কলকাতায় মহিলা তৃণমূলের মিছিল, (বাঁ দিকে) সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাপস রায় (ডান দিকে) —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
উত্তর কলকাতার তৃণমূলে ‘ডামাডোল’ পর্বে তাঁর উত্তর দিয়ে দিলেন দলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার কলেজ স্কোয়্যার থেকে ডোরিনা ক্রসিং পর্যন্ত মহিলা তৃণমূলের মিছিলের শেষে মঞ্চ থেকে সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর বিধায়ক স্ত্রী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘ধন্যবাদ’ জানালেন মমতা। পাশাপাশি, নাম না করে খোঁচা দিলেন তৃণমূলের বিধায়কের পদ ছেড়ে বুধবার বিজেপিতে যোগ দেওয়া তাপস রায়কেও।
ঘটনাচক্রে, তাপসের দল ছাড়ার ‘অন্যতম কারণ’ যে সুদীপ, তা নিয়ে শাসক শিবিরের অন্দরে আলোচনা চলছিল। তাপস নিজে তা গোপন করার বিশেষ চেষ্টা করেননি। মাঝে কুণাল ঘোষও সুদীপের বিরুদ্ধে নতুন করে ফোঁস করেছিলেন। তার পর ফিশফ্রাই, জলভরায় কুণাল-সুদীপের ‘আপাতত’ শান্তিকল্যাণ হলেও সেই বন্ধনীতে তাপস আর ঢোকেননি। তিনি দল ছেড়েছেন। তাঁর দলত্যাগের পর থেকেই তৃণমূল বলতে শুরু করেছে, বাড়িতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) তল্লাশির কারণেই ‘বাধ্যবাধকতা’ থেকে তাপস বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। সেই আখ্যানে বৃহস্পতিবার সিলমোহর দিয়েছেন মমতাও। পাশাপাশিই, সুদীপ-নয়নাকে আলাদা করে ধন্যবাদ জানিয়ে দলের অন্দরে তাঁর ‘বার্তা এবং অভিমত’ স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
শুক্রবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সেই উপলক্ষেই বৃহস্পতিবার মিছিল ডেকেছিল মহিলা তৃণমূল। যে এলাকা দিয়ে বৃহস্পতিবারের মিছিল হয়েছে, তা সুদীপের লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। বেশ কিছুটা এলাকা পড়ে নয়নার বিধানসভা কেন্দ্র চৌরঙ্গির মধ্যেও। মিছিলে নয়না মমতার একেবারে পাশেই হাঁটছিলেন। মিছিলের শেষে ডোরিনা ক্রসিংয়ের সভায় মমতা বলেন, ‘‘আমি সুদীপদা এবং নয়নাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। ওঁরা গোটাটা দারুণ অর্গানাইজ় (সংগঠিত) করেছেন।’’ সুদীপ-নয়নাকে আলাদা করে ধন্যবাদ দেওয়ার আগে যখন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এবং বিজেপিকে একযোগে আক্রমণ করছিলেন মমতা, তখনই নাম না করে তাপসকে খোঁচা দেন তৃণমূলনেত্রী। মমতা বলেন, ‘‘কেউ কেউ বাড়িতে ইডি গিয়েছে বলে বিজেপিতে চলে যাচ্ছে! কারও বাড়িতে এক দিন ইডি গেলেই সে বিজেপিতে চলে যাচ্ছে! ইডিই ফোন করে বলে দিচ্ছে, বিজেপিতে চলে যাও!’’
প্রসঙ্গত, তাপসের দলত্যাগ নিয়ে খানিকটা ‘ভিন্ন’ অভিমত শোনা গিয়েছে কুণালের গলায়। তিনি বুধবারেও বলেছেন, দল আগে থেকে সচেষ্ট হলে তাপস বা সজল ঘোষের মতো নেতাদের ধরে রাখা যেত। উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার যখন মধ্য কলকাতায় মমতা, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ দলের অন্যান্য নেতা-কর্মী মিছিলে হাঁটছেন, তখন কুণাল ছিলেন ডায়মন্ড হারবার লোকসভার বিভিন্ন এলাকায় ব্রিগেডের প্রচারে।
তৃণমূলের ভিতরের সমীকরণে তাপস-কুণাল একই নৌকায় ছিলেন। দু’জনেরই সুদীপের সঙ্গে সম্পর্ক বরাবর ‘মধুর’। আগেও দু’জনে কখনও একজোটে, কখনও পরস্পরের অব্যবহিত আগে-পরে সুদীপের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই তৃণমূলের কাজকর্মে আলগা দিতে শুরু করেছিলেন বরাহনগরের সদ্যপ্রাক্তন বিধায়ক তাপস। তার পরে গত সপ্তাহে কুণাল সুদীপকে আক্রমণ করা শুরু করেন। সরাসরি অভিযোগ করেন, সুদীপ বিজেপির লোক! রোজ় ভ্যালি কাণ্ডে সুদীপকে গ্রেফতার করতে বলে তাঁর এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্টও করেছিলেন কুণাল। উত্তর কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে সুদীপের বদলে মহিলা প্রার্থী দেওয়ারও দাবি তুলেছিলেন কুণাল। সেই প্রার্থিপদের জন্য মন্ত্রী শশী পাঁজার নামও বলেছিলেন। তার পরে তাপস মুখ খোলেন। কালক্রমে তিনি দল ছাড়েন এবং বিজেপিতে যোগ দেন।
অন্যদিকে, কুণালকে ফোন করে বাড়িতে চা পানের আমন্ত্রণ জানান সুদীপ। কুণাল সেখানে যান। বেরিয়ে এসে বলেন, ‘পুরনো কথার বাক্স’ আর খুলতে চান না। বস্তুত, বুধবারেও একটি সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধনে একই মঞ্চে ছিলেন সুদীপ-কুণাল। তবে তৃণমূলের অন্দরে অনেকেই মনে করছেন, বৃহস্পতিবারের মিছিলের শেষে মমতা যা বলেছেন, তাতে ইঙ্গিতে উত্তর কলকাতার দলীয় প্রার্থীর নামটি প্রায় ঘোষণাই করে দিলেন তিনি। উত্তর কলকাতার ‘উত্তর’ দিয়ে দিলেন দিদি।