Rachana Banerjee

লোকাল ট্রেনে বাক্য-রচনা! মিশে যাচ্ছে ধোঁয়া-গরু, দই-ঘুগনির বাক্যমাণিক্য, কী বলছে এক নম্বর দিদির দল?

রচনার এ হেন বাণী নিয়ে যখন হাসিঠাট্টা চলছে, তখন তা কি তৃণমূলের জন্য আলাদা চাপ তৈরি করছে? এমনিতেই হুগলি আসন গতবার হেরেছিল তৃণমূল। এ বার লকেটের বিরুদ্ধে রচনাকে লড়তে পাঠিয়েছেন মমতা।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৪ ১০:৪৮
রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়।

রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ ।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকালীন একজোড়া সিঙ্গুর লোকালের নাম দিয়েছিলেন ‘আন্দোলন লোকাল’। সেই ট্রেনের বিভিন্ন কামরায় আলোচনা এখন এক জনকে নিয়েই। ডাউন পান্ডুয়া লোকালের অফিসযাত্রীদের নিত্য লুডো খেলা থেমে যাচ্ছে তাঁকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে। গোঘাট লোকালের নিত্যযাত্রীদের আলোচ্য বিষয়ও তিনিই।

Advertisement

লোকসভা ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পর ১৩ দিন কেটে গিয়েছে। এরই মধ্যে তিনি যা যা ‘বাণী’ দিয়েছেন, তাতে তাঁকে ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে আলোচনাই হচ্ছে না হুগলির লোকাল ট্রেনগুলিতে। তিনি অভিনেত্রী তথা হুগলি লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়।

একটা সময়ে লোকাল ট্রেনকে অনেকে ‘তাসের দেশ’ বলতেন। নিত্যযাত্রীদের তাস খেলার দাপট এমন ছিল যে, সাধারণ যাত্রীদের হেনস্থার মধ্যে পড়তে হত। এখন তা অনেকটাই কমেছে। তার বদলে জায়গা করে নিয়েছে লুডো। মোবাইলে লুডো খেলা এখন লোকাল ট্রেনের পরিচিত দৃশ্য। চার জন খেলেন। পাশ থেকে আরও পাঁচ জন উঁকি দিয়ে পরামর্শ দেন। বৃহস্পতিবার ডাউন পান্ডুয়া লোকালে সেই ভিড়ের মধ্যে থাকা এক জন ‘রিল্‌স’ দেখছিলেন। হঠাৎ রচনাকণ্ঠে শোনা গেল, ‘ধোঁয়া আর ধোঁয়া।’ দ্রুত লুডো এবং গুটির কাটাকুটি ভুলে শুরু হয়ে গেল বিবিধ বাক্যরচনা!

শুক্রবার আন্দোলন লোকালের ভেন্ডার কামরাতেও শোনা গেল রচনার কথা। রচনার বিবিধ বাণী নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভোটাভুটিও শুরু করে ফেললেন নিত্যযাত্রীরা। কেউ বললেন, এখনও পর্যন্ত রচনার ধোঁয়া দেখতে পাওয়াটাই সেরা মন্তব্য। কেউ বললেন সিঙ্গুরের উন্নতমানের গরু, সেই গরুর আরও উন্নতমানের দুধ এবং তা থেকে সুস্বাদু দই তৈরির যে ‘ক্রোনোলজি’ রচনা করেছেন তৃণমূল প্রার্থী, সেটাই সেরা। কেউ স্বগতোক্তির মতো বললেন, ‘‘এক দিন ছুটি দেখে পান্ডুয়ায় গিয়ে ঘুগনি খেয়ে আসতে হবে।’’

নিত্যযাত্রীদের কথায় ঠাট্টা-তামাশার সুরই প্রধান। হুগলির শেওড়াফুলির বাসিন্দা তথা মধ্য কলকাতার একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মচারী দীপাঞ্জন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘ভোটের বাজারে এ বার রচনাই হিট! তাঁর কথা যত শুনছি, তত জ্ঞান বাড়ছে। কত কিছু জানা ছিল না।’’ আরামবাগের নৈসরাইয়ের বাসিন্দা তথা হাওড়ার একটি কারখানার কর্মী নির্মাল্য সানা বলছেন, ‘‘ট্রেনে আমরা আলোচনা করছি। বাড়িতে স্ত্রীও একই বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। কারখানায় গেলে অন্যেরা জিজ্ঞাসা করছেন, আমার হুগলি কেন্দ্রে ভোট কবে! সব মিলিয়ে আমি নিজেই চোখে ধোঁয়া-ধোঁয়া দেখছি।’’ পান্ডুয়া সিনেমাতলার বাসিন্দা তথা শ্রীরামপুরের একটি গহনার শো-রুমের কর্মচারী সৈকত মণ্ডলের বক্তব্য, ‘‘আমি পান্ডুয়ায় থেকেও জানতে পারিনি, ওখানে এত ভাল ঘুগনি পাওয়া যায়! রচনা আমাদের জানিয়েছেন। সিঙ্গুরের গরু বা ধোঁয়া বার-হওয়া শিল্পায়ন তো দেখার সুযোগই হয়নি।’’

