Higher Education being Harmed

অন্ধকারের যাত্রী

উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজ্য সরকারের অতিসক্রিয়তা এবং তাদের সঙ্গে আচার্য তথা রাজ্যপালের দ্বন্দ্ব-সংঘাত বারংবার অত্যন্ত অবাঞ্ছিত আকার নিয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২৩ ০৬:৫৯
Representative picture of Higher education

উচ্চ শিক্ষা।

অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ বস্তুটি চরিত্রে অনেকটা ব্রহ্মাস্ত্রের মতো। একান্ত প্রয়োজন না হলে সেই অস্ত্র ব্যবহার করা উচিত নয়। তবে এই নিয়ম ধর্মযুদ্ধের। প্রশাসন তথা শাসক দল তথা তার নেতানেত্রীদের কর্তৃত্ব জারি করাই সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ালে সেই নিয়ম অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। অস্বাভাবিক প্রকরণের যথেচ্ছ প্রয়োগই তখন স্বাভাবিক বলে ধার্য হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর কর্তৃত্ব আরোপের ইতিহাস এ-রাজ্যে দীর্ঘ কালের— বামফ্রন্ট তথা সিপিআইএম সেই কলঙ্কিত ইতিহাসের স্রষ্টা, ‘অনিলায়ন’ সেই কলঙ্কের স্থায়ী অবদান হিসাবে শব্দভান্ডারে থেকে গিয়েছে। কিন্তু, পরিবর্তন-এর স্লোগানে ভর দিয়ে ক্ষমতায় এসে বর্তমান শাসকরাও উচ্চশিক্ষার পরিসরে দখলদারি বজায় রাখতে গত এক যুগ ধরে সিপিআইএমের পথই অনুসরণ করেছেন। এবং, এই ক্ষেত্রটিতেও তাঁদের কর্তৃত্বের চেহারা ও চরিত্র আরও অনেক বেশি স্থূল, নিরাবরণ, যথেচ্ছাচারী। অতএব, উপাচার্য নির্বাচনের প্রক্রিয়াটিকে সম্পূর্ণ রূপে নিজেদের কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে তাঁরা সরাসরি অধ্যাদেশ জারি করে দিয়েছেন!

এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটটি সর্বজনবিদিত। উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজ্য সরকারের অতিসক্রিয়তা এবং তাদের সঙ্গে আচার্য তথা রাজ্যপালের দ্বন্দ্ব-সংঘাত বারংবার অত্যন্ত অবাঞ্ছিত আকার নিয়েছে। রাজ্যপালদের আচরণ এবং অভিসন্ধি নিয়ে অবশ্যই বিস্তর প্রশ্ন উঠতে পারে, কিন্তু এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, রাজ্যপালের স্থানে মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য পদে বসানোর বিচিত্র উদ্যোগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে কার্যত একতরফা নিয়োগের সিদ্ধান্ত— নানা ভাবে রাজ্যের শাসকরা নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। উপাচার্য নিয়োগের সরকারি সিদ্ধান্ত সম্প্রতি আদালত অবৈধ বলে ঘোষণা করার ফলে সেই চেষ্টা প্রতিহত হয়। কিন্তু শাসকরা দৃশ্যত হাল ছাড়তে রাজি নন। অতএব এ-বার একেবারে অধ্যাদেশ। উপাচার্য মনোনয়নের নববিধানে পাঁচ জনের বাছাই কমিটিতে তিন জনই হবেন রাজ্য সরকারের বা তার নিয়ন্ত্রণাধীন উচ্চশিক্ষা সংসদের প্রতিনিধি। ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ উৎপাদনের উদগ্র তাগিদে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধির পাশাপাশি ‘মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি’কেও রাখার বন্দোবস্ত হয়েছে। বন্দোবস্তটি কেবল বিসদৃশ নয়, উৎকট।

Advertisement

এমন উৎকট আয়োজনের প্রতিবাদে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ইতিমধ্যেই সরব হয়েছেন। তাঁরা এই যুক্তিও দিয়েছেন যে, উপাচার্য মনোনয়নের প্রস্তাবিত ব্যবস্থাটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্ধারিত নীতির পরিপন্থী। লক্ষণীয়, একতরফা উপাচার্য নিয়োগের পূর্বোক্ত মামলাটিতেও ইউজিসি-র নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আদালতের রায়ে সেই গুরুত্বের স্বীকৃতি মিলেছিল। এই অধ্যাদেশের ক্ষেত্রেও যদি সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে, শাসকরা হয়তো আবার নতুন অস্ত্রের সন্ধান করবেন। কিন্তু এই নিরন্তর টানাপড়েনের ফলে উচ্চশিক্ষার যে চূড়ান্ত ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে রাজ্য সরকারের— উদ্বেগ দূরস্থান— বিন্দুমাত্র চিন্তাভাবনার অভিরুচি আছে কি? রাজ্যপাল, ইউজিসি ইত্যাদির ভূমিকা শেষ বিচারে গৌণ, মুখ্য প্রশ্নটি হল: বিশ্ববিদ্যালয়কে যথাসম্ভব স্বাধিকার দেওয়াই যখন জরুরি, তখন রাজ্যের শাসকরা কেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হেঁটে শিক্ষাব্যবস্থার সর্বনাশকে আরও ভয়ঙ্কর রূপ দিতে এতটা তৎপর হয়ে উঠলেন? উপাচার্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষক-কর্মীদের যেটুকু ভূমিকা ছিল, এই অধ্যাদেশে সেটুকুও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা-চিত্রে সর্বস্তরে যে অভূতপূর্ব অন্ধকার নেমে এসেছে, তাকে সম্পূর্ণ নিশ্ছিদ্র করে তোলাই কি সরকারের প্রকৃত লক্ষ্য? শিক্ষার পূর্ণগ্রাস ঘটানোর কৃতিত্ব নিয়েই তাঁরা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতে বদ্ধপরিকর?

আরও পড়ুন
Advertisement