ফাঁক থাকিয়াছে বিস্তর। জাতীয় পরিবেশ আদালতে পেশ করা কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্ট বলিতেছে, কলিকাতায় দৈনিক উৎপন্ন সাড়ে চার হাজার টন বর্জ্যের মধ্যে মাত্র ৫১৫ টনের প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। অর্থাৎ, বাকি বিপুল পরিমাণ বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের বাহিরেই থাকিয়া যায়। প্রসঙ্গত, দেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সুস্পষ্ট আইন রহিয়াছে। কিন্তু ‘মিউনিসিপ্যাল সলিড ওয়েস্টস (ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড হ্যান্ডলিং) রুলস ২০০০’ জারির পরেও দেশের সর্বত্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জঞ্জাল পরিষ্কার করিবার ব্যবস্থাটি নিশ্চিত করা যায় নাই। কলিকাতাও সেই না-পারিবার দলেই পড়িতেছে। এক দিকে সেখানে দৈনিক উৎপন্ন বর্জ্যের প্রক্রিয়াকরণে ঘাটতি থাকিয়া যাইতেছে, অন্য দিকে স্তূপীকৃত বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের কাজটিও যথেষ্ট গতি পায় নাই। ফলে সামগ্রিক ভাবে জঞ্জাল ব্যবস্থাপনাটি ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে।
এই তথ্য পুরভোটের প্রাক্কালে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, কলিকাতা শহরের আবর্জনা জমা করিবার প্রধান জায়গা এখনও ধাপার উন্মুক্ত মাঠ। অথচ, সেই ২০০১ সালেই ধাপার মাঠ ‘ভর্তি’ বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছিল। এই অঞ্চলে বহু বৎসরের সঞ্চিত জৈব আবর্জনার পচনে বিষাক্ত, অতিশয় দাহ্য গ্যাস উৎপন্ন হইতেছে। এই গ্যাসে আগুন ধরিলে যে মারাত্মক অগ্নিকাণ্ড ঘটিতে পারে, তাহা লইয়া বিশেষজ্ঞগণ বহু বার সতর্ক করিয়াছেন। কিন্তু প্রশাসনের টনক নড়ে নাই। ভাগাড়ে কয়েক দশকের সঞ্চিত বর্জ্যের দূষণ জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ— উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকর। সেই কারণেই দূষণ প্রতিরোধে ভাগাড়ে জমিয়া থাকা স্তূপীকৃত বর্জ্যের প্রক্রিয়াকরণ নিশ্চিত করিতে দুই বৎসর পূর্বে রাজ্যগুলিকে কড়া বার্তা প্রেরণ করিয়াছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আশা করা হইয়াছিল, ধাপার ৬০ একর জমির সঙ্গে গার্ডেনরিচের ১৮ একর জমিকে স্তূপীকৃত বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হইলে দৈনন্দিন বর্জ্য ফেলিবার স্থানের সমস্যা কিছুটা মিটিবে। কিন্তু গার্ডেনরিচে সজীব বস্তু ব্যবহার করিয়া মাটি, জল এবং এলাকার দূষণ কমাইবার প্রক্রিয়া ‘বায়ো-রেমিডিয়েশন’ এখনও চালু করা যায় নাই। ফলত, জমি পুনরুদ্ধার তো দূর অস্ত্, প্রতি মাসে রাজ্য প্রশাসনকে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা দিতে হইতেছে।
তবে, শহরের জঞ্জালের সম্পূর্ণ দায় পুরসভার নহে, নাগরিকদেরও বটে। অথচ, যত্রতত্র আবর্জনা ফেলিবার কুঅভ্যাসটি কলিকাতার নাগরিকরা এখনও ত্যাগ করিতে পারেন নাই। শহরের সর্বত্র পচনশীল, অপচনশীল জঞ্জাল পৃথকীকরণ প্রকল্প চালু করিবার ক্ষেত্রে কলিকাতা পুরসভার উদ্যোগে যেমন ঘাটতি রহিয়াছে, তেমনই নাগরিকরাও সেই প্রকল্পে আশানুরূপ সাড়া দেন নাই। উপরন্তু, শহরের পথে প্লাস্টিক ফেলিবার নাগরিক বদভ্যাসের ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখা যায় প্রতি বর্ষায়। প্লাস্টিক জমিয়া নিকাশি নালা বুজিয়া যেমন জমা জল নামিতে বিলম্ব ঘটে, তেমনই ডেঙ্গির মশার বাড়বাড়ন্ত আতঙ্কের কারণ হইয়া দাঁড়ায়। মনে রাখা প্রয়োজন, শহর পরিচ্ছন্ন রাখা কাহারও একার কাজ নহে। প্রশাসন হইতে নাগরিক— সকলকেই এই কাজে সমান উদ্যোগী হইতে হইবে। শুধুমাত্র দোষারোপের সংস্কৃতিকে লালন করিলে শহর অচিরেই বসবাসের অযোগ্য হইয়া পড়িবে।