মুকেশ অম্বানী এবং গৌতম আদানী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আমেরিকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর এক সুনিপুণ বক্তৃতায় প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম ‘অভূতপূর্ব অধিকার’ প্রসঙ্গে এমন দুই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উল্লেখ করেছেন, যাঁদের দু’জনেরই নামের আদ্যক্ষর ইংরেজি বর্ণমালার প্রথম অক্ষরটি দিয়ে। যথাক্রমে ‘অম্বানী’ এবং ‘আদানি’। সুব্রহ্মণ্যম এই দুই বণিক গোষ্ঠীর অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তারের বিষয়টিকে ‘বিশ্বের ধনতন্ত্রের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা’ বলে বর্ণনা করেছেন। এই মুহূর্তে ভারতীয়দের কথার লব্জে ঢুকে পড়েছে এই দু’টি নাম। এর কারণ বর্তমান সরকারের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠতা। কিন্তু সুব্রহ্মণ্যমের বক্তব্য অনুযায়ী এই ‘অনন্যতা’-র বিষয়টি বিতর্কের অবতারণা করতে পারে।
কোনও সন্দেহ নেই যে অম্বানী এবং আদানী, এরা উভয়েই বাণিজ্য-দক্ষ। কিন্তু তেমন দক্ষতা তো অন্য অনেক গোষ্ঠীরই রয়েছে। তবে কোথায় এই দুই গোষ্ঠী আলাদা? যে জায়গায়গাটিতে এরা অন্যদের চাইতে পৃথক, সেটি হল দেশের অর্থনীতির উপর প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য এদের উদগ্র বাসনা। যে বাসনা, বা বলা ভালো ‘ক্ষুধা’কে ক্রমাগত ইন্ধন দিয়ে চলেছে এদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট সরকারি অবস্থান এবং তাকে ঘিরে বহমান বিভিন্ন বিতর্ক। অম্বানী গোষ্ঠী পেট্রো কেমিক্যালসের জগতে তাদের আধিপত্য চায়, সেই সঙ্গে চায় পেট্রোলিয়ায়ম, টেলিকম, অনলাইন মঞ্চসমূহ, সুবিন্যস্ত খুচরো ব্যবসা, এমনকি, বিনোদন জগতের উপরেও ছড়ি ঘোরাতে।
আর অতি দ্রুত গতিতে উঠে আসা আদানি গোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরেই এ দেশের কয়লা রফতানিকারক হিসেবে শীর্ষস্থানে রয়েছে। তারা সৌরশক্তি-সহ দেশের অন্যান্য শক্তি উৎপাদনক্ষেত্রে সব থেকে বড় বেসরকারি উদ্যোগ। সেই সঙ্গে তারা দেশের প্রবেশদ্বারগুলি, অর্থাৎ বৃহৎ বন্দর ও বিমানবন্দরগুলিরও মালিক। লক্ষণীয়, এই দুই গোষ্ঠী কিন্তু পরস্পরের জমিতে পা বাড়ায় না। কিন্তু ‘গ্রিন এনার্জি’ বা প্রাকৃতিক উপাদান থেকে আহৃত শক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে দু’পক্ষেরই প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা হয়তো সঙ্ঘাতেরর পথে যেতে পারে। উভয়েরই সরকার-ঘনিষ্ঠতার কাহিনি সর্বজনবিদিত। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে একাধিক প্রতিযোগী ছিটকে গিয়েছে।
ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিতের দ্বন্দ্ব থেকে ফিরে আসা যাক ‘অনন্যতা’র প্রসঙ্গে। সুব্রহ্মণ্যম দক্ষিণ কোরিয়ার চেবোল (ব্যক্তি বা পরিবার কেন্দ্রিক শিল্পপতি গোষ্ঠী) বা জাপানের পরিবার-নিয়ন্ত্রিত জাইবাৎসু (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠান-নির্ধারিত কেইরেৎসু ব্যবস্থা এসে জাইবাৎসু প্রথাকে সরিয়ে দেয়) প্রথার সঙ্গে অম্বানী ও আদানিদের তুলনা করে এদের ‘অনন্য’ বলতে চেয়েছেন। কিন্তু এ কথা মনে রাখতে হবে যে, জাইবাৎসু/কেইরেৎসু প্রথা দু’টি মাত্র পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। অন্তত পক্ষে আধ ডজন জাইবাৎসু/কেইরেৎসুকে একই সময়ে প্রাধান্যে থাকতে দেখা গিয়েছে। সেই সব দেশের শিল্পপুঁজিতে এই গোষ্ঠীগুলির অংশীদারিত্ব, তাদের স্থাবর সম্পত্তি প্রভৃতি এই ভারতীয় গোষ্ঠী দু’টির তুলনায় অনেক বেশি ছিল। তুলনায় তাদের ব্যবসার বিস্তৃতিও ছিল অনেক বেশি। আর রাজনৈতিক যোগাযোগের দিক থেকে দেখতে গেলে জাপানি ও কোরিয়ান গোষ্ঠীগুলি তাদের দেশের রাজনীতিবিদ এবং সরকারের সঙ্গে যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। এই দুই ভারতীয় গোষ্ঠীর সে সবের সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না। কোরিয়ার চেবোলরা ছিল সরকার দ্বারা পৃষ্ঠপোষিত জাতীয় উদ্যোগের মুখপাত্র। আবার চেবোল ও কেইরেৎসুরা রাজনৈতিক দলগুলির পিছনে গুরুত্বপূর্ণ অর্থসরবরাহকারীর ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হয়েছিল।
