শিল্পী: ঋত্বিককুমার ঘটক। —ফাইল চিত্র।
১৯৭৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ভোরে পি জি হাসপাতালের ইমার্জেন্সির গেটের সামনে বিজন ভট্টাচার্য বসে পড়ে কাঁদছেন। মূল গেটে তেমন কোনও লোক নেই। মৃণাল সেন, অনুপকুমার এবং কয়েকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে, যাঁরা তদারকি করছেন।সত্যজিৎ রায় গেটের কাছে প্রথম গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে আকাশবাণীর সঙ্গে কথা বলছেন। একটু পরেই ছোট একটা ম্যাটাডোরে ঋত্বিককুমার ঘটকের শরীর বার করার চেষ্টা হবে এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর কিছু গুণমুগ্ধ ছাত্র তাতে বাধা দেবেন। সেই বাধাদানের সংখ্যাটা যে-হেতু আরও বাড়বে এবং ফলস্বরূপ এলগিন রোড অবরোধও করা হবে, ফলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বাধ্য হবেন পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে আশি টাকা দিয়ে দু’টি লরির ব্যবস্থা করতে। ‘ইন্টারন্যাশনাল’ গাইতে গাইতে এগোনো সেই মরদেহের মিছিল ক্রমশ বেড়ে যাবে, টেকনিশিয়ান স্টুডিয়ো হয়ে দুপুরে পৌঁছবে কেওড়াতলা।
এই ইতিহাস, কলকাতা শহরের। এই ইতিহাস, ঋত্বিককুমার ঘটকের প্রায় অনাথের মতো চলে যাওয়ারও, যাঁকে আজ অ্যাড্রিয়ান মার্টিন, রেঁমো বেলুর, মার্টিন স্করসেসে, পল উইলোম্যানের মতো সিনে-তাত্ত্বিকেরা বিরাট প্রতিভা হিসাবে স্বীকৃতি দেন। যাঁর ছবিগুলিকে ‘রেস্টোর’ করার কথা বলেন মার্টিন স্করসেসে। এই ইতিহাস, কথকের চালে বলে গিয়েছেন সেই সকালের প্রত্যক্ষদর্শী, ম্যাটাডোরে ঋত্বিকের শরীর বার করতে দেওয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভরত— সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। কোনও নিবন্ধ বা গম্ভীর প্রবন্ধের মাধ্যমে নয়, এই গ্রন্থে একদা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র, পরিণতিতে ফিল্ম স্টাডিজ়-এর বিভাগীয় এই প্রধান, গল্পের ছলে কয়েকজন ফিল্ম সোসাইটির সদস্যের সঙ্গে যেন গভীর এক আড্ডাই দিয়েছেন ঋত্বিককে নিয়ে। তাঁর ছবির তাত্ত্বিক গূঢ় বিশ্লেষণের পাশাপাশি এমন অজানা গল্প বলেছেন সেই কালখণ্ড এবং তৎকালীন সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলি নিয়ে, যা গ্রন্থিত না হলে বরাবরের জন্য হারিয়েই যেত।
পুনর্দর্শনায় চ: ঋত্বিককুমার ঘটক
কথোপকথনে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
২২৫.০০
লোক সেবা শিবির
কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঋত্বিকের দ্বন্দ্বের বহুল-আলোচিত প্রসঙ্গের পাশেই সঞ্জয় রাখছেন এই পর্যবেক্ষণটি— “আজকের পরিপ্রেক্ষিতে ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে আমরা যে ভাবে তুমুল আলোচনা করছি, সেটা ভাবা যায় না। ঋত্বিক একরকম জীবদ্দশায় অবহেলিত হয়েছিলেন। এমনকি তিনি যে পার্টির সদস্য ছিলেন, সেই পার্টি তাঁর মৃত্যুতে, এটা অপ্রিয় হলেও সত্যি, বিশেষ কোনও ভূমিকা দেখায়নি। সিপিআই-এর পক্ষ থেকে এক ভদ্রলোক, আমি তাঁর নাম জানি না, ম্লান মুখে একটা মালা দিয়ে গিয়েছিলেন। ছোট্ট একটা মালা। সিপিআই(এম)-এর পক্ষ থেকেও হয়তো তাই। কিন্তু, ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে সেই ভাবে কমিউনিস্ট পার্টিও, যাকে বলে, তাঁর শোকসভার আয়োজন করেনি।”
