
জয়-জয়কার
একমাত্র পুত্র জয় শাহ এখন বিসিসিআইয়ের সচিব। তবে বাইশ গজ নিয়ে অমিতেরও উৎসাহ আছে। একটা সময়ে ছিলেন গুজরাত রাজ্য ক্রিকেট সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান। তখন চেয়ারম্যান মোদী। পরে অমিত গুজরাত ক্রিকেটের সর্বময় কর্তা হন। তাঁর পুত্র পেশায় ব্যবসায়ী। বাবার ক্রিকেটের নেশা কি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত? কে জানে! দুষ্টু লোকেরা বলে, বিসিসিআইয়ের সর্বাধিনায়কের পদে তাঁর জয়-জয়কার ক্ষমতাশালী পিতার সূত্রেই।
দিদি-কাঁটা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি তাঁর রাজনৈতিক শত্রুতা নজিরবিহীন। মোদী কোনও এক ভোটপ্রচারে মমতা সম্পর্কে কিছু প্রশংসাসূচক কথা বলায় তাঁকেও অমিত সটান বলেছিলেন, তিনি চান না ‘মোদী বনাম বাকিরা’ এই আখ্যান ব্যাহত হোক! তবে ভোটে অমিত-শক্তি পরাজিত হয়েছে ‘বাংলার দিদি’র কাছেই।
দাদা-কাঁটা
বাংলার ‘দাদা’কে ভোটে দাঁড়াতে রাজি করানোর প্রভূত চেষ্টা করেছিলেন। ক্রিকেটশ্রুতি: বিধানসভা ভোটে বাংলার দিদির বিরুদ্ধে ‘মুখ’ হয়ে দাঁড়ানোর কড়ারেই নাকি শেষ মুহূর্তে পাশা উল্টে ‘দাদা’ বিসিসিআইয়ের সভাপতি হয়েছিলেন। কিন্তু সাত মণ তেল পুড়লেও রাধা নাচেনি। হালকা ডজ় দিয়ে ২০২১ সালে ভোটে দাঁড়ানো কাটিয়ে দেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তবে বিসিসিআইয়ের সভাপতি পদে তাঁর আর ফেরা হয়নি। আইসিসি-র দরজাও খোলেনি।
তবু দাদা দৈ-দৈ
নিয়মিত ইনসুলিন নেন। কিন্তু বাংলায় এলে মিষ্টি দই না-খেয়ে পারেন না। সৌরভের বাড়িতে নৈশভোজেও মিষ্টি দই দেখে চিত্ত ‘তা-তা থৈ-থৈ’ হয়েছিল। ইনসুলিনও নিয়েছিলেন। দইও খেয়েছিলেন।
রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী