পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, রাজস্থানের ন্যায় বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলি দাবি করিয়াছে যে, আর পাঁচ বৎসর জিএসটি-র ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা চালু রাখা হউক। দাবিটি ভিত্তিহীন, এমন কথা বলিবার উপায়মাত্র নাই। ২০১৭ সালে যখন দেশ জুড়িয়া জিএসটি চালু হইয়াছিল, তখন তাহার পূর্বশর্ত ছিল, রাজস্ব আদায়ের অধিকার হারাইবার ফলে রাজ্যগুলির যে আর্থিক ক্ষতি হইবে, কেন্দ্রীয় সরকার পরবর্তী পাঁচ বৎসর তাহা পুষাইয়া দিবে এই ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে। তখনও বিশ্বব্যাপী অতিমারি কল্পনার অতীত ছিল। জানা ছিল না যে, রাজ্যগুলি সাধ্যাতীত খরচ করিতে বাধ্য হইবে। ইহাও অজানা ছিল যে, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলিকে তাহাদের প্রাপ্য টাকা দিতে ব্যর্থ হইবে। সুতরাং, পাঁচ বৎসর পূর্বে যে চুক্তি হইয়াছিল, তাহার পুনর্বিবেচনার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি রহিয়াছে। রাজ্যগুলি বলিয়াছে, যে হেতু এক দিকে অর্থনীতি ধাক্কা খাইয়াছে, এবং অন্য দিকে রাজ্যের খরচ বাড়িয়াছে, ফলে সুস্থায়ী কেন্দ্রীয় সহায়তা ভিন্ন রাজ্যগুলির পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া অসম্ভব। প্রশ্নটি কেন্দ্র বনাম রাজ্যের স্বার্থের নহে— প্রশ্নটি দেশের মানুষের স্বার্থের, যেখানে কোনও ‘বনাম’-এর পরিসর নাই। যে হেতু অতিমারির আর্থিক মোকাবিলার ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির ভূমিকাই অগ্রগণ্য, ফলে রাজ্যের হাতে টাকার সংস্থান করিবার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ইহাকে রাজনীতির চশমায় না দেখাই বিধেয়। প্রসঙ্গত, বিজেপি-শাসিত গুজরাত জানাইয়াছে, জিএসটি ক্ষতিপূরণের মেয়াদ বৃদ্ধির দাবি তাহাদের নাই। আশঙ্কা হয়, সঙ্কীর্ণ রাজনীতির যূপকাষ্ঠে মানুষের স্বার্থকে বলি দিতে নেতাদের বাধিবে না।
গত কয়েক বৎসরে কেন্দ্র এবং রাজ্যের আর্থিক সম্পর্কটি বহুলাংশে বদলাইয়া গিয়াছে। কেন্দ্রীয় রাজস্বের ডিভিজ়িব্ল পুল বা বণ্টনযোগ্য ভান্ডারে রাজ্যগুলির হিস্সা খাতায়-কলমে বাড়িয়াছে বটে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ক্রমশই সরিয়া গিয়াছে বিশেষ শুল্ক, সেস ও সারচার্জ আদায়ের দিকে, যাহাতে রাজ্যের ভাগ নাই। জিএসটি চালু হওয়ায় রাজ্যগুলির রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতাও বহুলাংশে কমিয়াছে। ফলে, পরিস্থিতিটি দাঁড়াইয়াছে এই রকম— কেন্দ্রের হাতে অধিকতর রাজস্ব আদায়ের অধিকার, রাজ্যগুলির স্কন্ধে অধিকতর আর্থিক দায়। এই অসম ব্যবস্থা রাজ্যগুলির পক্ষে এমনিতেই মারাত্মক হইতেছিল, অতিমারির বোঝা তাহাতে শেষ পেরেকটিও পুঁতিয়া দিয়াছে। ফলে, উন্নয়নমুখী প্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে কেন্দ্রকে অধিকতর দায় বহন করিতে হইবে, বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলির এ-হেন দাবিকে অগ্রাহ্য করিবার কোনও উপায় নাই। রাজস্থান সরকার স্মরণ করাইয়া দিয়াছে, ‘সেন্ট্রালি স্পনসরড’ প্রকল্পগুলিতে পূর্বে কেন্দ্রের অবদান থাকিত ৯০%— বর্তমানে তাহা বহু ক্ষেত্রে কমিয়া ৫০ শতাংশে দাঁড়াইয়াছে। বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে এই প্রবণতাটি বন্ধ হওয়া জরুরি।
পশ্চিমবঙ্গও বেহাল। তবে, তাহা শুধু অতিমারির ধাক্কায় নহে। অতিমারির সময়কালেই পশ্চিমবঙ্গ অন্তত তিনটি বিধ্বংসী ঝড়ের সম্মুখীন হইয়াছে, যাহার ক্ষতিপূরণ বাবদ কেন্দ্রীয় সরকার তেমন ভাবে হাত উপুড় করে নাই। ফলে, রাজকোষে অতিরিক্ত চাপ পড়িয়াছে। অন্য দিকে, এই সময়কালেই রাজ্যে ‘স্বাস্থ্যসাথী’ এবং ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর ন্যায় প্রকল্প চালু হইয়াছে। রাজ্য সরকার প্রত্যক্ষ সুবিধা হস্তান্তরের পক্ষে সওয়াল করিয়াছে বটে— এবং, ইহাও অনস্বীকার্য যে, অতিমারির ন্যায় অ-স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এই ব্যবস্থাগুলির সুফল আছে— কিন্তু রাজকোষ শূন্য হইলে কি এই গোত্রের খয়রাতি করা চলে? জনমুখী প্রকল্প চালাইতে হইলে রাজ্যের আয় বাড়াইতে হইবে, এবং তাহার জন্য শিল্পায়ন প্রয়োজন— পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন এই প্রাথমিক কথাটি স্বীকার করিতে এখনও দ্বিধান্বিত। ফলে, রাজ্যের দুরবস্থার পিছনে কেন্দ্রের পাশাপাশি নিজেদের ভূমিকার কথাটিও ভুলিলে চলিবে না।