যদি কেউ এই প্রসঙ্গে টাটা গোষ্ঠীর উদাহরণ নিয়ে আসেন, তা হলে দেখা যাবে, একদা প্রায়-কেইরেৎসু (তাদের পরস্পর-সংবদ্ধ অংশীদারিত্ব এবং এক প্রকার একনায়কোচিত হাবভাব সে দিকেই ইঙ্গিত করে) এই গোষ্ঠী তাদের দীর্ঘমেয়াদি পারিবারিক আত্মপরিচয় উল্লম্ব ভাবে নির্মিত এক জাইবাৎসু-ধাঁচের গোষ্ঠীর দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। এবং এই চরিত্র অব্যাহত থেকে যায়। ভারতের এই বৃহৎ তিন গোষ্ঠী কিন্তু দেশের জাতীয় স্তরে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়নি। যা অগ্রণী চেবোল এবং কেইরেৎসুরা করতে সমর্থ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এ কথা মানতেই হয় যে, ভারতের ‘স্টার্ট-আপ ইউনিকর্ন’দের (যে সব ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ব্যবসা ১০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যমান স্পর্শ করেছে) সম্মিলিত মূল্যমান অম্বানী সাম্রাজ্যের চাইতে ঢের বেশি। পাশাপাশি, এ-ও মনে রাখতে হবে যে, টাটা গোষ্ঠী অম্বানী বা আদানিদের মতো ‘ক্রাউডিং আউট’ (সেই অবস্থা, যখন বাজার অর্থনীতির কোনও একটি ক্ষেত্রে সরকারের অতিরিক্ত মাত্রায় জড়িত থাকার ফলে অন্য ক্ষেত্রগুলিও প্রভাবিত হতে থাকে। বিশেষত চাহিদা ও যোগানের উপরে তার প্রভাব গিয়ে পড়ে) প্রাধান্য বিস্তারে অথবা রাজনৈতিক ক্ষমতার খেলায় লিপ্ত হতে চায়নি।
এর পরে দু’টি প্রশ্ন জাগে। এক, চেবোল আর কেইরেৎসুরা তাদের নিজেদের দেশের অর্থনীতির বিকাশে এবং রফতানি বাণিজ্যের প্রসারে ‘জাদু’ দেখাতে পেরেছে। সেই তুলনায় তাদের ভারতীয় সমকক্ষরা কী করতে পেরেছে? বরং এই গোষ্ঠীগত আধিপত্য বিস্তারের খেলায় দেশের অর্থক্ষতির বিষয়টিকে ভাবা যেতে পারে। এর উত্তর কিন্তু যাবতীয় বিষয়কে এক পাত্রে বসিয়ে দেবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ক্ষুদ্রতর সংস্থা আর প্রতিদ্বন্দ্বীদের দূরে হঠানোর বিষয়ে কেইরেৎসুরা সমালোচিত হয়। কিন্তু এদের বেলায় তেমন হয় কি?
দ্বিতীয় প্রশ্নটি হল, এই পদ্ধতিগত আধিপত্য কত দিন চলবে? উত্তরে বলা যায়, সম্ভবত কয়েক দশক। জাপানে কেইরেৎসুদের গুরুত্ব দ্রুত কমে এসেছে তাদের অন্তর্নিহিত একীভবনের মডেলের অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে। যেখানে একটি ‘হোল্ডিং ব্যাঙ্ক’ গোষ্ঠীর দুর্বলতর সংস্থাগুলির সহায়তা প্রদান করতে গিয়ে পুঁজিকে ভুল জায়গায় বিনিয়োগ করে বসে। নব্বইয়ের দশকে যখন ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় সঙ্কট দেখা দেয়, তখন কেইরেৎসুদের পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছিল। একই ভাবে কোরিয়ায় চেবোলদের দুর্বল বাণিজ্যনীতি ১৯৯৭-এর এশীয় অর্থনৈতিক সঙ্কটের সঙ্গে দেশকে যুক্ত করে। দেশে অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি উত্তাল হয়ে ওঠে।
ভারতে কর্পোরেট ব্যবসার ঘনীভূত আধিপত্য কি আদৌ কমবে কোনও দিন? নতুন মঞ্চে নতুন বাণিজ্য পরিকাঠামোয় যে ‘যো জিতা ওহি সিকন্দর’-ধাঁচের হাওয়া বর্তমান, সেখানে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দুরূহ। কিন্তু রিলায়্যান্স গোষ্ঠী যে পুঁজির দক্ষ ব্যবহারকারী নয়, তা তাদের পুঁজি বিনিয়োগের তুলনায় লভ্যাংশ প্রাপ্তির হিসেব বিচার করলেই বোঝা যায়। আদানি গোষ্ঠীর হিসেব অবশ্য ভিন্ন। এমনকি, টাটা গোষ্ঠী তাদের রমরমা সফটওয়্যার ব্যবসাকে সরিয়ে রেখেও পুঁজি সংক্রান্ত দক্ষতায় কেমন একটা নিরাসক্ত উদাহরণ রাখে। এয়ার ইন্ডিয়ার মালিকানা তাদের হাতে গেলেও অবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।