গত শনিবার সিঙ্গুরে প্রচারে বেরিয়ে ‘একতা ভোজে’ যোগ দিয়েছিলেন রচনা। বেড়াবেড়িতে মানিক বাগ নামে এক শ্রমিকের মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসে খাওয়াদাওয়া সারেন হুগলির তৃণমূল প্রার্থী। মেনুতে ছিল ভাত, বড়িভাজা, পটলভাজা, শুক্তো, ডাল, বেগুনি, আলু পোস্ত, চাটনি আর টক দই। প্রত্যেকটি পদের প্রশংসা করেন ‘দিদি নম্বর ওয়ান’। তবে আলাদা করে দইয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘এত ভাল দই এখানকার! আমি তো ভাবছি, ব্যাগে করে দই নিয়ে যাব। কলকাতায় এত ভাল দই তো হয় না। ওখানে কী দই হয় কে জানে!’’ বলতে বলতে হেসে ফেলেন রচনা। তার পরে আবার বলেন, ‘‘যত বার আসব তত বার দই নিয়ে যাব।’’ হুগলির দইয়ে মুগ্ধ রচনা তার পরে শুরু করেন দুধের গুণাগুণ নিয়ে বিশেষ বক্তব্য। তিনি বলে চলেন, ‘‘সিঙ্গুরের মাটিতে এত ঘাস! করবীদি (হরিপালের তৃণমূল বিধায়ক) আর বেচারামদা (রাজ্যের মন্ত্রী বেচারাম মান্না) বলতে পারবেন..। গাছপালায় ভর্তি! সেগুলো গরু খাচ্ছে। গরু তো শাকপাতা খেয়েই বড় হয়। সেগুলো খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে গরু। ফলে তার থেকে যে দুধটা বেরোচ্ছে, তা এত ভাল যে দইটাও এত ভাল হচ্ছে।’’

রচনাকে সিঙ্গুরের শিল্প নিয়ে প্রশ্ন করায় তাঁর জবাব ছিল, ‘‘আমি যখন (কলকাতা থেকে) আসছিলাম, তখন দেখলাম চারদিকে ধোঁয়া আর ধোঁয়া। চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বার হচ্ছে। কে বলছে শিল্প হয়নি? দিদি তো কত শিল্প করে দিয়েছেন। আরও করবেন।’’ যা নিয়ে বিস্তর ‘মিম’ ছড়িয়েছে সমাজমাধ্যমে। বৃহস্পতিবার পান্ডুয়ায় প্রচারে গিয়ে সেখানকার ঘুগনি খেয়ে এবং খাইয়ে বেজায় প্রশংসা করেছেন রচনা। তা নিয়েও ‘মিম’ হয়েছে। তবে রচনার তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তিনি বরং বলছেন, ‘মিম’গুলো মন্দ হয়নি। তাঁর বরং ভালই লাগছে।

হুগলি আসন গত বার হেরেছিল তৃণমূল। বিদায়ী সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে এ বার রচনাকে লড়তে পাঠিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রচনার বিবিধ বাণী নিয়ে এমন হাসি-ঠাট্টা-মশকরা কি তৃণমূলের উপর চাপ তৈরি করছে? শাসকদলের শ্রীরামপুর-হুগলি সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তথা চাঁপদানির বিধায়ক অরিন্দম গুঁইনের বক্তব্য, ‘‘উনি রাজনীতিতে নতুন। কিন্তু এ সব কথাবার্তার প্রভাব ভোটে পড়বে না। হুগলি এ বার আমরাই জিতব।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘রাজনীতিতে নতুন হলেও রচনা শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে কাজ করছেন। প্রচারে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। কোনও কিছুতেই তাঁর ‘না’ নেই।’’

বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘‘হুগলির তৃণমূলের প্রার্থী আসলে রচনা বলছেন। গরুর রচনা লিখতে গিয়ে ঘাস, চাউমিন সব খাওয়াতে চাইছেন। ভোটে সেই রচনা লেখার নম্বর মানুষ দিয়ে দেবেন।’’

সিপিএমের হুগলি জেলা সম্পাদক তথা রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দেবব্রত ঘোষের আবার বক্তব্য, ‘‘রাজনীতির মূল ইস্যুগুলি থেকে নজর ঘোরাতেই এ সব করা হচ্ছে। পরিকল্পিত ভাবেই করা হচ্ছে। ওদের উদ্দেশ্য হল, মানুষ যাতে এই নিয়ে আলোচনা করেন। আর মৌলিক সমস্যাগুলি ভুলে থাকেন।’’

আরও পড়ুন
Advertisement