সদ্য স্বাধীন হইয়াছে ভারত। দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হুতাশনে সারা দেশ অগ্নিগর্ভ। কয়েক দিন ধরিয়া খবর আসিতেছে, দুষ্কৃতীরা দিল্লির নিজ়ামুদ্দিন দরগায় হামলা চালাইতে পারে। রাজধানীর পুলিশ কমিশনার তখন এক মুসলমান— খুরশিদ আহমেদ খান; সহকারী পুলিশ কমিশনার এক শিখ— এম এস রণধাওয়া। দেশের স্বরাষ্ট্র তথা উপ-প্রধানমন্ত্রী তাঁহাদের সঙ্গে সারা দিন যোগাযোগ রাখেন। অশান্তি রুখিতে তিনি তখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এক রাত্রিতে তিনি সকলকে লইয়া দরগায় গিয়া প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা কাটাইলেন; স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং সুফি সাধকের মাজার পরিভ্রমণ করিলেন, দরগায় আশ্রয় লওয়া শরণার্থীদের জনে জনে জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁহারা কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হইতেছেন কি না। অতঃপর প্রহরারত পুলিশকর্মীদের জানাইয়া গেলেন, অপ্রীতিকর কিছু ঘটিলে তাঁহারাই দায়ী থাকিবেন। কাল সেই স্বরাষ্ট্র তথা উপ-প্রধানমন্ত্রী বল্লভভাই পটেলের জন্মদিন— সাম্প্রতিক সরকারি লব্জে, ‘একতা দিবস’। প্রধানমন্ত্রী গত সপ্তাহে তাঁহার ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে জানাইয়াছেন, এই উপলক্ষে রঙ্গোলি, লোরি এবং গান লইয়া জাতীয় পর্যায়ের একটি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হইবে। মিতবাক, স্বভাব-সংযত, কাজের মানুষ পটেল তাঁহাকে শ্রদ্ধা জানাইতে এই রূপ তাৎপর্যহীন ‘প্রতিযোগিতা’র আয়োজনে বিরক্ত হইতেন। বিরক্ত হইতেন তাঁহার ১৮২ মিটার উঁচু দুনিয়ার বৃহত্তম মূর্তি লইয়াও, যে মূর্তি স্থাপন করিয়া বর্তমান শাসকবৃন্দ ও তাঁহাদের ভক্তগণের অহঙ্কারের অন্ত নাই। তিনি জানিতেন, যে মানসিকতায় কেহ বৃহত্তম গোঁফের তকমা লইয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করেন, সেই মানসিকতাই ঢালাই লৌহ ও ব্রোঞ্জনির্মিত বৃহত্তম মূর্তি গড়ে। লোকদেখানো আড়ম্বরের ফাঁকিবাজি তাঁহার ধর্ম ছিল না।
হিন্দুত্ববাদীরা সর্দার পটেলকে আজকাল জওহরলাল নেহরুর প্রতিপক্ষ হিসাবে খাড়া করিবার চেষ্টা করেন। ইহা তাঁহাদের ক্ষুদ্রবুদ্ধির প্রমাণ বই কিছু নহে। নেহরুর সহিত বিভিন্ন বিষয়ে তাঁহার মতদ্বৈধ ছিল, কিন্তু তাহা কখনও অশ্রদ্ধা বা সঙ্কীর্ণ ঈর্ষার রূপ লয় নাই। নেহরু কখনও ইস্তফা দিতে চাহিলে তাহার বিরোধিতা করিয়া দৃঢ় ভাবে তাঁহার পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছেন। নেহরুও পটেলের সহিত তেমন আচরণই করিয়াছেন। যাবতীয় মতান্তর সত্ত্বেও দুই গাঁধী-শিষ্যই পারস্পরিক শ্রদ্ধায় অটুট। কলিকাতা শহর তাহার সাক্ষী। ১৯৫০ সালে নেহরুর সহিত পাক প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের চুক্তির প্রতিবাদে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী নেহরু সরকার হইতে পদত্যাগ করিলে পটেল নেহরুর সমর্থনে টানা পাঁচ দিন কলিকাতায় থাকেন, বেশির ভাগ নেতা ও মন্ত্রীকে এই চুক্তির পক্ষে লইয়া আসেন। খেড়া ও বরদলৈ সত্যাগ্রহের নায়ক শেষ দিন অবধি বয়সে অনুজ নেহরুর বিশ্বস্ত সহকর্মী।
তাঁহাকে ‘হিন্দুত্ববাদী’ বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার বর্তমান উদ্যোগও কম করুণ নহে। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে নেহরুর সহিত তাঁহার দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ছিল, সত্য। তিনি এই দেশের মুসলমানদের দেশপ্রেমের প্রমাণ চাহিতেন, তাহাও সত্য। এমনকি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বিপজ্জনকতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন কি না, সেই প্রশ্নও উঠিতে পারে— পটেল তাহাদের কংগ্রেসে যোগদানের ডাক দিয়াছিলেন! কিন্তু হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার অনৈতিক এবং বিপজ্জনক চরিত্র সম্পর্কে তাঁহার ধারণা স্পষ্ট ছিল। গাঁধী-হত্যার পর নাথুরাম গডসের ধর্মীয় পরিচিতি তাঁহার বিচারকে অস্বচ্ছ করিতে পারে নাই— তিনি সঙ্ঘকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিয়াছিলেন। শেষ দিন অবধি নয়া দিল্লিতে তাঁহার বাড়ির ঠিকানা ছিল ১ নং ঔরঙ্গজেব রোড। তাঁহাকে আত্মসাৎ করিবার হিন্দুত্ববাদী প্রবণতাটির প্রতিবাদই হইতে পারে তাঁহার জন্মদিবসের উপযুক্ত শ্রদ্ধার্ঘ্য।