ঋত্বিক ঘটকের ছবির ঐশ্বর্যের দিকগুলি নিয়ে এতটাই অনুপুঙ্খ তাঁর বিশ্লেষণ, নতুন এবং উদ্বৃত্ত অর্থও ঠিকরে আসছে তা থেকে। যেমন ধরা যাক, তিতাস একটি নদীর নাম ছবির সেই মিলন-রজনীর দৃশ্যটি (যা তিনি আবার ব্যবহার করেছেন যুক্তি তক্কো গপ্পো-তে) যেখানে একটি সাব-অল্টার্ন মানুষ মিলিত হচ্ছে অপরিচিতা নারীর সঙ্গে। সঞ্জয় বলছেন, “এই যে ফুলশয্যা, গরিবের ফুলশয্যা, তাদের তো বাসরশয্যা হবে না, এই জায়গাটা দেখানোর মতো দুরূহ— এইগুলি সারা পৃথিবীর হাজার হাজার ভারতীয় সিনেমা এবং বিদেশি সিনেমায় দেখেছেন যে, নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক দেখানো সবচেয়ে কঠিন কাজ। আর ঋত্বিক কী করলেন। এই যে, ছেলেটি আর মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে— বর হাঁটু অবধি ধুতি পরে, মেয়েটি একদম কমদামি আটপৌরে শাড়ি পরে, এবং তাকে পার্বতীর মতো লাগছে— ঋত্বিকের ক্যামেরায় একদম ‘কুমারসম্ভবম’... এই যে মুহূর্ত সেই শ্বাসের শব্দটা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে এবং বেড়ে যাওয়ার পরে অর্গাজ়মের সময় লীলাবালি লীলাবালি গানটা আছড়ে পড়ছে। এইটা লাভমেকিং— যৌন সম্পর্ক— যাকে বলে ইন্টারকোর্স, সম্পূর্ণ শরীরবর্জিত। শুধু শব্দের আশ্রয়। দৃশ্য এখানে বিন্দুমাত্র সহায়তা করেনি।”
প্রশ্নকর্তা এক জায়গায় জানতে চান, মেঘে ঢাকা তারা-র নীতার সঙ্গে আজকের মেয়েরা ‘কমিউনিকেট’ করতে পারবে কি না। যে নীতা বাঁচার আর্তিকে ওই ভাবে ‘লাউডলি এক্সপ্রেস’ করছে। তুলনায় যখন প্রায় একই সময়ে তিন কন্যা-য় সত্যজিতের রতন তার একাকিত্বের বেদনা লুকোচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের ওই জায়গার ‘লাউড এক্সপ্রেশন’ সত্যজিৎ বদলে দিয়েছেন তাঁর আধুনিক মন নিয়ে। কান্নার বিবর্তন ঘটিয়ে বলেছেন, এখনকার মেয়েরা কান্না লুকায়, প্রকাশ করে না। সঞ্জয়ের জবাব, “মনে হয় পারবে। কারণ আজকের প্রজন্মে নীতা অনেক বেশি।” একই সঙ্গে তিনি জানান, বাইরে থেকে যদিও ওই পরিবেশটা আর নেই, উদ্বাস্তু কলোনিগুলি আমূল বদলে গিয়েছে। কিন্তু এখানেই সেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলেন সঞ্জয়, যা আজকের নারী-বিদ্যা নিয়ে গবেষণার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ও বটে। নীতার প্রসঙ্গে ফিরে এসে কথক জানাচ্ছেন, “তুমি যদি ছবিটাকে ঠিকমতো দেখো, তা হলে নারীর শূন্যতা বলতে যা বোঝায়, তার অসহায়তা বলতে যা বোঝায়, দেশভাগ ছবিটার একটা জায়গা, সে যে বিভক্ত হয়ে আছে, তার শনাক্তকরণই যে হয়নি, সে নারী হিসাবে শনাক্তই নয়।... বায়োলজিক্যাল আইডেন্টিফিকেশনের বাইরে ‘তুমি কে’— প্রকৃত অর্থে আমাদের সমাজে নির্ণীত হয়নি, অনেক সমাজেই হয়নি, কিন্তু আমাদের সমাজে তা নিশ্চিতভাবেই হয়নি।”
বইটির পৃষ্ঠমলাটের অভিজ্ঞান ধার করে বলা যায়, ঋত্বিক-অভিযাত্রার সঙ্কুল ও অনায়াসে পরিত্যক্ত রাস্তাটি থেকে পরশপাথর খুঁজে আনতে এই কথামালার প্রয়োজন হবে বার বার। আজ, কাল ও দূরাগত পরশুর জন্য।